গল্প
পদ্মকাঁটা

এভাবে, বালিকা-কিশোরী নিরুদ্দেশ হলে গ্রামের লোকেরা তার সন্ধানে অন্ধকারে যায়, সন্ধ্যা এবং রাতের নিরালম্ব ঘুটঘুটে আঁধার তাদের শরীরের ভেতর জমা হলে তারা আর রাতের নিরবচ্ছিন্ন আলোহীনতার ভেতর যেতে পারে না। তখন, তারা দেখে, গ্রামের যুবকদের শরীরে লুকানো গোধূলি ফুঁড়ে পদ্মকাঁটার মড়ক শুরু হয়েছে।
আঁধারের অপেক্ষার ভেতর পড়ে থাকা একখণ্ড ছায়ার কাছ থেকে গ্রামের লোকেরা বালিকা-কিশোরীকে খোঁজাখুঁজির সূচনা করে, সেখানে, নরম ছায়ার ভেতর দূর্বাঘাসেরা নিশ্চুপ ঘুমে তলিয়ে ছিল। তারা ঘাসের গভীরে প্রবেশ করে; ঘাসের নীরব দৃশ্যাবৃত আহ্বান তাদের মনে হয়, সজীব আর উজ্জ্বল। কিন্তু সেখানে কেবল মৃদু পতঙ্গের বিন্দু বিন্দু নিষ্কলুষ আলোর প্রতিবিম্বের দৃশ্যকল্প ছাড়া অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব না পেয়ে তারা দিগন্তবৃত্তের ধূসর ঐকতানের দিকে যায়। দিগন্তের ঐকতান তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তারা দেখে বিলীয়মান ছায়া এবং ধ্বনির বিনম্র গন্ধে মিশে আছে নক্ষত্রের রুগণ জ্যোতির্ময়। বিস্তীর্ণ কুয়াশা প্রস্তুতি প্রণীত দিগন্তরেখার ভেতর থেকে আবির্ভূত নীলিমা নিসর্গের নীলাভ কারুকাজ ছাড়া আর সবই আঁধারের উপসংহারে পৌঁছানো।
সুতরাং গ্রামের লোকেরা ফিরে এসেছিল, তারা উপলব্ধি করেছিল এমন ধূসর নীলাভ্রের দিগন্ত ছায়ায় বালিকা-কিশোরীর নিরুদ্দেশ অসুখী কল্পনা মাত্র। তখন তারা খঞ্জমেঘের অনাবিল নিসর্গে ঘেরা নিঝুম সন্ধ্যা এবং রাতের শূন্য আঁধারের ভেতর বালিকা-কিশোরীকে খোঁজে। নিসর্গের প্রবহমান আঁধার তাদের শরীরের ভেতর জমা হতে থাকলে তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে, নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। তাদের মনে হয়, দুশ্চিন্তামুক্ত নিরাপত্তার ভেতরই কেবল মানুষ নির্বিঘ্নে ঘুমের গহিনে তলিয়ে যেতে পারে; ঘুম তাদের সুখী জীবনে পদ্মের অনন্য নিরাপত্তা, যেন পৌরাণিক সজীবতায় সংগীত হয়ে আছে। গ্রামের লোকদের মনে হয়, তবে কি বালিকা-কিশোরী চন্দ্রাতপ পুষ্পছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে? অথবা গাছের পাতার ফাঁকফোকর ভেদ করে ঝরে পড়া টুকরো টুকরো জ্যোৎস্নার এপিটাফে সে নিজেই ফুল হয়ে ফুটে আছে ঘাসের গভীর ঘুমে, আর তারা তাকে বুনো ফুলের বিভ্রম ভেবে চিনতে ভুল করেছে? গ্রামের লোকেরা তখন বালিকা-কিশোরীর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তমস্বিনী রাত লোকায়তিক হাতে মুছে দেয়; নক্ষত্রকঙ্কনের ভেতর উচ্চারিত বালিকা-কিশোরীর নাম ঝমঝম শব্দে বেজে ওঠে, শূন্য প্রতিধ্বনি ফিরে আসে। মনে হয় এসব ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় নামের রেশ পৃথুল বিলের দিকে চলে গেছে, নক্ষত্রের মৃদু আলোর দিকে হারিয়ে গেছে, ফুলের সোনালি গন্ধের দিকে নিশ্চুপ। বিলের নীলাঞ্জন জলের রুপালি ছায়ায় পদ্মের খঞ্জপাতার ওপর জেগে আছে চঞ্চল মাছের সবুজ গন্ধচিহ্ন। নিথর নিস্তব্ধ বিল পড়ে আছে কুয়াশা প্রস্তুতিময় আকাশ হয়ে। গ্রামের লোকেরা ফিরে এসেছিল, অজানা আতঙ্কে দুশ্চিন্তার নিঃশব্দ ভয়ের ক্রুর গোলকধাঁধায় সারা রাত তারা একই ছায়ান্ধকারে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে বিধ্বস্ত প্রতিভাসে পৌঁছায়। ছায়ান্ধকারে গ্রামের লোকেরা পুনরায় চিৎকার করে, ভেঙে দেয় বিনম্র লতাকুঞ্জের নিস্তব্ধ ঝিল্লিরব। ছায়ান্ধকারের ভেতর লুব্ধ বিড়াল মাছ খেয়ে ফেলে রাখে নগ্ন কাঁটা। ছায়ান্ধকারের ভেতর পিঁপড়ার দল মুখে মুখে টেনে নিয়ে যায় মৃতের টুকরো মাংস। ছায়ান্ধকারের ভেতর গ্রামের প্রাচীন বৃদ্ধার গুনগুন কান্নার স্বর উড়ে যায়। ছায়ান্ধকারের ভেতর কোথাও বৃক্ষের সহিষ্ণুতা ইন্দ্রনীল গোধূলির অপার নীলিমায় হেসে ওঠে। ছায়ান্ধকারের ভেতর বিস্মৃতিশীল বাতাসের সংকেতে পাখিরা ফেলে রাখে সমাধিফলকের চিহ্ন। ছায়ান্ধকারের ভেতর মঞ্জুশ্রী জলের গভীর তলে ঘুমায় প্রৌঢ় হাড়। ছায়ান্ধকারের ভেতর ঋতুবিধুরতাময় অনাঘ্রাত ফুল ভেসে যায় জাহ্নবীর জলে। ছায়াধূসরিত আঁধারে বালিকা-কিশোরীর সন্ধানে গ্রামের লোকদের তখন নিদ্রাহীনতায় পেয়ে বসলে তাদের দূর অতীতের অপসৃয়মান ঘটনা মনে পড়ে, অথবা তারা নিদ্রা ভুলে যায়। নিদ্রা বলতে তখন তাদের রাতের ছায়াসূচির ভেতর তন্দ্রার অভিনয়, আধো ঘুম আধো জাগরণের ভেতর মাছের চোখের মতো নিষ্পলক শূন্যের নৈঃশব্দ্যে তাকিয়ে থাকা। তাদের সুখনিদ্রাহীন জীবনে মাছের হৃদয় উজ্জ্বল হয়ে এলে লোকেরা মেঘের গল্প বলে, জলের গল্প বলে; লোকেরা পাখির যাবতীয় উড়াল সম্ভাবনার কথা বলে। তারা বলে, মেঘ যদি না থাকে তাহলে তাদের জীবনে জলের অস্তিত্ব দূর অতীত হয়ে গেছে; মেঘ যদি পৃথুল ছায়ার ভেতর একখণ্ড আকাশ ছড়িয়ে না থাকে তাহলে পাখিরা মাটির পাখি। তখন গ্রামের লোকেরা এসব কথা ও গল্পের ভেতর তাদের জীবনের নিশ্চিত ও অনিবার্য আশ্রয় হারিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে। তারা উপলব্ধি করে কেবল তন্দ্রার অভিনয়ে নিমজ্জিত জীবন কর্মহীন আলস্যমথিত মৃত্যুর অবলম্বন ছাড়া কিছু নয়। তখন তারা মৃত্যুর দিকে ফেরে। দূর অতীতে অপসৃয়মান মৃত্যুঘটনার করুণ ছায়া তাদের করোটির চতুর্দিকে নীল অন্ধকারের জিপসি নৃত্য উদ্দাম ঐকতানে উড়ছে। তাদের মগজ আর অনুভূতির ভেতর গ্রামের সবচেয়ে প্রৌঢ়া অনূঢ়া নারীর বেদনাবহ জীবন পুষ্পগন্ধে উদ্ভাসিত হয়, সে একা, আর আজন্ম প্রৌঢ়, চিরদিনই; মাথার ওপর ক্রুর আকাশ, অন্ধকার নিহারিকা অযাচিতই ছিল। তথাপি, একাকী আত্মীয়বান্ধব বলতে নিরুপায় সে। গ্রামের লোকেরা অনেক অনেক বছর আগে নিকষ মৃত্যুর ভেতর নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া অনুঢ়া নারীর সুখদুঃখময় জীবনের করুণ স্মৃতিবিধুরতার নির্জনে প্রবেশ করে।
অনূঢ়া এই নারীকে গ্রামের লোকেরা অনেক অনেক বছর ধরে এক অজ্ঞাত আয়ুষ্মতী প্রৌঢ়ত্বের সহিষ্ণুতার ভেতর দেখতে পেয়েছিল। তখন, তার জীবন একটি অস্ফুট শব্দ উচ্চারণের বিনীত পুরস্কার; সেই অস্ফুট উচ্চারিত একটি শব্দই এরূপ যে, গ্রামের লোকেরা তার বিবিধ অর্থ নির্মাণ করে নিতে পারত। তার প্রতিটি অস্ফুট উচ্চারণের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে থাকত হৃদয়ের ছায়াগুঞ্জরিত ততধিক অস্ফুট হাসির অস্পষ্ট রেখা। গ্রামের লোকদের কাছে কখনো ওই হাসির ছায়া-ছায়া রেখা মনে হয় অব্যক্ত ও গোপন অশ্রুনির্ঝর বয়ে চলেছে। তবু সেই হাসির ক্ষীণ রেখার মধ্যে প্রৌঢ়া নারীর যৌবন রূপের শেষ ঐশ্বর্য গোধূলি হয়ে ছিল। আর অনূঢ়া নারীর জরাজীর্ণ বিধ্বস্ত বাড়িটি স্তব্ধতার ঐকতানে ভেসে চলা করুণ সংগীত, চারপাশে কলাগাছের রোমাঞ্চশিহরিত সবুজতা। প্রৌঢ় কলাগাছের মৃত্যুধ্বস্ত কন্দ ফেড়ে শিশু গাছের অজস্র অবিরত নিষ্কলুষ প্রেমের প্রতিবিম্ব ছড়িয়ে দেয়। প্রতিমুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ার উন্মুখতা সেই ইট আর জঙ্গলের স্তূপময় বাড়ি ছেড়ে প্রৌঢ়া নারী কোথায় যাবে? গ্রামের লোকেরা তাকে কখনো কোথাও যেতে দেখেনি, তার বিচরণ কেবল কলাগাছের পুষ্ট কাণ্ডের ছায়ার ভেতর। পুরোনো কলাগাছের মৃত্যুর ছায়ায় কচি কচি শিশু কলাগাছ হেসে উঠলে একদিন তারা উঠান পেরিয়ে গ্রামের ভেতর প্রবেশ করে। গ্রামের সব জমি কলাগাছে ভরে যায়। সব ছায়ার ভেতর কলাগাছের ঐশ্বর্য। তখন গ্রামের লোকেরা দেখে কলাগাছের ছায়ায় পাখির কিচিরমিচির, দেখে কলাগাছের কচি পাতায় মেঘ জমে আছে। মেঘ তাদের কল্পনা আর স্পর্শের ভেতর পাখির গানে মুখরিত হয়ে ওঠে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার ভেতর, কাজ ও চিন্তার মধ্যে, শিল্প ও জীবনের অন্তর্গত উপলব্ধির ভেতর পাখি আর মেঘের গান নিয়ে মুকুল কুসুমিত কলাগাছ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের লোকেরা কলাগাছ জড়িয়ে ধরে আদর করে, কচি সবুজ ছায়ায় রৌদ্রচূর্ণাবলির ছড়া বলে, কলাগাছের পীতাভনীল কাণ্ডের বিমূঢ় গর্ভের ভেতর হেসে ওঠে পৃথিবীর সকল বিকেল, সকল রাত। যে রাত নিসর্গের সহিষ্ণুতার ভেতর ফুলসমগ্রকে, ফুলের রেণুসমূহে পতঙ্গের ওড়াউড়ির স্পর্শকে, স্পর্শের নিঃশব্দের ভেতর প্রেম প্রাকৃতিক হয়ে ওঠে। তখন তারা বলে প্রৌঢ় কলাগাছের মতো মৃত্যু আসুক, প্রেম বেঁচে থাক নবীন কলাগাছের ছায়ারূপায়িত লুব্ধ গন্ধে। তখন তারা কলাগাছের জীবনচক্রের ভেতর প্রার্থিত নারীর গর্ভ সঞ্চারের আনন্দে উন্মিলিত হয়।
রাতের কী গৌরব, মেঘের গন্ধে পৃথিবীর সকল রাত তন্ময় হয়ে থাকে! গ্রামে বর্ষা নামে। বসন্ত আসে। গ্রীষ্ম আসে। গ্রামের লোকের সকল ঋতুর তীর্থে, সকল শরীরে রাত অনুসৃত হতে থাকলে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে। রাত যদি ঘুমের আশ্রয়, তাহলে গ্রামের লোকদের নিদ্রাহীনতায় পেয়ে বসলে রাতের সকল গৌরব লুপ্ত হয়। চন্দ্রাতপ রাতের অধিরূঢ় ছেড়ে তারা ভোরের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু তারা ভোরের দিগন্তে পৌঁছাতে পারে না; দেখে, দিগন্তের কোলে নীলাভ ছাই-ছাই মেঘ আর ধূসর বেগুনি হয়ে আসা আঁধার গাছগাছালি অরণ্যের দুর্ভেদ্য নিয়ে সুদূর সমান্তরাল সরল রেখা আঁকা। গৃহকুঞ্জে ঝুলে আছে অস্পষ্ট আঁধার। শস্যক্ষেতে ছড়িয়ে আছে অন্ধকার কুজ্ঝটিকা। তখন তারা বলে, রাত থাকুক রাতের গৌরব নিয়ে; রাতের আঁধারকারাগার ছিঁড়ে প্রস্ফুটিত হোক সূর্যরেখা। আঁধার হারিয়ে গেলে সূর্যের সূচনায় গ্রামের লোকেরা পুনরায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। তাদের তখন মনে পড়ে ঘণায়মান গোধূলি আঁধারে নিরুদ্দেশ বালিকা-কিশোরীর স্মৃতি। সে কি তবে প্রৌঢ় কলাগাছের মতো প্রেমের নতুন দৃশ্যকল্প রচনার জন্য মৃত্যুর ভেতর হারিয়ে গেছে? তাহলে তার মৃত হাড় কোথায়, হাড়ের ছায়া কোথায়, হাড়ের প্রণয়াকুল পিঁপড়া কোথায়? গ্রামের লোকেরা এসব জিজ্ঞাসার সমাধান না পেয়ে ধন্দে পড়ে, তাদের তখন মনে হয়, বালিকা-কিশোরীও সম্ভবত অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর মতো প্রেমের দীর্ঘ প্রতীক্ষার আঁধারে পৌরাণিক হয়ে আছে; তথাপি এমন দুশ্চিন্তার সময়ে তাদের কৌতূহল শরতের হার্মাদ-জলদস্যু বিকেল উচ্ছল ছিল। কেননা প্রেমের বাক্য উচ্চারিত হলে তার মধ্যে অজানিত কৌতুক আর কানাকানি সুপ্ত আছে অবিরাম গতি নেই, আবার যেন গতির ঝঞ্ঝা আছে, অনর্গল বদলাচ্ছে; এই গোধূলিমেঘ, এই টুকরো টুকরো রাতে চিহ্ন রূপায়িত রঙিন, আবার ফ্যাকাশে, কখনো রুগণ বাঘের মতো ঝিমঝিম। গ্রামের লোকেরা এই, তবে কানাকানির কৌতুক ভালোবাসে এবং তারা একদিন এই কৌতুক ভুলে যায়। কিন্তু কৌতুক গৃহে গৃহে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশী গৃহের রমণীরা প্রেমের মুখরোচক কৌতুকে মশগুল থাকে। নিখাদ শুদ্ধ প্রেমের জ্ঞান লাভ হলে, এখন, হ্রস্ব এক অনুচ্ছেদ চরিতামৃতে তার পরিসমাপ্তি হতো না। এ যেহেতু কৌতুক সুপ্ত, তথায় রাতে কোথায়? কেবল কৌতুকের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। পদ্মজঙ্গলের নিচে নিচে সবুজকালো পানির চোরা রাতে হিলহিলে সাপের পিঠে এমত কানাকানি পিছলে গেলে একদিন রমণীরা প্রেমের সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে শেখে এবং নিরুদ্দেশ বালিকা-কিশোরীর জন্য তাদের মায়া হয়। গার্হস্থ্য রমণীদের তখন মনে হয়, তবে কি গ্রামের লোকেরা জানে বালিকা-কিশোরীর নিরুদ্দেশের কারণ! কেবল তাদেরই কি জানা ছিল বালিকা-কিশোরীর আঁধার জঙ্ঘায় শোকাতুর সংগীতের অস্ফুট ধ্বনিচূর্ণ কীভাবে কলাগাছের পরিপুষ্ট কাণ্ডের ভেতর নিঃশব্দে মর্মরিত ছিল! রমণীরা বালিকা-কিশোরীর নিরুদ্দেশের গোপন শোক অনুভব করে; গোধূলি প্রস্থানের নিকষ আঁধারের নৈসর্গিক দৃশ্যকল্পের ভেতর রমণীদের সবল কান্তিময় মাতৃ কলাগাছের মতো স্ফিত হৃদয়ে মাতৃত্বের নিঃশব্দ কান্না ঝিনুক হয়ে ছিল। তখন, এমন কান্নার প্রতিচ্ছায়া বয়ে যাওয়া প্রবল বর্ষাদিনে, গ্রামের রমণী আর পুরুষদের শোক বিষণ্ণতা আর নীরব হাহাকারের ভেতর যুবকদের হৃদয়ে আঁধার শূন্যতার রক্তিমতাবিদ্ধ পদ্মকাঁটা গজাতে থাকে।
পদ্মকাঁটার মড়ক শুরু হলে গ্রামের যুবকদের প্রেমের মৃত্যু ঘটে। তাদের হৃদয়ে প্রবহমান উষ্ণতা নিদারুণ টঙ্কারে ফেটে পড়লে তারা গুটিসুটি কুকুরের খোপ হতে ঝুলন্ত জিহ্বার উৎকট যৌন-ইচ্ছার কৃতদাসে পরিণত হয়। যুবকদের অনিচ্ছুক অবদমনের ঝিম থেকে বেরিয়ে আসতে গ্রামের প্রবীণরা তাদের প্রেমের উষ্ণতা ভরা ভাত খেতে বলে পঞ্চমীর জ্যোৎস্নামথিত নবীন পদ্মপাতায়, তবে তারা মুক্ত হোক পদ্মকাঁটার মড়ক। কিন্তু কোথায় পাবে তারা এমন জ্যোৎস্নামথিত পদ্মপাতা! তারা দেখে অনেক অনেক কাল অতীতে, যখন তাদের প্রেমের মৃত্যু শুকিয়ে গেছে পদ্মবিল। অনেক অনেক কাল অতীত গ্রামে গোধূলিছায়ায় চাঁদ ডুবে গেছে অবিরাম আঁধারে পড়ে আছে পদ্মের অপভ্রংশ।
কিন্তু গ্রামের আঁধার অপসারিত হয় না, অনন্ত রাষ্ট্রীয় আঁধারের বিবমিষা জং ধরা প্রাচীন তরবারির মতো ঝুলতে থাকে। তাহলে তাদের ভোর কোথায়? গ্রামের লোকেরা দেখে তাদের গৃহের জানালা এবং বারান্দার পাশে বেড়ে ওঠা কলাগাছের শীতল বাতাস আর সবুজ গন্ধের শর্করার ভেতর গৃহের অভ্যন্তরে থোকা থোকা অন্ধকার জমে আছে অনড়, আরূঢ়, অবলীঢ়। কান্তিময় কলাগাছের কাণ্ড আর কচি পাতার অধিরূঢ় ছেড়ে ছড়িয়ে আছে এসব ছায়ান্ধকার তারা বিহ্বল বোধ করে, নিরাপত্তাহীনতায় ভয় পেয়ে যায় এসব আঁধার তাদের গৃহ, শস্যক্ষেত এবং শরীরের ভেতর রাজত্ব বিস্তার করলে তখন লোকেরা জানালায় মুখ বাড়িয়ে থাকা যৌবনবতী কলাগাছ কেটে ফেলে।
কলাগাছের শিশু পাতায় লুকানো চৈত্রের রোদে ঝলমল করে বৃক্ষদৃশ্যাবলি, কিন্তু গৃহ এবং তাদের রক্তের ভেতর প্রবহমান আঁধার অপসারিত না হলে তাদের পুনঃপুন নিরাপত্তার অভাবের ভেতর কর্তিত কলাগাছগুলো শুকিয়ে যায়, এবং গ্রামের লোকেরা অবশ্যম্ভাবী বিস্ময়ে লক্ষ করে বালিকা-কিশোরী নিরুদ্দেশের গোপন শোক নিঃশব্দে তাদের হৃদয় থেকে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে গ্রামের সকল কলাগাছে। অথবা, শিশু শিশু কলাপাতা কেটে ফেলা কলাগাছের মৃত্যুশোকে অনৈসর্গিক জরাজীর্ণ সবুজতা তাদের শরীরের লাবণ্য নিংড়ে হৃদয়বিদারক। তখন, এইরূপে, কেটে ফেলা কলাগাছের মৃত্যুশোক সকল কলাগাছের নীল আত্মায় সঞ্চারিত হতে থাকলে গ্রামের রাত এবং গোধূলির ভেতর, দিন এবং স্মৃতির ভেতর, ছায়া এবং প্রতীক্ষার ভেতর কলাগাছের মৃত্যু অবধারিত হয়ে ওঠে।
গ্রামের সকল উঠোনে, সকল শস্যক্ষেতে কলাগাছের লাশের ভেতর তারা দেখে, রাশি রাশি পিঁপড়া মুখে মুখে কিছু একটা বহন করে চলেছে। গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে না, অথবা প্রথমত, তারা লক্ষই করেনি পিঁপড়াদের মুখে কী। অজস্র পিঁপড়ার মিছিল দেখে তারা ভয় পায়; তারা ভাবে পিঁপড়ার দল হয়তো তাদের ঘুম কেটে দেবে কুট কুট, তাদের শ্রবণ কেটে দেবে কুটুস, তাদের দৃশ্য কেটে দেবে কুট কুট, তাদের যৌন ইচ্ছা কেটে দেবে কুটুস। সহসা তাদের ভয় অপনোদিত হয়, তারা দেখে তাদের ঘুম অথবা শ্রবণ অথবা দৃশ্য অথবা যৌন ইচ্ছার ভেতর নয়, পিঁপড়ার দল শোকার্ত অভিনিবেশে ছড়ানো ছিটানো কলাগাছের খঞ্জলাশের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে। পিঁপড়াদের গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চিত শৃঙ্খলা এবং নিঃশব্দ মিছিল গ্রামের প্রেমশূন্য, নিরাপত্তাহীন, নিদ্রাবঞ্চিত লোকদের মাঝে কৌতূহল সঞ্চার করে। তারা শোক ও বিষাদে আচ্ছন্ন পিঁপড়ার মিছিল লক্ষ করলে দেখে, দুই দল পিঁপড়ার পারস্পরিক বিপরীত যাত্রা। একদল পিঁপড়া চলেছে মৃত কলাগাছের ছিন্ন শিকড়ের প্রত্ন-আঁধারে, আর তারা গভীর প্রণয়ে মুখে মুখে নিয়ে যাচ্ছে বিষণ্ণ ধূসর বর্ণের টুকরো কিছু। বিপরীত যাত্রার পিঁপড়ারা শূন্য মুখে ছুটছে, উত্তেজনায় চঞ্চল। পিঁপড়াদের মিছিল অনুসরণ করলে বিপরীত যাত্রার পিঁপড়ার দল গ্রামের লোকদের নিয়ে যায় অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর বিধ্বস্ত ও স্তব্ধ বাড়ির প্রাঙ্গণে। তারা দেখে জরাজীর্ণ একমাত্র ঘরের মেঝের ওপর শায়িত অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর শীর্ণ হাড়। পিঁপড়ার দল গভীর কোমলতায় আচ্ছন্ন হাড়ে লেগে থাকা কালো বিষণ্ণ অবশিষ্ট চামড়া পরম মমতায় মুখে মুখে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
এই দৃশ্যে গ্রামের লোকেরা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। শোক এবং পিঁপড়াদের গভীর প্রণয়ের ভেতর তারা দেখে, মৃত হাড়ের নিচে একটি প্রতীক্ষার চন্দ্রছায়া অশ্রুময়। তখন তারা আবিষ্কার করে অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর মৃত্যুর ক্ষণ। প্রণয়াকুল পিঁপড়াদের মৃত চামড়া সংরক্ষণের দিন-রাতের হিসাবে তারা বলে, তাদের গৃহের জানালায় মুখ বাড়িয়ে থাকা যৌবনবতী কলাগাছ কেটে ফেলার ক্ষণে অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
অথবা তারা, এখন, এই শোকার্ত প্রতীক্ষার ভেতর, গ্রামের লোকেরা, দিন-রাতের হিসাব ভুল করে; তারা ভাবে অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর মৃত্যু হয়েছিল বালিকা-কিশোরী নিরুদ্দেশ হওয়ার গোধূলিগুঞ্জনে। গ্রামের লোকেরা বলে, যৌবনবতী কলাগাছ কর্তনের সময় লতাগুল্মের সবুজ আঁধারে লুকানো প্রজাপতির ডানায় গুঞ্জন করে ওঠা মৃদু সংগীতের ভেতর বালিকা-কিশোরী গোধূলি হয়ে যায়। আর বালিকা-কিশোরীকে সন্ধানের উত্তেজনা ও দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল লোকেরা লক্ষ করেনি গোধূলিপ্রস্তুতির নীরব বায়ুপ্রবাহের ভেতর মৃত্যুর নিঃশব্দ পদসঞ্চার। অথবা তাদের শ্রবণ নিবেদিত ছিল কেবল দূর্বাঘাসের কোমল ছায়ায়, যেখানে হয়তো ফুটে ছিল বালিকা-কিশোরীর পদ্মিনী পদচিহ্ন। কিন্তু এসব সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে এলে তারা ভাবে, না কি অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর জীবনের সংহারপিপাসু মৃত্যুর অপ্রতিরোধ্য রক্তপদ্ম কিলবিল করে উঠলে বালিকা-কিশোরী অনন্ত প্রতীক্ষার স্মৃতিবিধুরতাময় সংগীতের ভেতর হারিয়ে যায়। এরূপ, এমত, বিভ্রম গ্রামের লোকদের বিহ্বল করে এবং মৃত্যু অথবা নিরুদ্দেশ, অসম বয়সী এই দুই নারীর জীবনের সম্পর্কহীনতা এবং সময়শূন্যতার ভেতর তারা দ্বিধা ও শোকের সংক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে চৈত্র পূর্ণিমার নিদারুণ জ্বলজ্বলে দ্যুতি ঠিকরে পড়া গ্রাসিত জ্যোৎস্নায় অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর স্বপ্নাচ্ছন্ন শীর্ণ হাড়গুলো রোদনময় হাতে তুলে নেয়।
কিন্তু এই আয়ুষ্মতী হাড় তারা কোথায় সমাহিত করবে? এমন সমাধিক্ষেত্র কোথায়? চারদিক মৃত কলাগাছের হলোকাস্ট পেরিয়ে তারা গমন করে বিজন জ্যোৎস্নায়, জলশূন্য বালিময় ধূসর বিলের তলদেশে। তারা দেখে, শুষ্ক আর ঝকঝক দৃষ্টিধাঁধানো গোলাকার বিলের তলদেশে শুয়ে আছে চাঁদ। বিলের চাঁদ তাদের শোক হয়তো প্রশমিত করে, অথবা তাদের শরীর ও আত্মার নীল পদাবলির ভেতর চন্দ্রছায়া অশ্রুময়। তখন তারা মানুষ এবং নিসর্গের অন্তর্গত সম্পর্কের স্বপ্ন রূপায়ণ ও রহস্যের ভেতর একখন্ড সাদা কাপড়ে জড়ানো হাড়গুলো চাঁদের বুকে রোপন করে।
চৈত্র পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় গ্রামের লোকেরা চাঁদের শরীরে পা ফেলে ফেলে ফিরে আসে ভোরের দিগন্তে। চাঁদ মরে যায়। মৃত চাঁদের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখা সূর্যের আলোয় তারা দেখে, মৃত চাঁদের বুকে রোপিত হাড় থেকে বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ। তখন তাদের বিস্ময় যে, কতদিন কতকাল এই বিল শুকিয়ে পড়ে ছিল বিকট শূন্য গহ্বর, কতদিন কতকাল জলের নিমগ্ন নাচ দেখেনি তারা পদ্মময়ূরের বর্ণালি পেখম নেই, কতদিন কতকাল তারা শোনেনি মাছের লাফ পাখিদের গান থেমে গেছে। গ্রামের লোকদের এই বিস্ময়ের ভেতর আঁধারের যবনিকা অপনোদনের সঙ্গে ক্রমেই মৃত চাঁদের গর্ভকোষ ফুঁড়ে বাহিত পানির উদ্দাম উচ্ছল বৃত্ত-পরিসর বড় হতে থাকে। আর বৃত্তের কেন্দ্রে রোপিত অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর স্বপ্নাচ্ছন্ন বাহুর হিউমেরাস হাড় পদ্মডাঁটায় রূপায়িত হয়, কারপাল হাড়গুলো পদ্মকুঁড়ি, করোটি আর স্ক্যাপুলা সবুজ পাতায় মাধুর্যময় দৃশ্যের দারুণ ছবি মুদ্রিত হলে তখন সূর্যের লাল আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। পঞ্জরাস্থি আর কশেরুকাগুলো রূপময় সোনালি মাছে রূপান্তরিত হয়, আর রাজকুমারী সোনালি মাছ পদ্মের ছায়াপ্রতিচ্ছায়ায় জড়িয়ে থাকে অতল জলের দিনে। এই দৃশ্য উপভোগের জন্য গ্রামের সকল নারী-পুরুষ-যুবক-শিশু জড় হয় পদ্মবিলের চারপাশে, এবং তখন তাদের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে প্রৌঢ়া অনূঢ়া নারীর মায়াবী করুণ মুখ, যে নারীকে তারা দেখতে পেয়েছিল আয়ুষ্মতী চিরপ্রৌঢ়ত্বের সহিষ্ণুতার ভেতর লাবণ্যময়, যে নারী প্রেমের দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভেতর ছিল আঁধার প্রাকৃতিক। আর তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল গৃহের জানালায় মুখ বাড়িয়ে থাকা যৌবনবতী কলাগাছ কর্তনের ক্ষণে, অথবা বালিকা-কিশোরী নিরুদ্দেশের গোধূলিছায়াচিহ্নে, অথবা প্রজাপতির ডানায় নেচে ওঠা উদ্বাস্তু সংগীতের ভেতর। এইসব স্মৃতিদৃশ্যাবলির ভেতর নিমগ্ন ও নিমজ্জিত আচ্ছন্নতা ফিকে হয়ে এলে গ্রামের লোকেরা দেখে, বিলজুড়ে নীলাভ্র জলের পটভূমির ওপর ফুটে আছে নারীর নীরব মুখের মতো অগণিত অপরূপ পদ্মফুল।
পঞ্চমী চাঁদের আলোয় গ্রামের যুবকরা বিলে নামে। বিলজুড়ে পদ্মের দুর্ভেদ্য জঙ্গল। লতায়পাতায় জেগে ওঠা সবুজ চর পেরিয়ে যুবকরা জলের নীলাভ্র চাঁদে পৌঁছালে জ্যোৎস্নায় দেখে নিঃসঙ্গ পদ্মপাতার ছায়াতরঙ্গে একটি সোনালি মাছ, লাজুক সৌন্দর্যে নিঝুম। পদ্মকুঞ্জে চন্দ্রালি আঁধার নেই, কেবলই অধোনীল এলোমেলো ছায়ার চিত্রকল্প নিশ্চুপ, লাল ছায়াতরঙ্গের সর্পিল রেখায় তার সোনালি শরীর ঝিলমিল করে। তার সোনালি আঁশে নীল জলের দৃশ্যকল্প, নীলের ভেতর চিরন্তন খঞ্জমেঘের নাচ, নীল নাচের অজস্র ফেনাতরঙ্গে দিগন্তের ঐন্দ্রজালছিন্ন হৃদয় দ্রবীভূত। তন্দ্রাজড়িত ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্নায় ম্লান কুপির আলোয় রাজকুমারী সোনালি মাছের অপরূপ লীলালুব্ধ বর্ণচ্ছটায় যুবকেরা স্তব্ধ। তারা ভুলে যায় রাতের ঘূর্ণিবাতাসের টঙ্কার আর জ্যোৎস্নামথিত পদ্মপাতা শিকারের অভিপ্রায়। কুপির ক্ষীণ আলোয় অথবা পঞ্চমী চাঁদের নির্লিপ্ত স্পন্দনে যুবকদের ছায়াদৃশ্য রোমাঞ্চিত হয় রাজকুমারী মাছের চোখে। যুবকদের স্তব্ধতার অবসরে সোনালি মাছ জলকুঞ্জের নীল ঘূর্ণি তোলপাড় তুলে পাখনার রুপালি কাঁটা তীক্ষ করে; যেন আক্রোশে রাগী, চিরে দেবে জলদগম্ভীর মেঘের নীলাঞ্জন কন্দর। ভয়ঙ্কর ছটফট চঞ্চল দৃশ্য পদ্মের প্রতিচ্ছায়ায় জড়িয়ে পড়ে গহিন জলের রাতে। এমন, এরূপ, এইখানেই কী সৌন্দর্য প্রমিতি নিয়ে রঙের বাঁকে বাঁকে পদ্মছায়ায় সে বসে থাকে নিঃশব্দে! মুহূর্তমাত্র দেখা দিয়ে সোনালি মাছ হারিয়ে গেলে যুবকরা জলের নীলাভ্র পটভূমির বিপরীতে ফিকে হলুদ নক্ষত্রের আলোয় ছুটতে থাকে। তারা দেখে তাদের চারদিকে লাল পদ্মের অগ্নিপাখা দুলছে। তারা হারিয়ে যাওয়া সোনালি মাছ এবং অগ্নিপদ্মের দৃশ্যকল্পের রূপরেখার মাঝে দোদুল্যমান। তখন তাদের মনে হয়, তবে ওই সোনালি তরল তরঙ্গের ঝিলমিল কোনো মাছ নয়? তাদের মনে পড়ে অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারীর অস্থি থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মপুষ্প আর সোনালি মাছের উন্মিলিত স্মৃতি, যে নারীর মৃত্যু মিথ হয়ে উঠেছিল বালিকা-কিশোরী নিরুদ্দেশের গোধূলিচিহ্নিত ছায়াগন্ধে, অথবা কর্তিত যৌবনবতী কলাগাছের অমলিন শোকের প্রত্নসূচির ভেতর, অথবা গৃহহারা উদ্বাস্তু প্রজাপতিদের বিষণ্ণগানে। আচমকা এই স্মৃতির উন্মোচনে যুবকেরা ভয় পায় দূরে দূরে জ্বলা সামরিক পাহাদারের মতো অগ্নিপদ্ম আর হারানো মাছের সোনালি ঝিলমিল আলেয়া তাদের সর্বগ্রাসী দিকচিহ্নহীনআঁধার সুড়ঙ্গে টেনে নিয়ে চলেছে। তাদের ভয় যে, এসব অগ্নিপদ্ম ও সোনালি মাছ অনূঢ়া প্রৌঢ়া নারী অথবা বালিকা-কিশোরীর প্রতীক্ষিত প্রেমের দগ্ধ হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাসে তাদের তাড়া করে।
কত কত রাত তারা যায় পঞ্চমীর জ্যোৎস্না মথিত পদ্মবিলে; যায় পদ্মপাতা শিকারে, অথবা যায় সোনালি মাছ শিকারে; অথবা তাদের মনে হয়, তারা যায় জ্যোৎস্না শিকারে। তখন পঞ্চমীর ছায়ান্ধকারে বিল আর ধূসর দিগন্ত জুড়ে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, কখনো কখনো ধূলিঘূর্ণির জলক্ষুব্ধ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে শিকারিদের শরীরে, তারা সোনালি মাছের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটে, দ্রুত সঞ্চরণশীল সোনালি ছায়ায় হেঁটে হেঁটে তাদের ভয় দূর হয়। এবং তারা সোনালি মাছের প্রেমে পড়লে নির্বাক বিস্ময়ে তারা নিশ্চুপ। তারা গভীর আচ্ছন্ন ঘোরের ভেতর ফিরে আসে এবং গ্রামের লোকদের বলে যে, নশ্বর নক্ষত্রের মৃদু আলোয় পদ্মজলের নীলাঞ্জন থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট কুয়াশায় সোনালি মাছ তাদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া নিঃসঙ্গ শিকারি যুবককে সুর শুনিয়েছে। পাখির স্খলিত পদবিক্ষেপে ধ্বনিময় ছিল সোনালি মাছের সংগীত; কণ্ঠস্বরে ছিল বিলের গোলাকার জলের মুকুরে নভোমণ্ডলের বালিকা-কিশোরী চিত্রকল্প, অথবা ছিল উদ্বাস্তু প্রজাপতিদের শোকার্ত ওড়াউড়ি। চন্দ্রালোকিত জলের গহিনে স্পর্শ ও অনুভূতিময় শ্যাওলার সবুজ আত্মার ধূসরতায় বিমূঢ় ঝিলমিল তরঙ্গে সোনালি মাছ একাকী শিকারি যুবককে নিঃশব্দ ইশারায় টেনে নিয়ে যায় জলের অতল আঁধারে, অথবা একাকী যুবক নিরুদ্দেশ হয় জলতরঙ্গের ঘূর্ণিফাঁদে। অথবা শিকারি যুবকরা বলে, কণ্টকিত পদ্মমৃণালে জড়ানো জলপাই-সবুজ সাপের নিঃশব্দে সে পরিণত হয় রক্তমাংসের দলায়, পদ্মকাঁটা দগ্ধ জলসত্রে ভেসে উঠেছিল প্রজাপতির রক্তবুদবুদ।
গ্রামের লোকদের কাছে, তখন, যুবকের ফিরে না আসার শোক দুর্নিবার হয়ে ওঠে। শরীর শিউরানো শঙ্খিল ভয়ের জলজ ঘিনঘিনে অনুভূতি তাদের নিদ্রার ভেতর ঢুকে পড়ে। তখন শরীরে পদ্মকাঁটার কুটকুট নিয়ে যুবকরা পুনরায় পঞ্চমী চন্দ্রাতপে এগিয়ে যায় ধুঁধুঁ ধূসরতাপ্রণিত ছায়াদিগন্তের দিকে। তারা দেখে দিগন্তগ্রাসী চরাচরপ্লাবী বিশাল বিল বিসর্পিল ভয়ের দগদগে উল্কি দাগানো তরঙ্গে জ্বলছে। যুবকরা টেটা হাতে নামে বিলের চন্দ্রালোকে। জলতরঙ্গে চাঁদ ভেঙে গেলে যুবকরা ফালি ফালি চাঁদের ভেতর রাজকুমারী সোনালি মাছের উরুসন্ধি লাফাতে দেখে। মাছের লাফে চাঁদ ভেঙে গেলে কেঁপে ওঠে পদ্মপাতার জঙ্গল। কাঁপে, যুবকদের হৃদয়ে যেটুকু যবনিকা ছিল, বালিকা-কিশোরীর বিকীর্ণ রুপালি কৈশোরের প্রেম সে কি এখন জলের অপভ্রংশ! না কি চাঁদের! অথবা সোনালি মাছের অপরূপ! যুবকরা তখন চিন্তার সকল ভঙ্গি আর রক্তের উন্মাদে টেটা হাতে ছুটতে থাকে দ্রুত সঞ্চরণশীল মাছের নৈঃশব্দ্যের দিকে, পঞ্চমী চন্দ্রালির ছায়ামাখা পদ্মপাতা শিকারে। ভাঙা চাঁদের চিত্রিত এলোমেলো ছায়াতরঙ্গে ঘৃণা এবং সাহসের উত্তেজনায় চঞ্চল মাছ গভীর শ্যাওলা আর নীলাভ্র জল তোলপাড় করে। যুবকরা রাজকুমারী মাছের লাফ লক্ষ্য করে টেটা ছুড়ে মারে তবে তারা শিকার করুক নবীন পদ্মপাতা। কিন্তু চাঁদ ভেঙে গেলে তারা সকল পদ্মপাতা হারিয়ে ফেলে। মাছের কণ্টকিত লেজের ভয়ঙ্কর ধাক্কায় প্রবল ঢেউ ছড়িয়ে পড়লে যুবকরা শরীরে পদ্মকাঁটার সামরিক কুটকুট নিয়ে হারিয়ে যায় ভাঙা চাঁদের অপরূপ আঁধার শূন্যতায়।
রাষ্ট্র এবং গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া ভাঙা চাঁদের আঁধার সুড়ঙ্গে, তখন গ্রামের লোকেরা আর আলোহীনতার ভেতর যেতে পারে না। অথবা আঁধারের প্রতীক্ষার ভেতর সুপ্ত একখণ্ড ছায়ার কাছে তারা হারানো যুবকদের সন্ধান করে, এবং তারা নিরাপত্তার অভাবের ভেতর মৃত কলাগাছের স্মৃতি নিয়ে নিদ্রা ভুলে যায়।