বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস
সচেতনতাই পারে সুস্থ রাখতে
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, সেটি সবারই জানা, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কিউর’। এ কথার তাৎপর্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কোনো রোগ হলে সেটির চিকিৎসা করে সারানোর চেয়ে একটু সচেতন হয়ে সেই রোগ হতে না দেওয়াটা অনেক সহজ। এ কথাটি সব রোগের জন্যই প্রযোজ্য। কারণ দেখা গেছে, এমন অনেক রোগ আছে যা একবার আক্রমণ করলে তার চিকিৎসা করা বেশ জটিল ও কঠিন। আবার কোনো কোনো রোগ হয়, যা আর কখনো ভালো হওয়া সম্ভব নয়। আবার কোনো কোনোটি হলে নিশ্চিত মৃত্যুই যার পরিণতি ইত্যাদি। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস হলো সে রকমই একটি রোগ। রোগ বলা হলেও ডায়াবেটিস আসলে কোনো রোগ নয়। এটি একটি শারীরিক অবস্থা এবং কিছু লক্ষণ।
রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে তা প্রসাবের সাথে বেরিয়ে যায়। সে জন্য বিভিন্ন শারীরিক অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এমনিতে শরীরে যে পরিমাণ সুগার প্রয়োজন হয়, তখন তার চেয়ে বেশি পরিমাণ বেরিয়ে গেলেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এটি একটি নীরব ঘাতক। কারো ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দিলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এটি আস্তে আস্তে শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে এবং সেগুলো নষ্ট করে ফেলে। চিকিৎসাবিদ্যা বলে, ডায়াবেটিস একটি বংশগত রোগ। আর যদি বংশগত হয় তবে তা যে কোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে। কিন্তু যদি বংশগত না হয় তবে সাধারণত বয়স চল্লিশোর্ধ্ব হলেই তা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ডায়াবেটিস না হওয়ার জন্য কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে : শরীরের বাড়তি ওজন কমানো, খাবারে বেশি বেশি শাক-সবজির আইটেম রাখা, পরিমিত শারীরিক ব্যায়াম করা, প্রাণিজ প্রোটিন কম পরিমাণে গ্রহণ করা, কোলেস্টেরলমুক্ত খাবার খাওয়া, মাঝে মাঝে ব্লাড সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করা, ধূমপান, মদ্যপান কিংবা যে কোনো ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করা ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।
অনেকে মনে করেন মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, কিন্তু একটি কথা সবার জন্য স্মরণযোগ্য যে ডায়াবেটিস হলেই কেবল মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যথায় মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হবে এমন ধারণা সঠিক নয়। সে জন্য যত খুশি মিষ্টি খাওয়া যাবে না। কারণ মিষ্টি খেলে সরাসরি ডায়াবেটিস না হলেও এতে শরীরের ওজন বাড়িয়ে দেয়। মানুষের শরীরে দুই ধরনের ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো প্রাথমিক অবস্থা যাকে টাইপ-১ ডায়াবেটিস বলে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটু বেশি অনিয়ন্ত্রিত হলে সেটি টাইপ-২ হিসেবে দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস বেশি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়লে সেটি প্রথমেই মানুষের চোখের দৃষ্টিকে আক্রমণ করে থাকে। সে জন্য এবারের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য হলো, ‘নজর রাখুন ডায়াবেটিসে’ (আইস অন ডায়াবেটিস)। তারপর আস্তে আস্তে সেটি কিডনি, লিভার, হার্ট, ব্রেন ইত্যাদিতে সংক্রমিত হতে পারে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্বের প্রায় ১৯৩ মিলিয়ন লোক এ কঠিন ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত যাদের অর্ধেকেই হয়তো জানেন না যে তাদের এর লক্ষণ রয়েছে।
অসচেতনতাই এ রোগকে ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটি এমন কোনো রোগ নয় যে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর মৃত্যু হবে। বরং একটু নিয়ম-নীতি মেনে চললে স্বভাবিক জীবন-যাপন করেও দীর্ঘজীবী হওয়া সম্ভব। আমাদের চোখের সামনে এমন হাজারো উদাহরণ আছে যাঁরা অনেক আগে থেকেই ডায়াবেটিস রোগী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা দিব্যি ভালো অনুভব করছেন এবং খুবই স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন। তবে বাংলাদেশের মানুষ ডায়াবেটিস নিয়ে অনেকটা সচেতন হয়েছে। ডায়াবেটিসের জন্য ঢাকায় ইব্রাহিম মেমোরিয়াল বারডেম হাসপাতাল এ ক্ষেত্রে অগ্রপথিক। তা ছাড়া রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা এমনকি উপজেলা পর্যায় পর্যন্তও এখন ডায়াবেটিক সমিতি এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইউনিট রয়েছে। যার মাধ্যমে সারা দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পিরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ইনসুলিনসহ অন্যান্য প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়ে থাকে। কারো রক্তে কী পরিমাণ গ্লুকোজ থাকলে কী মাত্রার ডায়াবেটিস এবং সেটি মাত্রা অতিক্রম করলে কীভাবে সচেতন থাকতে হবে, সে সব বিষয়ে প্রচার দরকার।
আর এসব বিষয়ে যেহেতু সচেতনতার বিকল্প নেই, সে জন্য ১৯৯১ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়