মুক্তধারার ২২তম বাংলা উৎসব ও প্রসঙ্গকথা

হুমায়ূন আহমেদ উন্নত চিকিৎসার জন্য জীবনের শেষ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন নিউইয়র্কে। তখন ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝলমলে রোদ’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন তিনি। সত্যিই আমেরিকার মেঘহীন আকাশ আর ঝলমলে রোদের ভেতর অন্যরকম একটা ভালোলাগার ব্যাপার থাকে, কিন্তু ২০১৩ সালের ২৪ মে ছিল একেবারেই বিপরীত দৃশ্য।
সেখানকার গ্রীষ্মের অন্যতম অনুষঙ্গ বৃষ্টি আর বাতাস জাঁকিয়ে বসেছিল প্রকৃতিতে। কিন্তু এই প্রাকৃতিক বৈরিতা উপেক্ষা করেই অসংখ্য বাঙালি জড়ো হয়েছিলেন নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায়। বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেকেই এসেছিলেন সেখানে। উপলক্ষ আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা। এটি ছিল মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত ২২তম বাংলা উৎসব। মুক্তধারার আমন্ত্রণে এই উৎসবে আমারও অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। তবে একেবারেই ব্যতিক্রম একটি বিষয় নিয়ে। উৎসবে স্থান পেয়েছিল আমার ২৫টি দুর্লভ ফুলের ছবি নিয়ে বাংলাদেশের ফুল শীর্ষক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। মুক্তধারা প্রতিবছরই উৎসবে এমন কিছু ব্যতিক্রম আয়োজন রাখে। যদিও প্রদর্শনীর জন্য ছবি বাছাই, বাঁধাই, প্যাকিংসহ পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিল কষ্টসাধ্য। কিন্তু তুমুল উৎসাহের কাছে এই কষ্ট কোনো বাধা হতে পারেনি।
উৎসবের প্রথম দিন বিকেলে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এম আবদুল মোমেন, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক প্রমুখ। এই গুণীজনদের উপস্থিতিতে প্রদর্শনীটি বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তাঁরা এক মুহূর্তের জন্য ফিরে যান দেশের শ্যামল প্রকৃতিতে। কারণ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ফুলের ছবিগুলোয় দেশের পৌষ্পিক ঐশ্বর্যই নানাভাবে ফুটে ওঠে। প্রদর্শনীতে আসা প্রবাসীরাও কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটান। ছবি দেখে অনেকেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, শৈশবের কথা ভাবেন, ফেলে আসা সেই সব বর্ণাঢ্য ফুলগুলো, আহারে! এমন আক্ষেপ অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা গেছে। প্রদর্শনী দেখতে আসা এমনি এক দম্পতির অনুভবে ফুটে উঠেছে দারুণ এক ভালোলাগার গল্প।
লেখক আবু রায়হান এবং জাকিয়া আক্তার জলি দম্পতি দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকেন। তাঁদের ভালোবাসার ফুল সোনালু বা সোনাইল। শৈশবে গাছতলার ধুলোমাখা পাপড়িগুলো তুলে মালা বানাতেন। এই দম্পতি প্রতিদিনই একবার এসে ছবিগুলো দেখতেন। প্রতিদিন এমন আরো অনেকেই এসেছেন নান্দনিক এসব ফুলের সৌরভ নিতে। ৩ দিনের এ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের শ্যামল প্রকৃতির যে সব ফুলের ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে তার মধ্যে কনকচাঁপা, মালতি, উদাল, জারুল, সোনালু, হিজল, অপরাজিতা, কাঁঠালিচাঁপা, শালুক, চাঁদমালা, উলটচণ্ডাল, ঝুমকোলতা, নীলমণিলতা, চালতা, কুরচি, মাধবী, অশোক, নাগেশ্বর, নিশিপদ্ম ইত্যাদি অন্যতম।
অবশ্য দিনের শুরুতে বাউল গান আর ঢাকের বাদনের মধ্য দিয়ে উৎসবে আগত অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। ফিতা কেটে, প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে উৎসবের শুভ সূচনা করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এ কে এম আবদুল মোমেন, মমতাজ উদ্দীন আহমদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, লেখক হাসান ফেরদৌস, কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, জামাল উদ্দিন হোসেন, পণ্ডিত রমেশ মিশ্র, ফাহিম রেজা নূর এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস এর অধ্যাপক উইনস্টন ই. ল্যাঙ্গলি প্রমুখ। অনুষ্ঠানে অতিথিরা সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন।
উৎসবের প্রধান আকর্ষণ বইমেলায় দেশের বেশ কিছু প্রকাশনা সংস্থাও অংশগ্রহণ করে। বইপ্রেমীদের পদচারণায় সারাদিনই মুখর ছিল উৎসবস্থল। অনেকেই খ্যাতিমান লেখকদের অটোগ্রাফ নিয়েছেন। ছিল মোড়ক খোলার অনুষ্ঠানও। তিনটি সেমিনার কক্ষের নামকরণ করা হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ ও কলিম শরাফীর নামে। মিলনায়তন কক্ষের নামকরণ করা হয়েছিল রবীন্দ্র মঞ্চ। তিনদিনের এই উৎসব ও বইমেলা অসংখ্য অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় প্রাণবন্ত ছিল। সব মিলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের প্রায় ৪০টি বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের স্বাদ উপভোগ করেন উৎসবে আসা প্রবাসী বাঙালিরা। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন প্রতিবছরই এমন বর্ণাঢ্য একটি উৎসবের আয়োজন করে।
বিদেশ-বিভূঁয়ে মানুষের প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। সময়ের চাবুক সারাক্ষণ দাবড়ে বেড়ায় কর্মমুখর মানুষগুলোকে। এসব সত্ত্বেও আমেরিকায় বাঙালিদের একসময়ের নিস্তরঙ্গ জীবনে আপন সংস্কৃতিচর্চার যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল তাতে মুক্তধারার অবদান শতভাগ। আর যিনি এই কাজটির মূল উদ্যোক্তা তিনি সবার পরিচিত বিশ্বজিৎ সাহা। যিনি একজন প্রজ্ঞাবান সাংস্কৃতিককর্মী ও সংগঠক হিসেবেই সবার কাছে সুপরিচিত। এই দীর্ঘ ২৫ বছরের পথচলায়ও তিনি অক্লান্ত। এসেছে অনেক সফলতাও। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে প্রতিবছরই নিউইয়র্কে উৎসবের আসর বসে। শত শত বাঙালি ছুটে আসে সেখানে। তাতে লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কে থাকেন না? মুক্তধারার এই আয়োজন অব্যাহত থাকুক। বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ুক বাঙালি সংস্কৃতির মূলমন্ত্র।
বি. দ্র. এবারও নিউইয়র্কে তিন দিনব্যাপী মুক্তধারার বাংলা উৎসব শুরু হয়েছে গত ১৯ মে।