শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
সব বধ্যভূমি কি চিহ্নিত হয়েছে?
মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশের ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য তাঁরা জীবন দিতেও পিছপা হননি। সরাসরি রণাঙ্গনে যেমনি সম্মুখ যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন লাখো বাঙালি, তেমনি কলম ও বুদ্ধি দিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছেন একদল জ্ঞানী-গুণী, পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত জাতির বিবেক।
দেশের ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের সাথে আরো সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন গেছে, তাঁরা হলেন দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী। একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা এখনো পুরোপুরি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাপিডিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে, সে অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। তাঁদের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, শিক্ষাবিদ জোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত, দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা, শিক্ষানুরাগী অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, শিক্ষাবিদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, আনোয়ার পাশা, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ধীরেন্দ্র দত্ত, সিরাজুল হক খান, ড. মুক্তাদির, ড. সাদেক, ড. আমিনুদ্দিন, সায়ীদুল হাসান, ডা. ফজলে রাব্বি, ডা. গোলাম মোর্তজা, ডা. আলিম চৌধুরী, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেন, আবুল খায়ের, নিজামুদ্দিন আহমেদ, শহীদ সাবের, ফয়জুল মহী, আ ন ম গোলাম মোস্তফা প্রমুখ।
বর্বর পাকিস্তানিরা এ দেশে নারকীয় এসব হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে ১৬ ডিসেম্বরের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ যখন এসে দেখল যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত তখন তারা জাতির বিবেক এই বুদ্ধিজীবীদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের সহায়তায় রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে গিয়ে অমানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে গুলি করে এবং তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আস্তে আস্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে টর্চার সেলের পাশে আবিষ্কৃত হতে থাকে এসব গণকবর যা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাস এলেই আমরা এসব বীর সন্তানকে স্মরণ করার জন্য মাত্র কয়েকটি চিহ্নিত বধ্যভূমিতেই আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন সীমাবদ্ধ রাখি। কিন্তু এর বাইরেও যে আরো শত শত বধ্যভমি এখানো অনাবিষ্কৃত রয়েছে সে বিষয়েও আমাদের এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মটি শেষ হয়ে গেলে এগুলোর সঠিক ইতিহাস বর্ণনা করার মানুষ পাওয়া যাবে না।
রাজধানীর মিরপুর ও রায়েরবাজার- এ দুটিসহ সারা দেশে বিগত ৪৫ বছরে মাত্র ৩৫টি বদ্ধভূমি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। আবার চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও এগুলো সংরক্ষণের তেমন সফলতা এখানো দেখা যাচ্ছে না। অথচ সারা দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায়, উপজেলায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টর্চার সেল ছিল এবং সেখানে বধ্যভূমির অস্তিত্বের কথা সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর কাছে শোনা যায়। তবে যে ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়েছে তা যথার্থ নয়। ২০১২-১৩ সালে ২০৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে একটি প্রকল্প দাখিল করা হলেও সেটি যাচাই-বাছাই করে সেখানে আরো ৭৫টি যোগ করে মোট ২৭৯টি বধ্যভূমি সংরক্ষণার্থে সেটি পুনরায় দাখিল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো প্রায় ৩৬০টি ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। তাই বধ্যভূমিগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রত্যাশাই হোক এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের শপথ।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়