সশস্ত্র বাহিনী দিবস
সেনাকুঞ্জে মহামিলনের দিন
বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে ২১ নভেম্বর একটি স্মরণীয় উজ্জ্বলতম দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর তিন বাহিনী একত্রে যাত্রা করে একীভূত হয়ে শত্রুপক্ষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা করে শেষ পর্যন্ত এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে মাত্র ২৫ দিনে স্বদেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। তারই ধারবাহিকতায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ সেই মিত্রবাহিনী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রতিষ্ঠিত নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে তিন বাহিনীর সম্মিলিত প্রয়াসে তাদের কাছেই রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মপক্ষ সমর্থন করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও নেতৃত্বে ৭ মার্চের ভাষণের পরই জাতি পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তার পর ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ক্র্যাকডাউনের পর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলে ২৬ মার্চ ঘোষিত হয় চূড়ান্ত স্বাধীনতা। আর তখনই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরো জাতি। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। সেই মুক্তিবাহিনীতে তখন সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি বাঙালি আবালবৃদ্ধবনিতা যার যা কিছু ছিল, তা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর ডাকে শত্রুর মোকাবিলা করছিল। তারপর বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেই তাঁরই নির্দেশে ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়, যা ১৭ এপ্রিল ভারতের সীমান্তবতী একটি নিরাপদ জায়গা হিসেবে পরিচিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে ইতিহাসের ‘মুজিবনগর সরকার’ শপথ গ্রহণ করে।
সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ নিযুক্ত হন সেনাবাহিনীর কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। তাঁদের কমান্ডিংয়েই নয় মাস চলেছে ভারতে ও দেশের আনাচে-কানাচে প্রশিক্ষণ ও গেরিলা মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেওয়া হয়। গঠন করা হয় তিনটি প্রধান কমান্ডিং ফোর্স। তাদের একটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, যার নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তার নাম দেওয়া হয় ‘জেড-ফোর্স’, আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ, যার নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তার নাম দেওয়া হয় ‘কে-ফোর্স’ এবং শেষটি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে, যার নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে তার নাম দেওয়া হয় ‘এস-ফোর্স’। সেখানে নিয়মিত এসব ফোর্সের পাশাপাশি মুজিব বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী ইত্যাদি অনিয়মিত সব ফোর্স নিয়েই মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে সশস্ত্র বাহিনী এখন সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, তারা তাদের পেশাদারিত্ব দেখাতে সমর্থ হয়েছে বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিকভাবেও। তারা কাজ করছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (র্যাব), কাজ করছে বিদেশের মিশনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মানজনক ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের সম্মান বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে দেশের জন্য বয়ে আনছে গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রা রেমিট্যান্স। তারা অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, জেনারেল সার্ভিস, শিক্ষা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, কৌশল, অবকাঠামো ও দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে। তারা তাদের অনেক সমরাস্ত্র তৈরির প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে।
সশস্ত্র বাহিনীর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ, বিএএফ অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার, খুলনা শিপইয়ার্ড ইত্যাদিই প্রধান। তার পর দেশে যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে-দুর্বিপাকে পুনর্বাসন এবং যেকোনো সংস্কারমূলক কাজের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর বিকল্প নেই। ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয়কেন্দ্র, নতুন রাস্তাঘাট তৈরি করা, বন সৃজন করা ইত্যাদি কাজেও সশস্ত্র বাহিনীর বিশ্বস্ততা আকাশচুম্বী। কাজেই যেদিনটি তিন বাহিনী একীভূত হয়ে সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়েছিল, সেই ২১ নভেম্বরকে স্মরণ করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে এদিন। সেদিন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়ে থাকে। করা হয় রাষ্ট্রীয় কুচকাওয়াজ। শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানগণের পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসের শুভসূচনা করা হয়।
সেদিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক লোকদের নিয়ে সেনাকুঞ্জে আয়োজন করা হয় সম্মিলিত এক মহামিলন কেন্দ্র। সেখানে বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি ও বিরোধীদলের রাজনীতিবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে। সেখানে সব দলের নেতাদের একসঙ্গে বসে কথা বলার অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। কাজেই ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর যেমন তিন বাহিনী একীভূত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতির প্রয়োজনে ডাক দিয়েছিল, এখনো ২১ নভেম্বর এলেই সেই চেতনাতেই সেনাকুঞ্জে একটি মহামিলন কেন্দ্র সৃষ্টি সবাইকে সে সুযোগটি তৈরি করে দেয়। এবারও আমরা এমন নতুন কিছু দেখার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করতেই পারি।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।