যে কারণে পুরস্কৃত হলেন তিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী
ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার নাম অনেক শুনে থাকলেও, পরজীবীদের (parasties) কথা খুব একটা আলোচিত হয় না। মানুষের মাথার উঁকুন কিংবা শরীরের ভিতরের কৃমি—এগুলো পরজীবী। প্রাণীর শরীরের ভিতর ও বাহির, পরজীবীদের বেঁচে থাকা কিংবা জীবনচক্রের জন্য উপযোগী জায়গা। আমাদের দেহ যেন তাদের জন্য উদার পোষক (Host)! আমাদের ক্ষতি করে ওরা সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকে। এ জন্যই ওদের সাধারণভাবে বলা হয় পরজীবী।
সব পরজীবী, উঁকুন কিংবা কৃমির মতো এত বড় ও দৃশ্যমান নয়। অনেক পরজীবী খুবই ক্ষুদ্র, যেগুলো মূলত অণুজীব (Microorganism)। দারুণ বিষয় হলো আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন পরজীবীর জন্য উপযোগী। কিছু পরজীবীর জন্য রক্ত কিংবা লাসিকা (Lymph) অনুকূল পরিবেশ। কোনো কোনো পরজীবীর জন্য প্রাণীর চোখ বা ত্বক হলো অনুকূল। সত্যিই বিস্ময়ের!
ম্যালেরিয়া রোগ হয় প্লাজমোডিয়াম নামক পরজীবীর জন্য। ম্যালেরিয়া মানব সভ্যতায় অন্যতম প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগ নিরাময়ের জন্য কুড়ি শতকের শুরু থেকে কুইনাইন (Quinine) বহুল ব্যবহৃত। কালে কালে আরো বিভিন্ন ওষুধ উদ্ভাবিত হয়েছে। সমস্যা হলো কোনো নির্দিষ্ট ওষুধই দীর্ঘদিন রোগ নিরাময়ে সফলভাবে প্রয়োগ করা যায় না। এর কারণটা হলো পরজীবীদের অভিযোজন (Adaptation) ক্ষমতা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীদের জগতে এই অভিযোজন হয় খুব দ্রুত। ফলে কোনো ওষুধ দীর্ঘদিন একটি রোগের জন্য ব্যবহার করা হলে, একসময় সেই ওষুধের কার্যক্ষমতা কমে যায়। কখনো কখনো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। কারণ অণুজীবগুলো সেই ওষুধে আর ধ্বংস হয় না। তাদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে। বিজ্ঞানে এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। তাই সময়ে সময়ে নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করতে হয়।
প্রায় ৪০ বছর আগে টু ইউইউ(Tu Youyou) নামের একজন চীনা বিজ্ঞানী ম্যালেরিয়া নিরাময়ের জন্য একটি ভিন্ন ওষুধ আবিষ্কার করেন। যেটি আরটিমিসিনিন(Artemisinin) নামে প্রচলিত হয়। দারুণ বিষয় হলো এই ওষুধটি সংগ্রহ করা হয় একটি উদ্ভিদ থেকে। চাইনিজ ভাষায় সে উদ্ভিদের নাম চিংহাও(Qinghao)। ম্যালেরিয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ওষুধের চেয়ে, আরটিমিসিনিন অনেক বেশি কার্যকর। আরটিমিসিনিন দিয়ে রক্ষা পেয়েছে পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণ। এই অসামান্য সৃষ্টির জন্য, এ বছর তিনি পেয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরো দুজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁদের নাম উইলিয়াম ক্যাম্পবেল(William Campbell) ও সাতোশি ওমুরা(Satoshi Omura)। তাঁরা আবিষ্কার করেছেন অন্য এক ঔষুধ, যা দিয়ে ভিন্ন দুটি রোগ নিরাময় সম্ভব। রোগ দুটি রিভার ব্লাইন্ডনেস(River Blindness) ও লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস(Lymphatic Filariasis) নামে পরিচিত। দুটি রোগই হয় পরজীবীদের মাধ্যমে। প্রথম রোগটির নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে, এ রোগে মানুষ তার দৃষ্টি শক্তি হারায়। শেষোক্ত রোগটি হয় ফাইলেরিয়া নামক পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হলে। ফাইলেরিয়া মানুষের লাসিকা তন্ত্র (Lymphatic System) অকার্যকর করে দেয়।
সতোশি ওমুরা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণায় পারদর্শী। ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীবে বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ থাকে যেগুলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের রোগ নিরামকরূপে ব্যবহৃত হতে পারে। সমস্যা হলো পর্যাপ্ত পরিমাণে সেসব যৌগ পৃথকীকরণ ও প্রাণীদেহে পরীক্ষা করা খুবই সময় সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং ধৈর্যের কাজ। জাপানের বিজ্ঞানী সাতোশি ওমুরার নিশ্চয় সবই ছিল! স্ট্রেপটোমাইস গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া থেকে তিনি পৃথক করলেন এক রাসায়নিক যৌগ।
নাম দিলেন এভারমেকটিন(Avermectin)। প্রশান্ত মহাসাগরের অন্য পারের বিজ্ঞানী ক্যাম্পবেল অনুরূপ যৌগ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার যৌগ আইভারমেকটিন (Ivermectin), গঠনে এভারমেকটিনের মতোই। আইভারমেকটিন দিয়ে রিভার ব্লাইন্ডনেস ও লিম্ফেটিক ফাইলেরিয়াসিস রোগ নিরাময় আরো সহজ হলো। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচল।
এই তিন বিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন দেশে কাজ করেছেন। নতুন নতুন ওষুধ উদ্ভাবন ও প্রায়োগিক গবেষণায় অবদান রেখেছেন। তবে তাঁদের গবেষণার একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্ম ছিল। সেটি হলো পরজীবীদের (Parasites) ধ্বংস করে মানুষের প্রাণ রক্ষার নিমিত্তে সাধনা। সে সাধনায় তাঁরা উত্তীর্ণ। এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
লেখক : গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন। ইমেইল: redoxrouf@yahoo.com