সব গল্পের উৎপত্তিই মানুষের মন : কাবেরী রায়চৌধুরী

পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠিত কবি ও ঔপন্যাসিক কাবেরী রায়চৌধুরী। ইতিহাসে অনার্স নিয়ে স্নাতক। পরে মনোবিদ্যা নিয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন আনন্দবাজারসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। এরই মধ্যে লেখকের প্রকাশিত বেশ কিছু বই। সাত পুতুলের সাত কথা, চাতক জল, যে যেখানে দাঁড়িয়ে, অর্ধেক আকাশ, শরীরী তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। পশু-পাখিদের সংসারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি। কাজ করছেন অনাথ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য। জনপ্রিয় এ লেখকের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ লেখক অঞ্জন আচার্য।
অঞ্জন আচার্য : কেমন আছেন দিদি?
কাবেরী রায়চৌধুরী : ভালো আছি ভাই। ধন্যবাদ।
অঞ্জন : আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটি শুনতে চাই।
কাবেরী : আমার বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়, বরাহনগর ও পাইকপাড়ায়। বেড়ে ওঠার মধ্যে অত্যাশ্চর্য কিছুই ছিল না। বাবা সরকারি কর্মচারী, মা ও চাকরি করতেন একটি জাহাজ কোম্পানিতে। আমি বড় হওয়ার সময় সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন মা। বাবার যেহেতু বদলির চাকরি ছিল, তাই প্রচুর ঘোরাঘুরির মধ্যে থাকতেন, আমি আর মা কলকাতাতেই...। না হলে পড়াশোনার অসুবিধা হতো। তাই বলা যায়, মায়ের ছত্রছায়ায় বড় হওয়া।
মা খুব পজিটিভ মাইন্ডেড ছিলেন, তাই আমার ভেতরেও গল্পচ্ছলে সেই সদর্থক বার্তার বীজই বুনে দিতেন। ছয় বছর বয়সে ক্লাস টু-তে ভর্তি হই আমি একেবারে। তার আগেই পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার দারুণ স্বপ্নটা গল্প করতে করতে ইনজেক্ট করে দিয়েছিলেন আমার মনে! শুধু ফার্স্ট হওয়া নয়, অনেক ভালো সৎ চিন্তাও...! যার জন্য আজও কোনো অন্যায় করতে পারি না । করি না। অন্যায় প্রলোভনের সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ! আমাকে আত্মবিশ্বাসী হতেও শিখিয়েছিলেন মা। নির্লোভ হতেও! বেড়ে ওঠা মাকেন্দ্রিক ছিল। একাকিত্ব কাটানোর রাস্তাও দেখিয়েছিলেন মা। একা সন্তান, তাই যেন একলা না লাগে গল্পের বই ধরিয়ে দিয়েছিলেন হাতে, সেই আড়াই বছর বয়স থেকেই। রঙ পেনসিল, কাগজ, পুতুলের সংসার... এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি।
অঞ্জন : লেখালেখির শুরু কীভাবে, একটু বলবেন?
কাবেরী : মজার কথা আট বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র পড়া শুরু করেছি! যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আমার বই পড়ায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে আমাকে জব্দ করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এইবারে জব্দ। আর মেয়ে বই চাইবে না! হা হা... কিন্তু হলো উল্টো। দাঁত ভেঙে গেলেও পড়েছি কপালকুণ্ডলা, দেবী চৌধুরানী! কল্পনা শক্তি হয়তো সেইসময় থেকেই ডানা মেলেছিল।অঞ্জন : সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মালো কী করে? কার কাছ থেকে বা কোথায় পেলেন সেই অনুপ্রেরণা?
কাবেরী : অনুপ্রেরণা তেমন কেউ নেই। অনুপ্রেরণা বলতে আমার নিজের পড়ার জগৎটাকেই বলতে পারি। ছোট থেকে চাঁদমামা, শুকতারা, কিশোর ভারতী পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ, রবিঠাকুরের পাশে বড়দের গল্প-উপন্যাসও পড়েছি। বাড়ি থেকে কেউ বাধা দেয়নি। পড়ায় কোনো ছুৎমার্গ ছিল না। তবে লেখক হবো এমন স্বপ্ন কোনোদিন দেখিনি। বরং ইচ্ছা ছিল আইপিএস হব, পুলিশে উচ্চপদে যোগদান করব। অথবা ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে। ডেস্টিনিতে বিশ্বাসী আমি তাই কোনো ক্ষোভ রাখিনি এইসব কাজে যোগ দিতে পারিনি বলে, বুঝি লেখক হওয়াই ভবিতব্য ছিল, তা-ই হয়েছি।
অঞ্জন : কোন কোন লেখক আপনার সাহিত্যের পথচলায় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন? বা এখনো করছেন?
কাবেরী : একটু বড় হতেই, মানে কৈশোর থেকেই পছন্দ-অপছন্দগুলো প্রকট হলো। এইসময় থেকে বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিকে মজেছি আমি। রক্তমাংসের গল্প, জীবনের কটু গল্প, অন্ধকারের গল্প, আর প্রকৃতির গল্প আমি পেলাম এঁদের থেকে। বিদেশি সাহিত্যও পড়তাম। ডিকেন্স, পার্ল এস বাক, দস্তয়েভস্কি, ও’হেনরি এমন অনেকের লেখা ভালো লাগত তখন থেকেই। প্রসঙ্গত, আমি একটু সিরিয়াস লেখার ভক্ত। সেই হিসেবে এঁদের লেখা আমাকে ভাবিয়েছে, আমি নিজের মতো দেখতে শিখেছি, মানুষের জীবন যে সরল রৈখিক নয়, তা জেনেছি।
অঞ্জন : ছাপার অক্ষরে কবে আপনার লেখা প্রকাশিত হলো? শুরুটা জানতে চাই।
কাবেরী : ২০০০ সালে প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ দিয়ে পথ চলা। সংবাদ প্রতিদিন একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল আর আমি সেকেন্ড হয়েছিলাম। কেউ চিনতো না তার আগে আমাকে। সেই প্রথম আত্মপ্রকাশ! কবিতা গল্প লিখতাম ঘরে বসেই। কোথাও পাঠাতাম না। মনের আনন্দে লিখতাম শুধু। লেখক হব ভাবনা থাকলে তো পাঠাব! কিন্তু ওই যে ভবিতব্য; ডেস্টিনির প্ল্যান তো ছিল আমি সাহিত্যিক হবো, তাই হয়ে গেলাম! ২০০১-এ ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ। তার আগে লিখলাম ছোট পত্রিকাতে, অসংখ্য কবিতা লিখেছি। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় শ্রদ্ধেয় নবারুণ ভট্টাচার্যদা’র হাত দিয়ে ‘প্রমা’ পত্রিকায়। এইভাবেই এগোল আমার লেখক জীবন।
অঞ্জন : দীর্ঘদিন ধরে আপনি লিখছেন। কবিতা-গল্প-উপন্যাস-শিশুসাহিত্য—নানা বিষয়ে লিখে আসছেন। এর মধ্যে যে নামগুলো উচ্চারণ করতেই হয় সেগুলো হলো : সাত পুতুলের সাত কথা‚ চাতক জল‚ যে যেখানে দাঁড়িয়ে‚ অর্ধেক আকাশ‚ শরীরী প্রভৃতি। আমার প্রশ্ন হলো, এই যে আপনার সাহিত্য-সৃষ্টি, সেগুলোর রসদ কোথা থেকে পেয়েছেন? এসব লেখায় ব্যক্তি আপনি কতখানি উপস্থিত? কোন লেখায় আপনার উপস্থিতি বেশি?
কাবেরী : তুমি যে উপন্যাস গল্পগুলোর নাম বললে সেগুলোই উল্লেখযোগ্য নয় শুধু। ‘সাত পুতুলের সাত কথা’ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘সানন্দা’ পত্রিকায়। আমার অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। কিন্তু এরপরে লিখেছি আরো অনেক। আমার অন্যতম প্রিয় উপন্যাসগুলো বোধ হয় তোমার পড়া হয়নি! আমার প্রিয়, যাত্রা, ভাত শিকার, মরুচক্র, পবিত্র পুরুষ, আলোয় আঁধারে, ইলিয়ানা, ছুঁয়ে থাকো, মায়া মুকুর, কত পাপ হে, অন্তর্জাল প্রভৃতি। কিশোরদের জন্য লিখেছি সিরিজ, ডুডেকাহেড্রন রহস্য। ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে চারটি। ‘পঞ্চাশটি গল্প’ প্রকাশ হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। সাহিত্যম/নির্মল বুক এজেন্সি থেকে, প্রিয় ২৫টি গল্প, পত্রভারতী থেকে হাসির বারো, আর গুয়াহাটি থেকে এক ডজন গল্প।
এ বিষয়ে একটি কথা বলি, নিজের লেখা নিজের ভেবে পড়িনা, তাই সমালোচনা করতে সুবিধা হয়। তাই ৮৬ পৃষ্ঠা লেখার পরেও নিজের উপন্যাস পছন্দ হয়নি বলে ফেলে দিয়ে অন্য উপন্যাসে হাত দিয়েছি। এমন দুবার হয়েছিল। যত আত্মস্থ হওয়া যায় ততই উন্মুক্ত মনে জীবন দেখা যায়। আকাশ থেকে পেড়ে বানিয়ে গল্প-উপন্যাস আমি লিখি না। চরিত্রদের কোথাও না কোথাও দেখেছি, গভীর নিরীক্ষণে। তারপর গল্পগুলো হয়ে ওঠে। আমার গল্পে সাইকোলজিক্যাল অ্যানালিসিস থাকে। মনোজগৎ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসি। আসলে সব গল্পের উৎপত্তিই মানুষের মন। যেভাবে react করি সেভাবে তৈরি হয় পরিবেশ। আর পরিবেশ, মানুষ প্রকৃতির বাইরে আর কী থাকতে পারে? যা থাকে তা অতি প্রাকৃত, সে নিয়েও কিশোরদের জন্য লিখেছি। উপন্যাস-গল্পেও আমি থাকি। তবে তখন নিজের থেকে নিজে অনেক দূরে চলে যাই, না-হলে নিরপেক্ষ চরিত্রায়ন সম্ভব নয়।
অঞ্জন: পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান লেখকদের মধ্যে কার কার লেখা আপনার পছন্দ?
কাবেরী : বর্তমান লেখকদের মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, তিলোত্তমা মজুমদার পছন্দের। বিনোদ ঘোষালের বেশ কিছু ছোটগল্প ভালো লেগেছে। সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কয়েকটি ভালো উপন্যাস জন্ম দিয়েছিলেন।
অঞ্জন: বাংলাদেশের উপন্যাস-গল্প সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কার কার লেখা ভালো লাগে?
কাবেরী : বাংলাদেশের বর্তমান লেখা নিয়ে সত্যি বলতে আমার তেমন স্পষ্ট স্বচ্ছ ধারণা নেই। তবে আগেকার লেখার মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’ মনে দাগ কেটে আছে। হুমায়ূন আহমেদের অনেক রচনাই পছন্দের। মিলন ভাইয়ের (ইমদাদুল হক মিলন) লেখাতেও জীবন পাই। আর প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
অঞ্জন : পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ বই বাংলাদেশে পাওয়া যায়, সে তুলনায় বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় না। এতে বাংলাদেশের অনেক শক্তিমান লেখকের বইও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে পৌঁছায় না। অনেক পাঠক বাংলাদেশের বড় লেখকদের নামই শোনেননি। এই ব্যর্থতার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
কাবেরী : দেখো সত্যি এটা একটা সমস্যা যে বাংলাদেশের লেখকদের লেখা আমরা বড় একটা পাই না। দুদেশের প্রকাশক, ও বিপণনকারীদের এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।
অঞ্জন : অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের অনেক নবীন-প্রবীণ লেখকের ভালো ভালো লেখা শারদীয়া সংখ্যা দূরে থাক, সাধারণ সংখ্যায়ও প্রকাশের জন্য মনোনীত হয় না। অথচ বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সাধারণ সংখ্যা তো বটেই, ঈদসংখ্যাগুলোয়ও পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের প্রচুর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই বৈষম্যের কারণ কী? আপনার কী মনে হয়? এটা বাণিজ্যিক না রাজনৈতিক?
কাবেরী : আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখেছ, এ দেশের পত্রিকায় বাংলাদেশের লেখকদের লেখা ছাপে না! অথচ ওই দেশে ছাপে! আমি নিজেও ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকাতে লিখেছি, চ্যানেল আইয়ের ‘আনন্দ আলো’তে লিখেছি অনুরোধে। এখন প্রশ্ন হলো, ভালো লেখা কি তবে হচ্ছে না বাংলাদেশে? এখানে একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা হাউজে অনেক অনামী ভালো লেখাও ছাপে, তবে লেখাটি মোটামুটি ভালো হতে হয়। তাই সত্যিই প্রশ্ন, তবে কি বর্তমান প্রজন্ম তেমন কিছু দিতে পারছেন না? কী জানি! একটি সত্যি কথা বলি, ‘প্রথম আলো’র এক সাংবাদিককে আমিই প্রশ্ন করেছিলাম একবার, যে, এই সময়ে “আমার বয়সী কারা ভালো লিখছেন একটু বলবেন? আলাপ করার ইচ্ছে আছে।” উনি বলেছিলেন, “তেমন কেউ আর নেই যাদের লেখা দেখে পত্রিকা কিনব। আমি তো আপনাদেরই দু-তিনজনের নাম দেখে ওই বাংলার পত্রিকা কিনি।” আশ্চর্য হয়েছিলাম। এরপর আর কী বলি, বলো?
অঞ্জন : দুই বাংলার সাহিত্যের সম্মিলন কীভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এ ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন কিছুটা ভূমিকা রাখছে বৈকি।
কাবেরী : হ্যাঁ, দুই বাংলার ছোট পত্রিকা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে পারে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে।
অঞ্জন : সাহিত্যের প্রসারে ব্লগ-অনলাইন, ওয়েবম্যাগগুলো কতটা ভূমিকা রাখে বলে আপনি মনে করেন?
কাবেরী : সাহিত্য প্রসারে ব্লগ অনলাইন ওয়েবম্যাগগুলোর গুরুত্ব আছে। বিশেষত ব্যস্ততার সময়ে এই প্রজন্ম এতটাই অনলাইন থাকে যে তাদের পড়তে সুবিধা হয়। আর এ দেশের (পশ্চিমবঙ্গ) লেখা ও দেশের (বাংলাদেশ) পাঠকের কাছে পৌঁছে যাওয়া বা ও দেশের (বাংলাদেশ) লেখা এ দেশে (পশ্চিমবঙ্গ) পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনলাইনই বেস্ট ওয়ে।
অঞ্জন : এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিদি।
কাবেরী : অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। শুভকামনা রইল।