চিত্রকলায় বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান সংবাদ শিরোনাম ছিল এ রকম, ‘বাঙালীর সাংস্কৃতিক মুক্তি ৬-দফায় সন্নিবেশিত বাংলার মাটিতে জাতীয় একাডেমী হইবেই’। ২৪ জানুয়ারি সংগীতশিল্পীদের সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এ ঘোষণা করেন এবং কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের যথোচিত ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে চমৎকার কিছু কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, শিল্প-সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে এ দেশের দুঃখী মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা, সাহিত্য-শিল্পকে কাজে লাগাতে হবে তাদের কল্যাণে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে, লেখনীর মাধ্যমে তার মুখোশ খুলে দিতে হবে। তাঁর অভিমত ছিল, জনগণই সাহিত্য ও শিল্পের উৎস। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনোদিন কোনো মহৎ সাহিত্য বা উন্নত শিল্পকর্ম সৃষ্টি হতে পারে না। তিনি নিজে সারাজীবন জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সংগ্রাম করেছেন। এই জনগণ কেবল শহরে থাকে না, গ্রামে এক বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের বিষয়েও তিনি মনোযোগ দিতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনকার ভাষণ সচেতন শিল্পী-সাহিত্যিককে উদ্বেলিত করেছিল। আর তিনি নিজে নিবিড় জনসংযোগের মধ্য দিয়ে ‘রাজনীতির কবি’ হয়েছিলেন বলেই তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আলোড়িত হয়েছে। জীবদ্দশায় যেমন তেমনি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম ঘটনার পর তিনিই হয়ে ওঠেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রেরণার উৎস। কারণ তিনি নিজেই সেই সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি ছিলেন।
মানুষকে তিনি বড় বেশি বিশ্বাস করতেন; বড় বেশি সারল্যে মাখা ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন। একদিকে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা অন্যদিকে দেশের উন্নয়নে, মানুষের অগ্রগতির চিন্তায় উন্মুখ বঙ্গবন্ধুর দিনগুলো একেকটি কবিতা, তাঁর পুরো জীবন একেকটি উপন্যাস আর তাঁর হাসি-কান্নার মুহূর্তগুলো একেকটি ছোটগল্পের প্রেরণা। তাঁর তর্জনী উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়া, পাইপ ও চশমার অনন্য মুখচ্ছবি চিত্রকলার বিশিষ্ট উদ্দীপনা। আর তাঁর প্রকৃতি, পশুপাখি ও শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ শিশু-কিশোর সাহিত্যের উৎস। এভাবে দেখলে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব ভেতর থেকে উদ্ঘাটন করা সম্ভব।
হত্যাকাণ্ডের পর ভীতসন্ত্রস্ত খুনিরা রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তাকে মুছে ফেলার জন্য তড়িঘড়ি জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় কবরস্থ করে। ৩২ নম্বর থেকে জন্মভিটা টুঙ্গিপাড়ায় তাঁকে পাঠানো হলো ঠিকই কিন্তু জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরো বেশি প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়ে উঠলেন। তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে বাঙালির সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষের অসাম্প্রদায়িক চেতনাসহ সব সুকৃতি। এসবই প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, রং-রেখা-ভাষা-ছন্দ-সুরে। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে কেন্দ্র করে গান রচিত হয়েছে, রাজনৈতিক পোস্টারে মুদ্রিত তাঁর প্রতিকৃতি প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। একাত্তরে গণসংগীতের মূল স্তম্ভ ছিলেন তিনি।
১৫ আগস্টের পর চিত্রকলার অজস্র তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো আর মুখাবয়বের পেলবতা। ডাকটিকেট-ম্যুরাল-ভাস্কর্য এবং নাটক-চলচ্চিত্রে তাঁর উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। মূলত শিল্পী-সাহিত্যিকরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আত্মত্যাগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। মানব-মানবতা ও মুক্তির দিশারি বঙ্গবন্ধু কবি-শিল্পী-সাহিত্যিককে উৎসাহী করেছেন স্বাভাবিকভাবেই। কারণ মানবমুক্তির গান শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন। এ জন্য মহামানবের মাঝে প্রেরণা অন্বেষণ করে বাঙালি জাতি ও সাধারণ জনতাকে মুক্তির পথে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা রয়েছে সৃজনশীল স্রষ্টাদের কর্মে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য ছবি আঁকা হয়েছে। এ দেশের চিত্রশিল্পীরা ষাটের দশক থেকেই আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে চারুশিল্পীদের ভূমিকা ছিল সর্বব্যাপী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ‘নবান্ন উৎসব-১৩৭৬’ প্রদর্শনী একটি স্মরণীয় ঘটনা। একাত্তরের রণাঙ্গনের প্রেরণা জাগাতে পটুয়া আচার্য কামরুল হাসানের ব্যঙ্গচিত্র ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। এভাবে স্বদেশের প্রতি শিল্পীদের কর্মপ্রয়াসের নিদর্শন অনেক। শিল্পীরা আত্মমুখী হয়েও বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ৭ মার্চের ভাষণ দ্বারা উদ্দীপিত হয়েছিলেন। মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আপামর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শিল্পী ও সাংস্কৃতিককর্মীদের একাত্মতা স্মরণীয় হয়ে আছে। সেখানে চিত্রশিল্পী আর ভাস্কররা এগিয়ে এসেছেন বেশি। দুঃসময়ের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে করে সুসংগঠিত হয়েছেন তাঁরা; পোস্টার ডিজাইন করেছেন অজস্র।
সার্বিক অর্থে বিশাল ও মানবিক সংবেদনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গবন্ধু-কেন্দ্রিক চিত্রকলায়। জীবন ও শিল্পকে একীভূত করে রং, ক্যানভাস আর তুলির বিশাল রহস্যময় ভুবনে যাত্রা করেছেন শিল্পীরা। কোনো কোনো শিল্পী বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ভঙ্গিমাকে তুলে ধরেছেন বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। আবার কেউ কেউ তার চোখ মুখকে স্পষ্ট না করলেও ভঙ্গিমার রেখাচিত্রণে বুঝে নেওয়া যায় তিনি আমাদের জাতির জনক। শিল্পের ক্ষেত্রে তুলির টানই শৈল্পিক অন্বেষা জানান দিয়েছে বেশি। ফটোগ্রাফিক অনুষঙ্গ সেখানে কম গুরুত্ব পেয়েছে।
মূলত জাতির পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পীরা অভূতপূর্ব সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন। একদিকে দায়বদ্ধতা অন্যদিকে প্রতিবাদী আচরণ প্রকাশ পেয়েছে শিল্পকর্মের ভেতর দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। এ ঘটনা শিল্পীদের বিবেককে দংশন করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত হয়েছেন। আসলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্বপ্নভূমির প্রতি আমাদের প্রকাশ্য হৃদ্যতা প্রকাশের অবারিত সুযোগ করে দিয়েছেন শিল্পীরা। বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিক ও মাধ্যম, উপরন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণের চিত্রের ভেতর দিয়ে দেশ ও সমাজের প্রতি তাঁরা যে অঙ্গীকারের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তা অনন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যিকারের কাহিনী ইতিহাসের পথ ধরে অগ্রসর হয়নি। সে সময় বঙ্গবন্ধু যথার্থভাবে উপস্থাপিত না হলেও সেই তিমিরে আলোর পথের যাত্রী হয়েছেন শিল্পীরা। তাঁদের প্রচেষ্টায় সরকারি প্রচারযন্ত্রে উপেক্ষিত বঙ্গবন্ধু সাধারণ্যে উচ্চকিত হয়ে উঠেছেন।
১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার পর অবরুদ্ধ সময়পর্বে শিল্পীরা ইতিহাসের সন্ধান করেছেন, সত্যকে প্রকাশ করেছেন; সত্যের বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী; মুক্তিযুদ্ধের চিরঞ্জীব আদর্শ-চেতনা, বোধ-বিবেচনা-বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ এবং অঙ্গীকারে দীপ্ত। কারো কারো মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্র বুকে নিয়ে যুদ্ধ করার বিপুল অভিজ্ঞতা আছে যা ভয়ঙ্করভাবে প্রত্যক্ষজ্ঞানে মণ্ডিত। রণাঙ্গনে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি তাঁদের তাড়িত করেছে; সেখানে একমাত্র অবলম্বন ছিল অসীম সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং সদা অবিচলতা। এসব গুণ ছিল আঁকিয়েদের। ১৯৯৫ সালে প্রশান্ত কর্মকারের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৩০টি চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। সে সময় বিমূর্ত ছবিগুলো সমাদৃত হয়েছিল।
ফ্রান্স থেকে ‘নাইট’ উপাধি প্রাপ্ত শিল্পী এবং মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ এ রকমই একজন গুণী ব্যক্তিত্ব। এই শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়ে বঙ্গবন্ধুকে আমরা নতুন করে উপলব্ধি করতে শিখেছি। ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে ‘শাহাবুদ্দিনের তিন দশকের নির্বাচিত চিত্রকলা প্রদর্শনী’ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক ছবি ছিল। এই শিল্পীর জীবন দর্শন ও আদর্শের মূলে রয়েছে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর আন্তর্জাতিক শিল্প চেতনায় গড়ে উঠেছে তাঁর চিত্রমালা। তাঁর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে দেখা যায় সেগুলো দেশাতীত এবং কালাতীত মহিমা অর্জন করেছে। সর্বজনীন মানবমুক্তির অনন্য প্রতীক সেগুলো। তেজোদীপ্ত, দ্যুতিময়, গতিভাস্বর মানবশরীরের বিন্যাস রয়েছে সেখানে। তাঁর ছবি বিশাল, পুরুষ্ঠু তুলির টানে গড়া, পেশল, সুগঠিত দেহসৌষ্ঠব অনিন্দ্যসুন্দর ও ব্যঞ্জনাময়। চিত্রের নিপুণতা ও উদ্ভাবনাময়তা তাঁর চিত্রমালাকে স্বকীয় ও সমকালীনতার পটে স্থাপিত করেছে। রং, রেখা, আলো-ছায়া, স্পেসের ব্যবহার, অঙ্কনকৌশল ও শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টির ক্ষেত্রে উত্তরণ ঘটেছে তাঁর কলারীতি। রবিউল হুসাইন লিখেছেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকবাহিনী, আলবদর, রাজাকারদের নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুর পরিবারসহ নিহত হওয়ার অমানবিক ঘটনাবলি এদেশের শিল্পীদের জন্য একটি চিরকালের বেদনাদায়ক শিল্প উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এরই মধ্যে, সে ধারায় শাহাবুদ্দিন বেশ কিছু অবিস্মরণীয় ছবি সৃষ্টি করেছেন।’ ১৯৯৪ সালে ভারতের প্রদর্শনীতে গান্ধীর পাশে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। ঘাতকের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত প্রতিকৃতি দর্শকদের আকৃষ্ট করে পৈশাচিকতা দেখে ঘৃণা ও ক্ষোভ জন্মায়। শাহাবুদ্দিনের ‘বঙ্গবন্ধু-২’-এ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাড়িতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরবর্তী দৃশ্য উঠে এসেছে। নিজ বাড়ির দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ছেন হিমালয়সম সাহসী এই মানুষটি। তাঁর শরীর থেকে গড়িয়ে পড়ছে লাল-সবুজ রক্ত। যেন বঙ্গবন্ধুর গায়ে নয়; ঘাতকের বুলেট আঘাত করেছে বাংলাদেশকেই।
শিল্পীর আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও পরিশীলিত ক্রমান্তর চর্চায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। এ শিল্পী কখনো জয়নুলের ড্রইং শৈলী, কামরুলের রং-উচ্ছ্বলতাসহ বিদেশের শিল্পীদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ক্ষিপ্র তুলি চালনা তাঁর অনায়াসলব্ধ একটি বিষয়। প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুভক্ত মুক্ত গণতান্ত্রিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দিবসে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে দেশ-বিদেশে। সেসব ছবিতে শৈল্পিক ও ব্যক্তিক উপলব্ধির নিজস্ব আলোতে প্রচণ্ড গতিময়তা লক্ষণীয়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৭ই মার্চের ভাষণের ছবি এঁকেছেন। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত তুলির আঁচড় লক্ষণীয়। মূলত শাহাবুদ্দিনের বঙ্গবন্ধু-কেন্দ্রিক ছবিতে মনুমেন্টাল বা বিশালত্ব দৃশ্যমান। যে বিশালত্ব হিমালয় না দেখেও উপলব্ধি করেছিলেন বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। দ্রুত ব্রাশিং তাঁর ছবির গতিময়তাকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। জাতির পিতার গতিময় ব্যক্তিত্ব উঠে এসেছে তাঁর টেকনিকে। শিল্পী ‘ফ্রান্সিস বেকনের ক্ষিপ্র তুলি-চালনার কবজি-ক্ষমতা স্টাইল’ আয়ত্ত করে তিনি বিভিন্ন মুহূর্তগুলোকে তুলে ধরেছেন, জীবন্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা আছে তাঁর চিত্রকলায়। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে গতিময়তা এসেছে। রঙের ক্ষেত্রে খুব পরিমিত রঙের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে উজ্জ্বল রঙের প্রবণতা বেশি। মুখে মৃদু গোলাপি রং কিংবা শরীরের বর্ণ বোঝাতে বাদামি রঙের ব্যবহার লক্ষণীয়। এসব ক্ষেত্রে বাস্তবের কাছে থাকার প্রবণতা বেশি। মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর শায়িত মুজিবের চিত্রে বিমূর্ততার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। দক্ষ তুলির আঁচড়ে জীবন্ত ভঙ্গিমা রূপাবয়ব পেয়েছে। নিজস্ব শিল্পভাষায় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার সক্ষমতা রয়েছে শাহাবুদ্দিনের। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি কখনো কখনো একই ধাঁচে অঙ্কিত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ একীভূত বিষয়। দাউদ হায়দার ‘শাহাবুদ্দিন : শিল্পীর জন্মদিন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভুবনখ্যাত চিত্রশিল্পী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাটির সজল হাওয়ার বৈপ্লবিক প্রেরণা ধারণ করেন জীবনাদর্শে। ছড়িয়ে দেন বিশ্বময় ছবির অঙ্কনে, রক্তে-রেখায়। বলিষ্ঠ মানুষই ওর পাথেয়, চলার পথের নির্দেশক।
মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, মাদার তেরেসা, বঙ্গবন্ধু কেন জগৎময় নিত্যদিন, কেন পেশিবহুল সংগ্রামী মানুষ, কেন শ্রমজীবী মানুষের সমারোহ, কেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ, হোক তা নারী-পুরুষ বা শিশুর, পরম আত্মিকতায় নিজেকে সগোত্র করেন মানবিকতায়...।’ ‘সব প্রাণীই গতিশীল, নিজস্ব গতিময়তা।’ ‘আমরা লড়াকু, আমরা জয়ী।’ -এই জয়ই শাহাবুদ্দিনের ছবিতে, ছবির বোধে, রক্ত রেখায়। লালের প্রতি দুর্মম মোহ, আশ্চর্য এই, ছবিতে বালাই নেই খুব। বলেন, জীবনভর শুধু রক্তই দেখি, রক্তাক্ত বিশ্ব, যুদ্ধ-হত্যা, রক্তময় সময়কাল, ছবিকে কেন রক্তারক্তি করব। প্রয়োজনমতো লাল রং ব্যবহার করতে পারি হয়তো। শাহাবুদ্দিনের বোধে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং আজকের অসহায়, উদ্বেলিত পৃথিবী, মানুষ সর্বদা সচল। এই সচলতায় তার শিল্প, শিল্পের গতি, নিরলস কর্মী।’(১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ জনকণ্ঠ)
অন্যদিকে কাইয়ুম চৌধুরী খুব বেশি না হলেও কয়েকটি ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে নিজস্ব শিল্প চারিত্র্যে তুলে ধরেছেন। তিনি প্রধানত নকশাধর্মী বা ডিজাইনিক বৈশিষ্ট্যকে শিল্পকর্মে প্রয়োগ করে থাকেন; উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আঁকা ছবিতে তেল রঙের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি সজীব হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তাঁর বাঙালিয়ানা শতভাগ দৃশ্যমান। ভূদৃশ্য অথবা ফিগারেটিভ উভয় ক্ষেত্রেই এই সত্য স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুকে তিনি বিশাল বাংলার প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছেন। কখনো রূপকধর্মী বিন্যাসের আশ্রয় নিয়েছেন। সারা বাংলায় ছড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু। গ্রাম-বাংলার আবহের মধ্যে তাঁর উপস্থিতি অঙ্কন করে বড় মাপের নেতার অনন্যতাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন এ শিল্পী। শিল্পী হাশেম খান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন। তার মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে তাঁর ভাষণের অংশ যুক্ত; যা ক্যালিগ্রাফিক রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ছবির প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব ভঙ্গিমা এবং নেতৃত্বদানের মহিমা ফুটে উঠেছে। মহান নেতার চিরন্তর ভঙ্গিমা নিজস্ব রীতিতে উপস্থাপন করেছেন তিনি।
শিল্পী রফিকুন নবী প্রধানত কার্টুনিস্ট এবং ইলাস্ট্রেটর। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি অঙ্কনে সেই প্রভাব স্বাভাবিকভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। সমগ্র বাংলার চিরঞ্জীবী মুজিবকে প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর চিত্রকলায়। বঙ্গবন্ধুর অবয়বকে বাস্তবধর্মী বিন্যাসের জন্য সাদাকালোর সঙ্গে পটভূমিতে লাল-সবুজের রেখাময়তা অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে উঠেছে। বৃহৎ বাংলার প্রেক্ষাপট এবং জাতির জনকের অনুপস্থিতিতে শোকের আবহ তুলে ধরার জন্য সহজিয়া ঢঙে ছবি এঁকেছেন রফিকুন নবী।
বিমূর্ত শিল্পের অন্যতম আঁকিয়ে নাজমা আক্তার অ্যাক্রেলিক মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে অঙ্কন করেছেন এক অনবদ্য চিত্র। ক্যানভাসজুড়ে লাল রক্তের ধারা প্রবাহিত হওয়ার দৃশ্যপট অনন্য ও প্রতীকী। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিকে বিমূর্ত বা প্রতীকী বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন অনেক শিল্পীই। যেমন জনৈক শিল্পীর প্রতীকী বিন্যাস রয়েছে পুরো ক্যানভাসের ভেতর কেবল ১৫ আগস্ট লিখে উপস্থাপনের মধ্যে। আবার ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীর প্রবণতার বৈচিত্র্যও লক্ষ করা যায়। শিল্পী আবদুল মান্নান মেঘের ছবি আঁকাতে সিদ্ধহস্ত। তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন, তখন অনিবার্যভাবে ব্যাকগ্রাউন্ডে মেঘের বা আকাশের চিত্র এসেছে। প্রতিকৃতি অঙ্কনে বাস্তববাদী হলেও শিল্পীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে ফটোরিয়ালিজমকে অতিক্রম করেছেন তিনি। তাঁর তুলির টানের বৈশিষ্ট্য সত্যিই অসাধারণ। শেখ আফজাল বঙ্গবন্ধুর ভালো পোর্ট্রেট এঁকেছেন। দুলাল চন্দ্র গাইন অঙ্কনশৈলীতে হাস্যময় বঙ্গবন্ধুকে রক্তিম সূর্য, লাল-সবুজের বিন্যাসে বিভিন্ন রঙের ব্যবহারে তুলে ধরেছেন। জাতির পিতার ছবিতে দেশকে তুলে ধরতে পতাকার রং ব্যবহার করেছেন অধিকাংশ শিল্পী। মূলত নীলাকাশ বা সাদা মেঘ, মাটির রং, বাংলার রূপ, পতাকার লাল-সবুজ চলে আসে জাতির পিতাকে অঙ্কন করার সময়। এভাবে খ্যাতিমান শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর অসংখ্য ছবি এঁকেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পোস্টার, কার্টুন ও চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর গুরুত্ব ও আয়োজন বিশাল। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের চিত্রপ্রদর্শনীর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রতীক’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমিতে ২০১২ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত। ১৩ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীতে পোর্ট্রেট শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো চিত্র ঠাঁই পায়। পেপার এবং ক্যানভাসে ৪০টি শিল্পকর্মে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপস্থাপনা ছিল তাৎপর্যবহ। ছবিগুলোতে বঙ্গবন্ধুর মুখাবয়বের দৃঢ়তা এবং সাহসী অভিব্যক্তি চিত্রিত হয়েছে। শিল্পী বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির গভীরতা ও চিন্তার গাম্ভীর্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিছু ছবি আছে যাতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন মুহূর্তের স্মরণীয় প্রকাশভঙ্গি ও বিরল চাহনি অঙ্কিত হয়েছে। কিছু স্কেচে কিছুটা বাস্তববাদ ও অনুপুঙ্খ মুখাবয়ব চিত্রিত হয়েছে। মূলত প্রতিকৃতি অঙ্কনে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে শাহজাহান আহমেদ বিকাশের। ছবিগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভঙ্গিমা দেখা যায়। অবয়বকে তুলে ধরার জন্য অল্প রং ব্যবহার করেন তিনি। বিভিন্ন মুহূর্তকে ফুটিয়ে তুলতে বাস্তবধর্মী রীতির প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রবল। প্রদর্শনীর ৪০টি ছবির ১২টি ড্রয়িং, চারটি অ্যাক্রেলিক এবং বাকিগুলো তেলরঙের। রঙের মধ্য দিয়ে এ শিল্পী বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও মনোজগতকে চিত্রায়ণ করেছেন। ইতিহাস, সময়, সমাজের পটভূমিতে অবয়ব দিয়েছেন। তাঁর ছবি দেখে ব্যক্তিত্ব বা মনোভাব ও চোখের ভাষা পড়া যায়। মানুষের মাঝে মহান নেতার মুখাবয়ব, তাঁর সারল্যে মাখা চাহনিকে অঙ্কন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অখণ্ড এই চেতনার বিন্যাস লক্ষণীয়। জাতির পিতার বিশালত্ব, ভাষণ, তাঁর স্বপ্ন উদ্দীপিত করেছে এ শিল্পীকে। তাঁর চিত্রে মৃত্যুর করুণ রূপ কিংবা বুলেটবিদ্ধ নিহত জাতির পিতা অনুপস্থিত বরং মহান নেতা এখানে জীবন্ত, সরব। মূলত তিনি একটি সময়কে ধারণ করেছেন। স্মৃতিকাতরতার পরিবর্তে তুলে ধরেছেন বাঙালির গৌরবজনক অধ্যায়। তামাটে জাতির ঐতিহ্য আর নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম। শিল্পীর নিজের কথায়— ‘বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সমগ্র ইতিহাস তথা বাঙালির সংগ্রাম, আবেগ ও অনুভূতির পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে। একজন আঁকিয়ে হিসেবে এই বিষয়গুলো খুঁজে পেয়েছি এই মহানায়কের মুখচ্ছবিতে।’
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের আলোকচিত্র, পেইটিং ও স্মারক নিদর্শনের প্রদর্শনীর আয়োজন কয়েক বছর ধরে হয়ে আসছে। ২০১৪ সালের ১৫-২৪ আগস্ট পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা কর্তৃক জাদুঘরকে দেওয়া ৪৯টি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক নিদর্শন। তার ভেতর উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৩৪টি মানপত্রের শৈল্পিক প্রদর্শনী। ইতিহাসের উপকরণ এবং শিল্প হয়ে ওঠা মানপত্রের ভেতর কাগজে নিজের রক্ত দিয়ে লেখাটির গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের তরুণ যক্ষ্মা স্বাস্থ্য পরিদর্শক হারাধন মুখার্জির ১০-১-১৯৭২ তারিখে লেখা মানপত্রটি সম্পর্কে সেখানকার ডা. দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুকে লিখেছেন, ‘আমার সংগ্রামী অভিনন্দন গ্রহণ করুন এবং এই তরুণের রক্ত দিয়া লেখা অভিনন্দনপত্র গ্রহণ করে আমাকে এবং আমাদের সমস্ত কর্মচারী ভাইকে অনুগ্রহ করুন।’ (১০/২/১৯৭২) সেখানে ১৫টি চিত্রকলার প্রদর্শনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— কাইয়ুম চৌধুরীর ‘প্রকৃতি ও বঙ্গবন্ধু’ আর শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার কর্তৃক ক্যানভাসে তেলরং আঁকা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।
হাশেম খান কাগজে মিশ্র মাধ্যম ব্যবহার করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের ছবিতে। কাগজে চারকোলে আঁকা শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের চিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ। কাগজে অ্যাক্রেলিকের কাজে জনকের মুখচ্ছবি উন্মোচিত হয়েছে দুলাল চন্দ্র গাইনের চিত্রে। প্রদর্শিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলোতে তেলরঙের ব্যবহার বেশি। ‘ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু’ শীর্ষক কাগজে পেনসিল ব্যবহার করে একটি অনন্য অনুভূতির চিত্রণ রয়েছে শিল্পী রাকিব হাসান রঞ্জুর। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা যুবকের চিত্রটি অভিনব।
১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক এক চিত্র প্রদর্শনী হয়। নবীন-প্রবীণ ৯১ জন শিল্পীর আঁকা ছবি ছিল। শিল্পীদের কাছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু একাত্ম মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের অপর নাম শেখ মুজিব’। তাঁরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এক করে প্রাণের টানে এঁকেছেন দৃশ্যপটে। ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ওপর শিশুদের অঙ্কিত চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে দেখা যায় শিশুদের আঁকা ছবিতে বঙ্গবন্ধু কখনো ধরা দিয়েছেন তাদের বন্ধুরূপে, কখনো প্রকৃতিপ্রেমী মহামানব কিংবা শান্তির দূত হয়ে।
কিশোরদের অবচেতন মনে বঙ্গবন্ধু কখনো এসেছেন মানবতাবাদী এক মহানায়ক হয়ে। যারা ছবি এঁকেছে তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। বাবা-মা কিংবা দাদির গল্পে, হয়তো পাঠ্যপুস্তকে বা গল্পের বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারা পড়েছে, জেনেছে বাংলা-বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা। সেই গল্পকে মনের খাতায় এঁকে রেখে শিশুরা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা দৃশ্যকাব্য। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, জনসভায় তাঁর ভাষণের নানা মুহূর্ত, মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা প্রস্তুতি, রণাঙ্গনে তরুণদের বিপুল বিক্রম, স্বাধীনতার অবাক সূর্যোদয়-শিশু-কিশোরদের তুলিতে রঙের খেলায় উঠে এসেছে বাংলার ইতিহাসের নানা ঘটনাক্রম। শিশুরা এঁকেছে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ছবি, এঁকেছে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলার ছবি। শিশু চিত্রশিল্পীরা ক্যানভাসেই এঁকেছে তাদের শপথ- ‘আমরাই গড়বো স্বপ্নের সোনার বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতা ও গল্পের ওপর ভিত্তি করে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৩ নম্বর গ্যালারিতে চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয় ২০১৬ সালে। ১৪৮ জন শিল্পীর ১৫০টি চিত্রকর্মের মধ্যে ছিল শিল্পী প্রদ্যুৎ কুমার দাসের একটি ভাস্কর্যশিল্প। সেখানে মো. আলপ্তগীনের আঁকা বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি ছিল; কালো মোটা ফ্রেমের চশমা চোখে বঙ্গবন্ধুর পরিচিত চেহারা রং-রেখায় অসাধারণ। একই প্রদর্শনীতে বীরেন সোম তাঁর কোলাজ ছবিতে বলেছেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ শিল্পী সঞ্জীব দত্তের ছবির শিরোনাম ছিল, ‘বঙ্গবন্ধু ডাকো রে’। এ ছবিতে এক সাগর রক্ত পেরিয়ে উদিত সূর্যের পথ ধরে যেন হেঁটে আসছেন বঙ্গবন্ধু, আবার বাঙালিকে আহ্বান করছেন আরেক মুক্তির সংগ্রামে। ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের অপর একটি নাম’, ‘পিতা তোমার প্রত্যাবর্তন চাই’, ‘পুত অঞ্চলের প্রসন্ন আশ্রয়’, ‘তোমাকে হারাতে পারিনি এখনও হে নায়ক’, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের ছবিগুলো এঁকেছেন চিত্রশিল্পী এস রাফি, নাজির খান খোকন, জাহাঙ্গীর হোসেন, এস এম ময়েজ উদ্দিন।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিনলিপির ছবি এঁকেছেন জাহিদ মোস্তাফা, তাঁর ছবির শিরোনাম ‘তোমার ছেলেরা মরে গেছে’। ‘আমাদের কোনো পরিচয় নেই’ শিরোনামের একটি ছবিতে দেখা গেছে, গুলিবিদ্ধ কয়েকটি খুলি, পাশে পড়ে আছে বঙ্গবন্ধুর সেই চশমা, আধখোলা ডায়েরি আর দোয়াত। ১৫ অগাস্ট নিয়ে আরো এঁকেছেন শিল্পী মো. নাজমুল ইসলাম গোলদার, তাঁর ছবির শিরোনাম ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’। অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াৎ ‘অশ্রুজল’ শিরোনামের ছবিতে জানিয়েছেন শোকার্ত বাঙালির আকুতির কথা। আবহমান বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শেখ মুজিবুর রহমান একই সূত্রে গাঁথা। ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’, ‘যমুনার পথে এবার নামো সাথী’, ‘এই বাংলার আকাশ বাতাস সাগর গিরি নদী ডাকিছে তোমায় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের ছবিগুলো সে কথাই বলে।
‘শিল্পের আলোয় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রদর্শনীতে ৭ মার্চের ভাষণের উত্থিত তর্জনী, তাঁর পোশাক, চশমা, ধূমপানের পাইপ সব কিছুকেই জনপ্রিয় চিহ্ন হিসেবে জনসাধারণের কাছে হাজির করে। যা দৃশ্যশিল্পে প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রতীকী উপস্থাপন ছাড়াও আছে রংকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রক্তাক্ত দৃশ্য জনমানসে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি ইমেজে রূপ নিয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ ধারণায় হত্যার সঙ্গে রক্ত থেকে লাল বা জাতীয় পতাকার লাল, জাতীয় পতাকা থেকে সবুজ বা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা থেকে সবুজ আর মৃত্যু থেকে শোক- যা কালো রঙের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর বাস্তব দৃশ্যরূপ থেকে বিমূর্ত দৃশ্যরূপের দিকে সাধারণভাবেই শিল্পীরা অগ্রসর হয়েছেন। শিল্পী নাসিম আহমেদের ‘মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গবন্ধু’ কাজটি আলোকচিত্রের অনুকরণীয় বাস্তবধর্মী চিত্রকলা থেকে প্রতীকী চিত্রকলা নির্মাণের ধাপটিকে স্পষ্ট করে। আবার ৭ মার্চের ভাষণের বাচিক শব্দমালাকে শিল্পী এস এম মিজানুর রহমান তাঁর ‘স্বাধীনতার মৃত্যুঞ্জয়ী কবি’ কাজটিতে বিন্যস্ত করেছেন বঙ্গবন্ধুর অবয়বে। ফলে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত প্রাত্যহিক উপকরণের মতো তাঁর কর্মও সচল হয়ে উঠেছে।
২০১৫ সালে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে গ্যালারি কসমস ১৮ দিনব্যাপী আয়োজন করে এক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর। ৭৫ জন শিল্পীর রংতুলিতে ফুটে উঠেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়ে মূর্ত বঙ্গবন্ধু যেন এখনো পথ নির্দেশনা দিচ্ছেন পুরো জাতিকে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াল রাতের চিত্রের পাশাপাশি ২৫ মার্চে কালরাতসহ বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক শিল্পীদের রং-তুলিতে চিত্রিত হয়েছে। রং-তুলিতে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছবি আঁকার সময় কেউ কেউ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। চিত্রশিল্পী বীরেন সোম তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতকে। ছবিতে তিনি ওই রাতের বঙ্গবন্ধুকে তুলে এনেছেন।
২০১৫ সালে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ‘চিত্রপটে বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে ৪৪টি প্রতিকৃতি নিয়ে শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাসের একক প্রদর্শনী হয়। তাঁর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো বহুমাত্রিক প্রতিকৃতি। একটি ছবিতে আছে, বঙ্গবন্ধুর কালো ফ্রেমের চশমাটি উঠে এসেছে তাঁর বাঁ হাতের দুই আঙুলে। আর ব্যাক ব্রাশ চুলের সুদর্শন সেই মহামানব বসে আছেন নিজ আসনে। তাকিয়ে রয়েছেন আশপাশের দিকে। দৃষ্টি যেন বলে দেয় কোনো এক ভাবনায় তিনি তাড়িত। রঙের সঙ্গে মনের মিশেলে ঠিক এমনভাবেই বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছেন শিল্পী কিরীটি রঞ্জন বিশ্বাস। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক অভিব্যক্তি লক্ষ করা যায়। ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে ধরা দিয়েছে বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধু, স্মিত হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, চিন্তামগ্ন বঙ্গবন্ধু, সাক্ষাৎকার প্রদানরত বঙ্গবন্ধু কিংবা মুক্তিকামী জনতাকে উদ্দীপ্ত করা সেই মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সব ছবিতেই অভিব্যক্তির মাধুর্যে দৃশ্যমান হয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু। কিরীটি রঞ্জন অধিকাংশ প্রতিকৃতি এঁকেছেন তেলরঙের মাধ্যমে। এর মাঝে রয়েছে কিছু অ্যাক্রেলিক ও সফট প্যাস্টেল রঙের ব্যবহার। জনকের প্রতিকৃতি মেলে ধরতে আশ্রয় নিয়েছেন চকরঙেরও। তিনি বহুমাত্রিক ভঙ্গি ও অভিব্যক্তিতে বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছেন সাবলীলভাবে। শিল্পী তাঁর সুনিপুণ তুলির আঁচড় ও রঙের সমারোহে নানামুখী আঙ্গিক থেকে উপস্থাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুকে।
ঢাকা আর্ট সেন্টারে ‘জাগো অন্তর মম’ শিরোনাম দিয়ে ২০১১ সালের ১৮ আগস্ট থেকে ২১ আগস্ট প্রদর্শিত হয়েছে ‘ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু চিত্রকলা’। দেশের বিখ্যাত এবং নতুন শিল্পীর ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়। বীরেন সোম, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, রণজিৎ দাস, খালিদ মাহমুদ, নাইমা হক, মাসুদা খানম প্রমুখ চিত্রশিল্পীর ছবি সেখানে ছিল। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো হয়; যিনি তাঁর জীবদ্দশায় কিংবদন্তি ছিলেন। এসব শিল্পী বিশ্বাস করেন তিনি বেঁচে আছেন মানুষের অন্তরে, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একীভূত সত্তা। শিল্পীরা তাঁর ছবি এঁকে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। তাঁরা নিজের অস্তিত্বে বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করেছেন। প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুকে জনগণের নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে দেখানো হয়েছে তিনি শ্রমজীবী এবং বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। বিভিন্ন শিল্পী তাঁকে বিচিত্রভাবে অঙ্কন করেছেন। কেউ কেউ তাঁর ধ্যানমগ্ন, চিন্তাশীল মুখমণ্ডল, কেউ বা তাঁর চোখের জ্যোতি ধরতে চেয়েছেন ক্যানভাসে। তা ছাড়া জাতির পিতার নির্ভীক মুহূর্তগুলো ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। তেলরং, অ্যাক্রিলিক, প্যাস্টেল, মিক্সড মিডিয়া, জলরং প্রভৃতি মাধ্যম ও আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন শিল্পীরা। এখানে মনে রাখা দরকার অধিকাংশ শিল্পীদের চিত্রকলার মূল প্রেরণা বা অবলম্বন ছিল বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্রসমূহ। বিভিন্ন বয়সের, বিচিত্র মাধ্যমের কাজ ও একটি বিষয়ে আলোকপাত ছিল এই প্রদর্শনীর মূল বৈশিষ্ট্য।
প্রদর্শনীতে ঠাঁই পাওয়া আহমেদ শামসুদ্দোহার চিত্রে বঙ্গবন্ধুর জনতার উদ্দেশ্যে পরিচিত অভিবাদনের ভঙ্গি আছে। ক্যানভাসের ফোকাল পয়েন্টে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শেখ আফজালের চিত্রে মহান নেতাকে দেখা যাচ্ছে একজন খুদে বালকের সঙ্গে কথা বলতে। মোহাম্মদ ইকবালের কালো, ধূসর আর পরিচিত আলোছায়ায় নেতার চিন্তান্বিত অবয়ব ধরা পড়েছে। অন্য একটি চিত্রে দেখা যায় জাতির পিতা পাইপ মুখে, ধোঁয়া উড়ছে, লাল ও কালো রং ব্যবহৃত হয়েছে এখানে। বঙ্গবন্ধুর চোখকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন এই শিল্পী। আনিসুর রহমানের চিত্রে স্পেস একটা প্রধান বিষয়। তাঁর চিত্রকলায় লাল এবং কালোর ব্যঞ্জনায় চিত্রের বুননে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয়েছে। নাজিব মোহাম্মদের ক্যানভাসের মাঝখানে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র মানচিত্র ও হিজিবিজি কালির আঁচড় লক্ষণীয়। এভাবে অজস্র চিত্রে বঙ্গবন্ধু মহিমান্বিত একটি নাম।