ফিরে আসা

পুকুরঘাট থেকে ফেরার সময় বাইরের দরজায় রিকশা দাঁড়ানো দেখে অবাক হন শওকত হোসেন। এত সকালে বাড়িতে আবার কে এলো, ভাবেন তিনি। এক হাতে মাছের খলুই, অন্য হাতে দাদার আঙুল ধরে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছিল তাঁর তিন বছরের নাতি মিহির। রিকশা দেখে সাগ্রহে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায় সে। রান্নাঘরের চালার ওপর বড়শিটা রেখে কলপাড়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে শওকত হোসেন দেখেন তাঁর মেয়ে এসেছে। এত সকাল সকাল, শ্বশুরবাড়িতে কোনো গণ্ডগোল হলো না তো? চিন্তা হয় তাঁর।
আব্বা ভালো আছেন? জবাবে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়েন তিনি। ঘরে ঢুকতে যাবেন এমন সময় শ্বশুরকে আদর করে নাশতা খেতে ডাকেন তাঁর পুত্রবধূ। কিন্তু কী করবেন দোটানায় পড়ে যান শওকত হোসেন। অনেকদিন এখানে বসে খান না, তাঁর ঘরেই খাবার দিয়ে আসা হয়। আজ মেয়ের সামনে পুত্রবধূর কথা রাখতে শেষ পর্যন্ত টেবিলে গিয়ে বসেন তিনি।
আব্বা, দামটা কম হয়ে গেল না তো?
প্রশ্নটা শুনে চমকে যান শওকত হোসেন। নিজের অজান্তে মাথা উঁচিয়ে মেহগনি গাছটার দিকে চোখ যায় তাঁর। আহারে-অস্ফুট আর্তনাদের মতো শব্দটা বেরিয়ে আসে তাঁর গলা দিয়ে, তাঁকে একবার জিজ্ঞেসও করা হলো না। তিনি তো সবার চোখের সামনেই থাকেন, তা ছাড়া তিনি আপত্তি যে করবেন না তা তো জানা কথা। খাবার খেতে আর ভালো লাগে না তাঁর। ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করে, কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেন না কিছু।
এ সময় শওকত হোসেনের ছেলে বাবার পাশে এসে বসে। তার চোখেমুখে ব্যস্ততার ছাপ। বোধহয় অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। তাই সে হড়বড় করে বলতে থাকে, কাজের চাপে বাবাকে জানানো হয়নি, তাদের ঘরের উত্তর দিকটা খানিকটা বাড়ানো দরকার। গাছটা তাই কাটতে হচ্ছে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে বলে। সে আর না করেনি।
কথা শেষ করে কৌতুহলী চোখে বাবার দিকে তাকায় সে, কিন্তু শওকত হোসেন কিছু বলেন না, শুধু বিভ্রান্ত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর স্ত্রীর অসুখের সময় একটি গাছ কাটতে হয়েছিল, এটি যাতে বেঁচে যায় সে জন্য তার কত কাকুতি মিনতি। হবে না কেন, কত বছর ধরে সুখে দুঃখে সেগুলো ছিল তাদের সঙ্গে, ভরসার প্রতীক হয়ে, তিনি হয়তো চেয়েছিলেন কোনো বিপদে যেন সেটি কাজে লাগতে পারে। হয়তো তাঁর স্বামীর কথাই ভেবেছিলেন। শওকত হোসেনের বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
ছেলের উত্তাপহীন কথাবার্তা শুনে এবার মেয়ের দিকে তাকান তিনি সহমর্মিতার আশায়, কিন্তু পুত্রবধূর সঙ্গে তাঁর ক্লান্তিকর মেয়েলি হাসিঠাট্টায় মেজাজ গরম হয়ে ওঠে শওকত হোসেনের। তিনি উঠে তাঁর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। শুয়ে শুয়ে ভাবেন, সংসারে এতটাই গুরুত্বহীন হয়ে গেছেন তিনি, কিন্তু কেন? তাঁর কবজির জোর কমে গেছে বলে? অথচ কিছুকাল আগেও তো ছেলেমেয়েরা তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত না। তাদের এই বদলটা শওকত হোসেনের ভালো লাগত না বলেই তিনি স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা হয়ে পড়েন। উঠোনের উল্টোদিকে আলাদা একটা ঘরে একাই থাকেন, মাঝেমধ্যে মিহিরকে নিয়ে সময় কাটান। নানা ধরনের বইপত্র পড়েন, নিয়ম করে ইংরেজি গ্রামারটাও চর্চা করেন। ঘরে রান্নার ব্যবস্থা আছে কিন্তু খুব একটা চুলা জ্বলে না, তাঁর ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দুপুরের পরপর বের হয়ে ছাত্র পড়িয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফেরেন তিনি। এখন দুটো টিউশনি তাঁর। একসময় হাইস্কুলে খুব ভালো ইংরেজি পড়াতেন, পনেরো বছর হলো অবসর নিয়েছেন।
প্রথম টিউশনিটা শেষ করে তিনি যখন ফিরছিলেন, তখন তাঁর মনে হয় আজ বিশ্রাম নিলেই পারতেন। কিন্তু মনটা ভালো নেই বলেই হয়তো বাসায় থাকার কথা তাঁর মাথায় আসেনি। অবশ্য ঘর থেকে বের হওয়ার সময় শরীর এতটা খারাপ ছিল না, রোদের মধ্যে ঘোরাঘুরি আর ঘণ্টা দুই খাটুনিতে একেবারে নেতিয়ে পড়েন তিনি। পেটের ভাতও হজম হয়ে গেছে সেই কখন। তেষ্টায় শরীরের শেষ শক্তিটুকুও ফুরিয়ে আসছে যেন, তিনি অনুভব করেন পাঞ্জাবির ভেতর দিয়ে তার বুকের খাঁচা ওঠানামা করছে দ্রুত। ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মনে হয়, সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা হাঁটাপথ পেরোনোর আগেই বোধহয় মাটিতে লুটিয়ে পড়বেন তিনি। কিন্তু মনের জোর কখনো কখনো ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।
রাস্তার ওপর একটা হোটেলে ঢুকে পড়েন শওকত হোসেন। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে আরাম করে বসেন। গরম গরম রসগোল্লা খেয়ে নেন দুটো, এরপর চা। এখান থেকে রিকশায় তাঁর বাসা সামান্য পথ, সেখানে ফিরলেই পারেন, আজ না হয় নাই গেলেন কলেজ রোডের টিউশনিটাতে। কিন্তু না, বাসায় তাঁর ফিরতে ইচ্ছা করছে না। শওকত হোসেন রিকশা ঠিক করেন, ছেলেমেয়েরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।
একটু দেরি হয়ে গেল তাঁর পৌঁছাতে। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়সের দুটো মেয়ে আর নয় বছরের একটি ছেলেকে পড়াতে বসেছেন তিনি। বারবার তাঁর জল তেষ্টা পাচ্ছে। একটি মেয়ে আবার ভেতরে গিয়ে পানির গ্লাস হাতে ফিরে আসে। সে কিছুক্ষণ পরপর শওকত হোসেনের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় অস্বস্তি লাগছে, তিনি কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখেন, তাঁর নাক দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে, পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে রুমাল বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে নাক মোছেন তিনি, পড়ার আড়ালে গভীর আগ্রহে এই দৃশ্য দেখে মেয়েটি, তার খুব মায়া হয়। সে শওকত হোসেনকে জিজ্ঞেস করে,
স্যার, আপনার বাসায় কে আছে?
শওকত হোসেন খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আনমনে বলেন, কেউ নেই।
আপনাকে রান্না করে দেয় কে?
কে দেবে? কেউ তো নেই।
আমি আপনাকে রান্না করে দিয়ে আসব?
খাতা থেকে মুখ তুলে এক মুহূর্ত চুপ থাকেন শওকত হোসেন, পরে চতুর্দিক নাড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন তিনি
অপর দুই শিশু চমকে তাকায় তার দিকে, মেয়েটি হকচকিয়ে যায়, তার চোখে জল চলে আসে, কী এমন ভুল কথা বলল সে, কিছুই বুঝতে পারে না। পড়াতেও মন দিতে পারে না, মাথা নিচু করে ভাবতে থাকে। শওকত হোসেন তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দেন, মুখ হাত ধুয়ে একটু পরে ফিরে এসে আবার পড়তে বসে মেয়েটি।
সারা দিনের অবসাদ, ক্লান্তি আর হাহাকার শেষে সন্ধ্যায় প্রশান্তি নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ান শওকত হোসেন। তাঁর অসুস্থতা চাপা পড়ে যায় মনের কাছে। কিন্তু কেন?
মেয়েটির জন্য? হ্যাঁ তাই, তাঁর কথাটা শিশুসুলভ খেয়াল ছিল বটে, কিন্তু এমন সাহস নিয়ে অকপটে কজনই বা তা বলতে পারে? আবার হাসি পায় তার, আর এসব ভাবতে ভাবতে আরো একটি দিনের জন্য মন-প্রাণ সজাগ হয়ে ওঠে পঁচাত্তর বছর বয়সী এই বৃদ্ধের।