পাঠকের কলাম
বদরুল শ্রীঘরে, খাদিজা ফিরবে নিজঘরে
সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে সংগঠিত নৃশংসতার কথা যখন সবাই ভুলতে বসেছে; তখন হাসপাতালের বেডে মাথা উঁচু করে বসতে শুরু করেছে খাদিজা আক্তার নার্গিস। খাদিজাকে আঘাত করা বদরুল এখন শ্রীঘরে। জীবনের সাধ আর সাধের মধ্যে সমন্বয়হীনতা তাকে দিন দিন ভারসাম্যহীন করে তুলছে। অন্যদিকে কিছুদিন আগেও যে খাদিজার বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয় ছিল, সে আজ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে। ঘাতক বদরুলের বেঁচে থাকাটা হবে অর্থহীন। আর তারই চাপাতির আঘাতে যে খাদিজা সেদিন ‘মাগো মাগো’ করে চিৎকার করছিল। জীবনের অধরা স্বপ্নগুলো ছুঁতে খাদিজার বাঁচার তাগিদের সেই আর্তচিৎকার আজ স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে।
সাদা চাদর শরীরে জড়ানো। ব্যান্ডেজ দেওয়া বাম হাতটা তার ওপর, আরেক হাত চাদরের ভেতর। মাথায় স্কার্ফ, কপালের পুরো অংশ ঢাকা। সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস হাসপাতালে বিছানায় বসেছেন। শুক্রবার খাদিজার ভাই শাহীন তাঁর একটি ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। ছবি থেকে খাদিজার অবস্থা কিছুটা জানা যায়। এখন সে আগের থেকে বেশ ভালো। এই খাদিজাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরের দিন খাদিজাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে খাদিজাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তা খুলে ফেলা হয়। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর খাদিজা এখন শঙ্কামুক্ত। হাসি ফুটতে শুরু করেছে খাদিজার মুখে। স্বস্তির নিশ্বাঃস খাদিজার পরিবারে।
খাদিজা আক্রান্ত হওয়ার পর আলোচনা চলছিল বদরুল কতটা হিংস্র হলে এমন নারকীয় কাণ্ডের জন্ম দিতে পারে? এসব ঘটনায় আরো মর্মাহত হতে হয়; যখন দেশের একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর দ্বারা এমন জঘন্য কর্মকাণ্ড ঘটে! শুধু সেটা নয়, প্রগতির ধারক ও বাহক বলে পরিচয়বহনকারীরা যখন পশুত্বের ছায়া হয়ে ওঠে। তখন আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন কিছু থাকে না। কালের পরিক্রমায় সে আলোচনা আজ অনেকটা বিলীন হতে চলেছে। বদরুল যখন এমসি কলেজের সবুজ চত্ত্বরে, পুকুর পাড়ে ফিল্মি স্টাইলে খাদিজাকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছিল তখন পাশে দাড়িঁয়ে কেউ কেউ ভিডিও করছিল। কেউবা চেয়ে চেয়ে দেখছিল। এর মাঝে এগিয়ে এসেছিল ইমরান। ব্যতিক্রমী এই চরিত্রের মানুষও যে এই সমাজে আছে সে উদাহরণও আজ দীপ্তমান।
ঘটনার পর থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে সবাই। প্রেমের সমাধি কি রক্তের স্রোতে? বদরুল খাদিজাকে ভালোবাসত। প্রেম নিবেদন করেছিল। প্রেমের ডাকে মেলেনি সাড়া। সুযোগ বুঝে তাই ভালোবাসার পাত্রকে রক্তে লাল করতে হবে! সে কি আসলেই ভালোবেসেছিল? ভালোবাসা-প্রেম রক্ত চুষতে শেখায় কি? পশুত্ব লালন করে কাউকে ভালোবাসা অপরাধ বলে কি? ভালোসার সঙ্গায়ন চাপাতির কোপে রক্ত ঝরানো নয়! দ্রোহ, প্রেম, ভালোবাসা সমাজিক এসব উপাদানের অস্তিত্ব বিদ্যমান আছে বলেই এ সমাজ এত সুন্দর; এত জীবন ঘনিষ্ট। পশুত্ব আর মানবিকতার দ্বান্দ্বিক একটা অবস্থানও এ সমাজে বিদ্যমান। জীবনের প্রয়োজনে জীবনের জন্যই কোনটা বর্জন আর কোনটা গ্রহণ করতে হয়। সমাজের প্রতিটি স্তরে পশুত্ব বিলীন হয়ে মানিবকতার উন্মেষ হোক।
খাদিজা সুস্থ হয়ে কি তার গ্রামে ফিরে যাবে? পড়ার টেবিলে গোছালো সেই বইগুলো পড়বে কি? মেঠো রাস্তা বেয়ে কলেজের পথ ধরার সাহস সে পাবে কি? সবজি বাগান করার যে শখ তার ছিল, পূরণ হবে কি তা? পাড়ার ছেলেমেয়েরা খাদিজা আপু বলে ডাকলে কতটুকু সাড়া দেবে সে? জঘন্য সে ঘটনা কি তার মানসপটে ভেসে উঠবে সময়ে সময়ে? কীভাবে সে সমালে নেবে নিজেকে? আজো এ রকম হাজারও প্রশ্নের আড়ালে যতটুকু সান্ত্বনা সেটা আর কিছু নয়, খাদিজার স্বশরীরে ফিরে আসার সম্ভাবনা।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়