রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ
অক্টোবর বিপ্লবের ধারা

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো বিপ্লবই আগেরটির মতো নয়। কিন্তু প্রতিটি বিপ্লবের মধ্যে একটা অন্তর্গত সারবস্তু আছে, সেটা মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার। প্রতিটি বিপ্লব তার প্রেরণা দিয়ে যেমন ভবিষ্যতের মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, তেমনি অন্ধ অনুগতের মতো তার প্রক্রিয়াকে অনুসরণ করতে চাইলে তা বিশাল প্রতিবন্ধকও হয়ে উঠতে পারে। বিপ্লব তাই কখনই শুধু পুরোনো চিন্তার নকল নয়, বরং চিন্তার দিগন্তটাকে আরো সম্প্রসারিত করার একটা বাধ্যবাধকতাও নিয়ে আসে।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বৈশ্বিক আভা ছড়িয়েছিল ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ সালে ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র ডাকে দুনিয়াজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল সে, সুদূর ভারতবর্ষে রাজা রামমোহন রায় ও তার সমমনারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সেই আহ্বানে। কিন্তু এই বিপ্লব তার অন্যতম লড়াকু অংশ নারীদের জন্য তার প্রতিশ্রুতি আদৌ রক্ষা করেনি, তাদের সব দাবিই প্রত্যাখ্যাত হয় রাজতন্ত্রের উৎখাতের পর। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের প্রতিও তার স্বাধীনতার বাণী কার্যকর হয়নি, ফরাসি বিপ্লবেরই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হাইতির দাস বিদ্রোহ দমনে ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে একের পর এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠায় ফরাসি রাষ্ট্র। কিন্তু ফরাসি বিপ্লবেরই উদ্দীপনা নিয়ে দাসরা আগ্রাসী ফরাসি রাষ্ট্রকে প্রতিহত করেছিল। এমনিভাবে বিপ্লবের ধাক্কায় অর্গলভাঙা অজস্র দাবির মুখোমুখি হয়ে ফরাসি বুর্জোয়া শাসকেরা অচিরেই ‘মৈত্রী’ করে পুরোনো সেই পরাজিত সামন্ত শক্তিগুলোরই সঙ্গে, যথাসম্ভব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে সামন্ত সংস্কৃতিকেও। এর মানে এই না যে, ফরাসি বিপ্লবকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে। বরং, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে মুক্তির একটা নতুন সীমা সে দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বের সামনে। ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা পরবর্তী সব বিপ্লবের চেতনায় তাই জ্বালানির কাজ করেছে। একই সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের গণ্ডিটাকে চিহ্নিত করে মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবার আন্তর্জাতিকতার চেতনাকে আরো দৃঢ়ভাবে সামনে এনেছে।
২.
রুশ বিপ্লব নিয়ে গ্রামসি বলেছিলেন, “‘পুঁজি’র বিরুদ্ধচারী বিপ্লব!” পুঁজি বলতে এখানে মার্কসের লেখা পুঁজি গ্রন্থটাকে বুঝিয়েছেন গ্রামসি। কেননা, মার্কস মনে করতেন, ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতেই আগে বিপ্লব সম্পন্ন হবে, কেননা সেখানে শ্রমিকশ্রেণি শক্তিশালী একটি সামাজিক বর্গ হিসেবে উপস্থিত আছে। কিন্তু লেনিন দেখালেন, শ্রমিকশ্রেণি যেমন সুগঠিত আছে পশ্চিম ইউরোপে, রাষ্ট্র তার চাইতেও অনেক বেশি শক্তিশালী ও সুগঠিত। শুধু তাই নয়, সারা পৃথিবীতে তার দখল ও লুণ্ঠনের একটা ভাগ তার নিজের দেশের শ্রমিক শ্রেণিকে দিয়ে মালিকরা তাদের ক্ষোভকে কিছুটা প্রশমিত করতেও সক্ষম হয়। লেনিনের মতে, তাই বিপ্লব ঘটবে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বল গ্রন্থিতে—আর, লেনিনের চোখে, রাশিয়া হলো সেই দুর্বল গ্রন্থি! বিপ্লবের তত্ত্বটিকেই এভাবে একধাপ এগিয়ে নেন লেনিন। মার্কসের হুবহু অনুকরণ রপ্ত করলে লেনিনের পক্ষে নিশ্চয়ই এই কাজটি সম্ভব হতো না।
চীন দেশে মাও একদম নতুন একটা কাজ করলেন। এর আগ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ভাবা হতো সংগঠিত সশস্ত্র শ্রমিকদের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে হবে এমন একটা কিছু। শহর ছিল সেখানে অভ্যূত্থানের কেন্দ্র, এটি আসলে ফরাসি বিপ্লবের কেন্দ্র হিসেবে নগরের উপস্থিত অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির আপত্তির মুখেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবহুল পরিস্থিতির মধ্যে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি জন্ম দিল এমন একটা বিপ্লবের, যার প্রধান শক্তি ছিল সশস্ত্ররূপে সংগঠিত চিনা কৃষক জনগোষ্ঠী। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’-এর এই নতুন কর্মসূচিটি চীনের পরিপ্রেক্ষিতে অভাবিত সাফল্য লাভ করেছিল। বিপ্লব পরবর্তীকালে গোটা দেশের কৃষির রূপান্তর ও শিল্পায়নেও চীন নতুন পথ ও দৃষ্টান্ত হাজির করেছে মানুষের সামনে, তার পর্যালোচনা ও সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে সেখান থেকে আমাদের নেওয়ার আছে অনেক কিছু।
বিপ্লবের ডাক তাই একদিকে একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তে, একটা নির্দিষ্ট স্থানে যা অর্জন সম্ভব, এমন কোনো কর্মসূচির পেছনে সমবেত হওয়ার আহ্বান। অসম দুনিয়ায় কোনো সর্বজনীন কর্মসূচি বা পথ বিপ্লবের জন্য তাই নির্ধারণ করা যায় না। একই সঙ্গে অতীতের বিপ্লবগুলো যে সীমাবদ্ধতা ও প্রশ্নগুলোর জন্ম দিয়েছে, তাও সমাধান করেই বিপ্লবকে অগ্রসর হতে হয়।
৩.
এমনি একজন বিপ্লবী মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের সামনে থেকে বিদায় নিলেন, তিনি ফিদেল কাস্ত্রো। অতীতের বিপ্লবগুলো নিয়ে বিস্তর আলাপ ইতিপূর্বে হয়েছে, আমরা বরং আমাদের দেশের জন্য প্রাসঙ্গিক, কিউবার বিপ্লবের এমন কিছু সাফল্য ও অর্জন নিয়েও আলাপ করতে পারি অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে।
বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল প্রকাণ্ড একটি সেনাবাহিনী। মার্কস যেমনটা কল্পনা করেছিলেন, সশস্ত্র রূপে সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করবে, সেই ভাবনা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিচ্যুত হয়েছিল। বরং বিশাল এই অলস সেনাবাহিনী জনগণের সৃষ্টি করা উদ্বৃত্ত সম্পদের একটা বড় অংশ নিজেরাই ভোগ করছিল। অথচ শুরুতে অনেকখানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর নির্ভর করে থাকলেও কিউবা সামরিক দিক দিয়ে অনেক কৌতূহল জাগানো ভাবনার জন্ম দেয়, যা তুলনামূলকভাবে মার্কসের ভাবনারই কাছাকাছি। কিউবার সামরিক শক্তি নিয়ে কিছু আলাপে দুটো বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু হতে পারে।
ক. কেমন সেই বাহিনী, যা কিউবার মতো খুদে প্রতিবেশীকে বাঁচিয়ে দিয়েছে অজস্র মার্কিন হামলা, ষড়যন্ত্র আর অভিযান থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টা ছিল বে অব পিগসের ঘটনা।
খ. কেমন সেই বাহিনী, যার জোরে কাস্ত্রোর মতো ‘একনায়ক’ টিকে গেছেন দশকের পর দশক, নিজ দেশের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাত থেকে।
আসলে কিউবার সামরিক শক্তি বলার মতো কিছুই না। উইকিপিডিয়ার মতে, ২০১৫ সালে সেনাবাহিনীর সক্রিয় সদস্যসংখ্যা ৯০ হাজার। আর মজুদ বাহিনীতে আছে ১৫ লাখ।
১৫ লাখ মজুদ বাহিনী! এই কারণেই শখ হলেই কেউ কিউবাতে সামরিক অভিযান চালাতে আসবে না। কিউবার নিরাপত্তার এটাই সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা।
এই মজুদ বাহিনী আসলে কতটা কার্যকর? সেটা বোঝা যাবে সংখ্যাটা দিয়ে নয়, সামরিক বাহিনীটাকে গড়ে তোলার পদ্ধতি দিয়ে।
কিউবাতে নাগরিকদের জন্য দুই বছরের সক্রিয় সামরিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া আছে বিদ্যাটাকে ঝালিয়ে রাখবার জন্য প্রতিবছর ৪৫ দিনের অনুশীলন। ১৬-৪৯ বছর বয়সীদের জন্য এই বন্দোবস্ত। বাধ্যতামূলক না হলেও মজুদ বাহিনীর আকৃতিটা বলে দেয় সামরিক সেবার প্রতি মানুষের আগ্রহ আর উৎসাহের মাত্রাটা। আগ্রাসন ঠেকাতে উৎসুক এই নাগরিক সেনাবাহিনীই কিউবার সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা ভাবা যাক। এত বিপুল পরিমাণ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিক থাকলে দেশের ভেতর নৈরাজ্য শুরু হবার কথা না। এরা তো মাসে মাসে বেতন পায় না। এরা যদি লুটপাট শুরু করে! বিদ্রোহ শুরু করে! ভাবা যায়, জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ, মানে প্রতি দশজনে একজনের সামরিক প্রশিক্ষণ আছে!
আসলে সশস্ত্ররূপে সংগঠিত এই জনগণই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারী যেকোনো আচরণের বিরুদ্ধে এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা। ইতিহাসে দেশে দেশে, কালে কালে আমরা এই সত্যেরই স্বীকৃতি পাই যে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা সেনাবাহিনীর প্রয়োজন তখনই পড়ে, যখন সম্পদের নিয়ন্ত্রণ গুটি কয়েকের হাতে সীমিত হয়ে যায়। এবং তখনই, সামরিক জ্ঞান আর পেশাদারিত্বের ওপর ভর করে জনগণের ওপর দুই ধাপের শোষণ শুরু হয়, একদিকে কারখানায় শ্রমের শোষণ, অন্যদিকে নিরপত্তার নামে কর আদায়। কিউবা নিখুঁত যদি নাও হয়ে থাকে, নিরাপত্তার ভাবনায় মার্কসের চিন্তার অনেক কাছাকাছি সে।
এভাবে গড়ে তোলা সামরিক বাহিনীর একটাই সীমাবদ্ধতা আছে। অন্তত প্রাথিমক বিবেচনায় এটা রক্ষণাত্মক কৌশল। আক্রমণকারীকে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ফেলে মোকাবিলা এতে সম্ভব। কিন্তু পররাজ্য গ্রাসের জন্য নিজের তরুণদের ঠেলে দিওয়া, প্রাণ দিতে বাধ্য করা এই পদ্ধতিতে কঠিন। সেটাই কি জনগণের জন্য মঙ্গলজনক নয়?
কাস্ত্রো কি ভাবতেন এই বিষয়ে? সাদামাটা, বরাবরের মতই : ‘ধনীতম আর শক্তিমানতমের অস্ত্রাগারে স্তূপ হওয়া নিত্য নতুন কার্যকর রণসসম্ভার অশিক্ষিত, অসুস্থ, গরিব আর ক্ষুধার্তকে খুন করতে সক্ষম, কিন্তু তারা তো অশিক্ষা, অসুস্থতা, দারিদ্র্য বা ক্ষুধাকে খুন করতে পারে না।’
কিউবা তার খুব সীমিত সম্পদ দিয়ে এই দ্বিতীয় ধরনের যুদ্ধে অনেক বড় বড় সব অর্জন দেখিয়েছে। কাস্ত্রো সেই অর্জনের অন্যতম নায়ক।
৪.
বেশ ক'বছর আগে লাতিন আমেরিকার একটা কবিতার সংকলনে পেয়েছিলাম কবিতাটা, দুটো পঙক্তি কেবল আবছা স্মরণে আছে, কবি দাবি করছেন ফিদেলের চেয়েও মহত্তর কেউ একজন আছেন, বিপ্লবীতর কেউ না, অন্য একজন কবিই।
‘মার্তি তো সেই স্বপ্ন দেখেছে কবে!
ফিদেল শুধু করেছে বাস্তবে।’
বাস্তবে ফিদেল কী করেছেন, তা শুধু বোঝা যাবে না দুনিয়ার সবচে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে কিউবাকে ভাবলে। সবচেয়ে ভালো বিদ্যালয় ব্যবস্থা দিয়েও না। এমনকি সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক দুধের বরাদ্দ, সকলের জন্য বাসস্থান এই সব দিয়েও না।
অভাবের ব্যবস্থাপনা দিয়েই তা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। সম্পদহীন একটা দেশ, দশকের পর দশক যে কাটিয়েছে মার্কিন অবরোধে, চিনি ছাড়া যার বলার মতো কোনো রপ্তানি পণ্য ছিল না, সে কী করে মানবসম্পদ উন্নয়নে এতদূর এগিয়ে গেল,কীভাবে এড়াতে পারল বিদ্রোহ, নৈরাজ্য, গণবিস্ফোরণ কিংবা অভ্যুত্থান, সেই রহস্য আসলে লুকিয়ে আছে তার সম্পদ আর দারিদ্র্য দুইয়েরই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের দায় নাগরিকদের ওপরই ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে।
আরো বলা দরকার, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন এই দিক দিয়ে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গোটা উৎপাদনী ব্যবস্থায় জনগণের সৃজনশীল অংশগ্রহণকে কঠিন করে তুলে তারা আমলাতন্ত্রকে বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত করেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এখানে জনসাধারণের নয়, আমলাতন্ত্রের। অন্যদিকে জনগণের অংশগ্রহণের উপায় উদ্ভাবনেও কিউবা মৌলিক ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, দর্শনগত দিক দিয়ে কিন্তু এটাও মার্কসের চিন্তারই কাছাকাছি।
২০০০ সালে একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন কাস্ত্রো, জাতিসংঘের সহস্রাব্দ সম্মেলনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। কথা বলার সময় পেয়েছিলেন মাত্র ৫ মিনিট। কথা বলতে তিনি বড় ভালোবাসতেন। কথা তিনি বললেনও, হার্লেমে কালো মানুষদের আমন্ত্রণে একটা সভায়। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে সেখানে ফিদেল বলছিলেন তার ঠিক ১০ বছরের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ের কথা। সোভিয়েত ই্উনিয়নের সঙ্গে অধিকাংশ ব্যবসা ছিল কিউবার, চিনির বদলে তারা পেতেন ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী। মার্কিন অবরোধের কারণে বাকি দুনিয়ার সঙ্গে কিউবার ব্যবসা বন্ধ ছিল।
সোভিয়েত পতনে কিউবার দৈনিক মাথাপিছু ৩০০০ ক্যালরি গ্রহণে পতন এলো, রাতারাতি ১৮০০ ক্যালরিতে নেমে এলো তা। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে উল্লাস : মানুষ এইবার কাস্ত্রোকে খেদিয়ে দেবে।
কিন্তু কিউবা যা করল তা অবিশ্বাস্য : তারা গোটা দেশের মানুষকে জানিয়ে দিল তাদের কী আছে, কী নেই। মাথাপিছু সম্পদ ভাগ করে দেওয়া হলো জেলা-থানা-এলাকা-পাড়া হিসেবে। এসব আঞ্চলিক পর্ষদেই স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকেন। তারপরও ক্ষুদ্র ভিত্তিতে ভাগ করা গেলে প্রায় সব নাগরিককেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা যায়। সবাই জানল আমাদের কতটুকু আটা আছে, কতটুকু বিয়ার। কতটুকু দুধ আর কতটুকু জ্বালানি তেল। তারা সবাই মিলে উপোস করল, সবাই মিলে বাড়তি পথটুকু হেঁটে গণপরিবহনে চড়ল। শিশুদের দুধের বরাদ্দ কমল না। কমল না হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা। সব বিদ্যালয় একদম একই রকম চালু থাকল। সবাই মিলেই কিউবাকে আবার তুলে ধরলেন, খাদ্যের উৎপাদন বাড়ালেন, রাসায়নিক সারের বিকল্প আবিষ্কার করলেন, ওষুধ আর চিকিৎসাতে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেওয়া অব্যাহত রাখলেন। গণিত আর বিজ্ঞানে তাদের শিক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা জুটল শত্রুশিবির থেকেও।
১০ বছর পরে, ওই বক্তৃতায় কাস্ত্রো জানাচ্ছেন কিউবার মাথাপিছু ক্যালরি গ্রহণ দাঁড়াল ২৪০০-তে। ২০০৬ সালে তা হলো ২৬০০ ক্যালরি। ২০০৮ সালে কিউবাতে তা ৩৪০০-এর সামান্য বেশি, সুজলা-সুফলা বাংলাদেশে তা তখন ২২০০।
কাস্ত্রো যখন এই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন চলছিল দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ডসহ এ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় মন্দা। কোরিয়ার মতো সম্পদশালী দেশ তখন তার সামাজিক সুবিধা কমিয়ে দিয়েছিল, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বয়স্কদের জন্য সুবিধা নাই হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কারণ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র আর উচ্চশ্রেণির স্বার্থ যথাসম্ভব বাঁচিয়েই বিপদটা চাপিয়ে দেওয়া হয় দরিদ্রতর অংশের ওপর।
১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণটা কী, তাও বোঝা যায় নিমেষে। কাস্ত্রো দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সংকটের শিকার যেকোনো জাতি হতে পারে। কিন্তু যদি দেশটা চালানো হয় আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, তাহলে আমলারা নিজেদের সবকিছু অটুট রেখে, ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে বাড়তি কিছু মুনাফাও কামিয়ে সংকট অতিক্রম করবে পুরোটা জনগণের কাঁধে চেপে। আর, দরিদ্র কিংবা সম্পদহীন একটা দেশও মানুষের ওপর ভালোবাসা আর আস্থায় ভর করে সকলে মিলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই—বলা উচিত উচ্চতর একটা গণতন্ত্রের পথেই সংকটকে মোকাবিলা করতে পারে। মানুষের প্রতি এই ভালোবাসাই কাস্ত্রোকে মহান করেছে, কিউবার মতো ক্ষুদ্র একটি দেশের সম্পদ ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদের উন্নয়ন নিয়ে স্বেচ্ছান্ধই কেবল চোখ ফিরিয়ে রাখতে পারে।
কাস্ত্রোর বক্তৃতার ওই অংশটি পড়ে—কিংবা হয়তো অনেক জায়গার টুকরো টুকরো অংশ মিলিয়ে আমরা বুঝতে শিখি এত সামান্য সামরিক শক্তির একটা দেশ কোনো জাদুমন্ত্রে দশকের পর দশক ধরে মার্কিন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টিকে গেল। এই শক্তি মানুষের ভালোবাসার। তাই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সকল অবরোধ আর ষড়যন্ত্র থেকে।
৫.
সোভিয়েত পতনজনিত ওই সংকটের উত্তরণ পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটা যুগান্তকারী পরীক্ষার জন্ম দিল। কিউবার মাংস, রাসয়নিক আর জ্বালানির প্রায় পুরোটা আসতো রাশিয়া থেকে। সেটা বন্ধ হয়ে গেল।
সামরিক বিপদকে তারা মোকাবিলা করেছেন প্রশিক্ষিত জনগণ দিয়ে। খাদ্যহীনতাকে তারা মোকাবিলা করেছেন অভাব ভাগ করে নিয়ে। এটা করাবার মতো উদ্দীপনা কাস্ত্রোরা তাঁদের জোগাতে পেরেছিলেন।
কিন্তু শুধু এটুকুতেই থাকেননি তাঁরা। দুনিয়ার মধ্যে প্রথম এত বড় মাত্রায় জৈব কৃষির প্রবর্তন তাঁরা করলেন, কেননা রাসয়নিকের সরবরাহ বন্ধ হওয়াতে কীটনাশক বলে কিছু আর সে দেশে ছিল না। সার বলেও কিছু ছিল না। চিনি বিক্রি করতে হতো তাঁদের আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে, কেননা কিউবার সঙ্গে ব্যবসা করলে সেই প্রতিষ্ঠানটিও মার্কিন নিষিদ্ধ তালিকায় চলে যায়। একই কারণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সবকিছুই তাঁদের কিনতেও হতো অনেক বেশি দামে। এই টাকাগুলো তারা ব্যয় করেছেন কেবল জনগণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী কেনায়।
সার ও কীটনাশক ছাড় কৃষির পরীক্ষা কিউবাতে এমন সময়ে শুরু হলো, যখন এর বিপদ সম্পর্কে মানুষ জানলেও কোনো বড়সড় প্রবণতা হিসেবে বিশ্বজুড়ে এটা শুরু হয়নি। জৈব সার তৈরির, জমির উর্বরতা বৃদ্ধির, প্রকৃতির ক্ষতি না করে ফসলের যত্ন নেওয়ার নিত্যনতুন পদ্ধতি শুধু কিউবা আবিষ্কার করল না, পোকা নিয়ন্ত্রণ ও রোগ দমনেরও এমন সব কায়দা তারা গ্রহণ করল যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাণের ক্ষতি করে না। এই পদ্ধতি তাদের প্রকৃতিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে এলো, প্রতিবেশ হয়ে উঠল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। বিষক্রিয়া আর দূষণজনিত বহু ব্যাধি কিউবাতে এখন অজানা। গড় ক্যালরি নেওয়ার হার যুক্তরাষ্ট্রে কিউবার চেয়ে সামান্য বেশি, কিন্তু ওজনহীন আর অতিরিক্ত ওজনের উভয় ধরনের রোগীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক গুণ বেশি। শিশুমৃত্যুর হার যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিউবায় কম, গড় আয়ু উভয় দেশে প্রায় সমান।
৬.
মাঝেমধ্যে ভাবি, বিদেশি অবরোধ না থাকলে কিউবা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু করতে পারত, আরো মহান কোনো দৃষ্টান্ত রাখতে পারত। আবার মনে হয়, এই প্রতিবন্ধকতাই তাকে তার যাবতীয় মহত্ত্বের মুকুটটাও পরিয়ে দিয়েছে। প্রতিটা সংকট পাড়ি দিতে কিউবা আবিষ্কার করেছে নতুন প্রযুক্তি শুধু না, নতুন সামাজিক সম্পর্কও। গণতন্ত্রের মানে যে শুধু ভোট নয়, সম্পদের ওপর অধিকারও, সেই সত্যটাও আমরা নতুন করে শিখি কাস্ত্রোর কাছে।
অত বড় অক্টোবর বিপ্লব, পৃথিবীতে যার অর্জন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, তার ধসে যাওয়ার কারণ নিয়ে তাই আবারও কয়েকটি কথার পুনরাবৃত্তি এই সুযোগে করা যাক :
প্রথমত, মার্কস স্বপ্ন দেখেছিলেন আমলাতন্ত্র নয়, জনগণের হাতে ক্ষমতা থাকবে সেটার। সামরিক বাহিনীর বিলোপ, সশস্ত্র রূপে শ্রমিকশ্রেণির দায়িত্ব গ্রহণ। রাষ্ট্রের শুকিয়ে মরার। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্ম দিয়েছিল পৃথবীর বৃহত্তম আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, কার্যত তা দক্ষতা ও জবাবদিহির সংগতকারণেই পুঁজিবাদীদের তুলনায়ও বহুগুণ অদক্ষ হয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয়ত, যে বিপুল সামরিক বাহিনী সে গড়ে তুলেছিল, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল নতুন এক উদ্ধৃত্তভোগী শ্রেণি। বরং এই বিপুল অর্থ মানুষের জীবনমান ও নিত্যনতুন গবেষণায় ব্যবহার করা গেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর সামনে আরো বড় অগ্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত। নারী প্রশ্নেও সোভিয়েত বিপ্লবের চেতনা বাকি দুনিয়ায় বিরাট একটা অগ্রগতি আনতে বাধ্য করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অগ্রগতিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সাম্যের স্তরে নিয়ে পৌঁছাতে পারেনি।
তৃতীয়ত, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধাস্ত্রের জন্য বিপুল বরাদ্দ করলেও পরিবেশ রক্ষা করে বিকল্প প্রযুক্তি ও জ্বালানির উৎস উদ্ভাবনের দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোড়নে নেতৃত্ব দিতে পারেনি, বরং অকাতরে নিজ দেশের নদী-অরণ্য-ভূমিকে পুঁজিবাদীদের কায়দাতেই ব্যবহার করেছে। অথচ বোমাবাজ মার্কিনের বিপরীতে সোভিয়েতদের পক্ষে সম্ভব ছিল বিকল্প ও নিরাপদ প্রযুক্তি ও জ্বালানির ক্ষেত্রে বিশ্বনেতৃত্ব দখল করা, দরিদ্র রাষ্ট্র ও বিশ্বজনমতকে এই দিক দিয়েও তার শ্রেষ্ঠত্বের বলয়ে টেনে আনা।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক নীতির ক্ষেত্রেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বহু দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে কার্যত অর্থ ও নানা রকমের ভর্তুকি প্রদান করে অনুগত একটি আন্দোলন গড়ে তোলে। এর ক্ষতিকর দিকটি হলো দেশে দেশে স্বাধীন ও স্থানীয় পরিস্থিতির উপযুক্ত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে না পারা। সোভিয়েত মুখাপেক্ষী কমিউনিস্ট দলগুলো ইরান, বাংলাদেশের মতো বহু দেশে সোভিয়েত নির্দেশনা অনুযায়ী বুর্জোয়া দলগুলোকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে বা টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল। নব্বইয়ের আগে সোভিয়েত ভর্তুকি এ দেশের বাম রাজনীতির একটা বড় অংশকে নির্মাণ করেছিল, এটা ছিল প্রগতিশীলদের একটা বিরাট দুর্বলতা। ফলে সোভিয়েত ভর্তুকির রাজনীতি, সাহিত্যচর্চা ও বই পড়া উঠে গেলে এই সবকিছুতেই ধস নামে। বামপন্থীদের অন্য অংশটি আসলে ধসে গিয়েছিল সত্তরের দশকের শুরুতেই। ফলে এই হতাশ ও সাবেক বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা বিদেশি তহবিলে পুষ্ট হয়ে গোটা দেশে রাজনীতির বিরুদ্ধে, উচ্চতর একটা কিছুর আকাঙ্ক্ষায় কাজ করার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিল, সেটাই ছিল দশকের প্রধান নির্ধারক চরিত্র। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একই রকম নেতিবাচক ভূমিকার কথা চীনের বেলাতেও উল্লেখ করা যাবে।
আনুগত্য ও বশ্যতার এই মনোবৃত্তি পুরোটা দূর হয়েছে বলে মনেও হয় না; বরং সোভিয়েতের স্মৃতিচারণে বা চীনের ওপর বাড়তি ভরসায়, এমনকি ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি মুগ্ধতায় আমাদের কমিউনিস্টদের একাংশ যে বংশবদতার পরিচয় দেন, তা এই স্বাধীন চিন্তার অনুপস্থিতিরই উপসর্গ। তবে ভরসার কথা, এই পরজীবীতা বাস্তব কারণেই বেশ খানিকটা দূর হয়েছে, বরং তিক্ত বাস্তবতা সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার, আত্মআবিষ্কারের সম্ভাবনার।
এবং শেষত, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন জনগণের সম্মতি গ্রহণ ও শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ফলে যতই মহৎ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটির জন্ম হোক, অচিরেই সে জনগণের প্রতি জবাবদিহির কার্যকর কোনো পথ গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে জনগণের দিক থেকে সবকিছুই ছিল হয় চাপিয়ে দেওয়া, নতুবা এমন একটা কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, যেখানে তার ব্যক্তিগত ভাবনা বা উদ্যমের গুরুত্ব নেই। জনগণ থেকে এই বিচ্ছেদও সামরিক ও বেসামরিক আমলা, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের একটা চক্রের হাতে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করে, পূঞ্জীভূত করে। একসময়ে রাষ্ট্রটা তাদের দখলেই চলে যায় পুরোপুরি। চীন এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার আরো কার্যকর নিদর্শন হলেও, সংকটগুলোকে উন্নততর ব্যবস্থাপনা দিয়ে মোকাবিলা করলেও এই মহাদুর্বল ফাটল তার রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতর রয়েই গেছে।
সোভিয়েত আমলাতান্ত্রিকতা ও সর্বব্যাপী গোপন ক্ষমতা ও নজরদারির ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল যোশেফ স্তালিনের হাতে, সম্ভবত তাঁর হাতেই সেটার বিনাশ হয়েছিল। দৃশ্যত একটা জনকল্যাণমূলক কাঠামোর ভেতরেই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল, সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বাকি কোনো দেশই এই আসর থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। পৃথিবীর জন্য দৃষ্টান্তমূলক ইতিবাচক পদক্ষেপে দৃষ্টান্ত না হয়ে তাদের স্বার্থ হয়ে দাঁড়াল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি, মার্কিন সামরিকতন্ত্রের মতই যে ‘নিরাপত্তাতন্ত্র’ গড়ে উঠেছিল, অস্ত্রের পেছনে মেধা-শ্রম ও ক্ষমতা বিনিয়োগেই তাদেরও পুষ্টি। যদিও এ কথা আমরা ভুলতে পারি না যে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে প্রতিবেশীদের আগ্রাসী ঘেরাও করার মনোভাবই প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু আমাদের এও ভুললে চলবে না যে আত্মরক্ষার গণনির্ভর ব্যবস্থার বদলে তারা যে পথের ওপর নির্ভরশীল হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের পতনই ডেকে আনে।
মানব ইতিহাসে অভিজ্ঞতার অপরিসীম মূল্য রয়েছে। সোভিয়েত বিপ্লব ছিল অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা। এমন একটি বিপ্লবকে রক্ষার দার্শিনক ধারণাটি মার্কসের কল্যাণে খানিকটা তৈরি থাকলেও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে আমরা মেনে নিতেই পারি সোভিয়েত বিপ্লব এই আত্মরক্ষার পথ ও পদ্ধতি প্রথমত মতাদর্শিক ও দ্বিতীয়ত প্রায়োগিক উভয় দিক দিয়েই ভ্রান্ত প্রমাণিত হলেও মানুষের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চিন্তার ইতিহাসেও এটা একটা সংযোজন এবং এই অভিজ্ঞতা হয়তো ইতিহাস এড়িয়ে যেতে পারত না। এবং এই পরিণতি অনুমাণ করে নিশ্চয়ই সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধাররা, বিশেষ করে স্তালিন এই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধানতম কুশীলব হননি, ভিন্ন চিন্তাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেননি। একমাত্র এই মহাকালিক বিবেচনাতেই স্তালিন ও তার সহকর্মীরা দায়মুক্তি পেতে পারেন।
অন্যদিকে, ঐতিহাসিক আরেকটি প্রেক্ষাপটও আমরা স্মরণ রাখতে পারি। সোভিয়েত, চিন ও কিউবা তিনটি রাষ্ট্রেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে পশ্চাৎপদ সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই। এমনকি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিও এই রাষ্ট্রগুলোর কোনোটিতেই সামান্য শক্তিশালী অবস্থাতেও উপস্থিত ছিল না। ফলে এর প্রতিটিই প্রবল বিরূপ বিশ্বপরিস্থিতির শিকার হয়েছে। অন্যদিকে উন্নততর অর্থনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল তেমন দেশগুলোতেই পুঁজিবাদ তখনো ক্রমবিকশিত হতে পারছিল। ফলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শেষ পর্যন্ত এই অনুন্নত দেশগুলোর জাতীয়তাবাদী কিংবা জাতীয় বিকাশেই অনেকখানি অগ্রগতি অর্জন করতে পারলেও স্বার্থ সংক্ষুব্ধ বিশ্বপরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকতা ও সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিবেচনার ঊর্ধ্বে ওঠাও প্রায় কখনই সম্ভব হয়নি।
কিন্তু তাই বলে এসব বিপ্লব ব্যর্থ নয়। বিপ্লব যে প্রবল আত্মশক্তি ও ত্বরণের সৃষ্টি করেছিল, তারই ধাক্কায় এদের প্রত্যেকেই প্রায় আদিম রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলস ভেঙেচুরে অনেকদূর অগ্রসর করতে পেরেছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। জাতীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি স্তরে বিপুল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, শত শত বছরের পশ্চাৎপদতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে প্রবল প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করে। রাতারাতি তা অন্য অগ্রসর দেশগুলোকে ছুঁয়েছে বা ছাড়িয়ে গেছে। জনশিক্ষায়, বিজ্ঞানে, সংস্কৃতিতে, মানববিদ্যায় এবং মানবসম্পদের রূপান্তরে, নারীর বন্ধনমুক্তিতে এবং গবেষণায় এদের প্রত্যেকেই মৌলিক ভূমিকা রেখেছে। এদিক দিয়েও বিবেচনা করলে এই বিপ্লবগুলো মানব সভ্যতারই বিপুল অর্জনের স্মারক। বিশ্বজুড়ে নারীর ভোটাধিকার অর্জন সোভিয়েত বিপ্লবের প্রত্যক্ষ চাপে হয়েছিল, ট্রেড ই্উনিয়ন অধিকার প্রদান, নাগরিকদের গড় জীবনমান ভালো করার জন্য নানাবিধ উদ্যোগ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোও নিতে বাধ্য হয় বিপ্লবকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানে সেই সুবিধাগুলো কেড়ে নেওয়ার তোড়জোর চলছে, একই সঙ্গে তা শ্রমিকের মুক্তির লড়াইকেও পুঁজিবাদী দুনিয়াতেও ছড়িয়ে দিয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এরা সকলেই বিশ্ববিপ্লবের ইতিহাসে একেকটি স্তর। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই ভবিষ্যতের বিপ্লবকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কিউবার স্বপ্নবৃক্ষ যদি শুকিয়েও যায় বিরূপতম সময়ে, অক্টোবর বিপ্লবের চেতনা কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। অজস্র নতুন আলোড়নের বীজ সে ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়। ‘এই পথে আলো জ্বেলে, এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।’