আমার প্রিয় কবি বিমল গুহ

সৎ কবি, তদুপরি সজ্জন—এ দুই বিরল সৌন্দর্যের সমন্বিত নাম বিমল গুহ। আমার প্রিয় ও বিশ্বাসী মানুষদের একজন। এত অকপট কবি এখন কোথায় মিলবে? যাঁর দর্শনেই প্রশান্তি, সংগতে নিরাপদ আনন্দ, আলাপে বিরল বিনয়। আর বিমলের হাসিটি প্রকৃতই বিমল। বিমল গুহ আমার বিরলসংখ্যক প্রিয় কবিদের অন্যতম। ষাটের আশীর্বাদে এই সদাসন্ত্রস্ত বাংলাদেশে পঞ্চাশের কোঠায় পা রাখলেন তিনি। আর সবচেয়ে গৌরবের কথা, নতুন সৃষ্টির উদ্যমে এখনো তরুণ তিনি। তাঁকে আমার পক্ষ থেকে অগ্রজের অনিন্দ্য অভিনন্দন।
এ পর্যন্ত প্রকাশিত ছয়টি কাব্যের মোড়কে বিমল গুহর কবিব্যক্তিত্বকে মোটামুটি ছেঁকে আনা সম্ভব। যদি একটি মাত্র অভিধা দিয়ে তাঁকে চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে বলব, বিমল গুহ আপাদমস্তক রোমান্টিক কবি। কি বিষয়ে, কি শব্দ ব্যবহারে, কি উপমা উদ্ভাবনে, এমনকি ধ্বনি ও ছন্দের লিরিক অনুরণনেও তাঁর রোমান্টিক স্বভাবপ্রাধান্য মূর্ত হয়ে ওঠে।
বিমল গুহর প্রথম কাব্য অহংকার, তোমার শব্দ নির্দোষ ভালোবাসার কাছে সমর্পিত একগুচ্ছ মধুর কবিতা। প্রণয়ের বানবেঁধা দুটি চোখে চরাচরে যা-কিছু দেখেছেন কবি, সবেতে মুগ্ধতার আবেশ মাখানো। নারী-নিসর্গ-নিখিল স্বপ্নিল চোখের মাধুরীতে মোড়ানো। সাগর-নদী-পাহাড়-আকাশজুড়ে কবির দিব্য বিচরণ। আমার মতো প্রবীণ পাঠকের খেদ এই, সেখানে ইনটুইশনজারিত কোনো গূঢ় দর্শন অন্তর্বর্তী নিয়ন্ত্রকের কাজ করে না, শুধু আবেশ শুধুই আরতি। তবে শ্রদ্ধা করি কবির নান্দনিক বিশুদ্ধিকে। তাঁর রুচিবোধে কাব্যিক শালীনতাকে কোথাও অত্যাধুনিকতার মোহে অতিক্রম করেনি। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য সুন্দর বাকপ্রতিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে কোনো কোনো কবিতার চরণ। তাঁর ‘জলের কাছে’ কবিতায় কী সরল সাবলীল অথচ নতুন ভাষায় অনুরাগের অভিব্যক্তি :
‘তোমার জন্যে জনম জনম নৌকোতে পাল তুলে
ফিরে ফিরে জলের কাছে আসা।’
বিচ্ছেদ ও স্মৃতিকাতরতায় আর্ত এ রকম আরো দুটি চরণ তুলে দিচ্ছি ‘হারিয়ে যাওয়া সহজ নয়’ কবিতা থেকে :
‘পাখিও হারিয়ে গেলে ঘরময়
পাখির পালক পড়ে থাকে’
ব্যক্তিগত স্বস্তিবোধ করছি, বিমল গুহ ‘নৌকো’ বানানটাই ব্যবহার করেছেন। আঞ্চলিকতার কুপ্রভাবে বাংলাদেশে আধাশিক্ষিত সাংবাদিক থেকে শুরু করে অনেক কবি-সাহিত্যিক ‘নৌকা’ লেখেন। তবে ‘সাম্রাজ্ঞী নামলেন রিকশা থেকে/পাছায় বিছার ঢেউ তুলে’ (‘শান্তির পায়রা’)-এর মতো কুশৈল্পিক বা ‘পাথুরে মূরতি এখনো দাঁড়িয়ে আছো’ (মুখোমুখি)-এর মতো তেলেজলে অপমেশালের দুর্ঘটনা ক্বচিৎ পীড়াও বাড়ায়। এসব বিসদৃশ ব্যবহারকে ‘ক্বচিৎ’ বলেছি এই কারণে, মূলত তিনি সুন্দরের কবি। এ সত্য ধরা পড়ে তাঁর ব্যবহৃত উপমা-প্রতীকের নিজস্ব শৈলীতে। এ কথার সপক্ষে পাঁচটি নির্বাচিত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক :
ক) ‘ক্ষুর্ধাত পৃথিবীও বুকে নেয় রাতের গণ্ডার’,
[‘ক্ষুধা’]
খ) ‘মানুষের দৃষ্টি থেকে বৃদ্ধ শকুন
মণি তুলে খায়’;
[‘অসঙ্গতি’]
গ) ‘পৌত্তলিক মেঘের আড়ালে ডুবে গেলো’;
[‘যে কোন মুহূর্তে’]
ঘ) ‘ট্রাক-ট্রাক জোছনা উধাও হলো’
[ঐ]
ঙ) ‘পৃথিবীর নড়বড়ে মেরুদণ্ড কাঁপছে কেবল’
[‘খুন’]
বিমল গুহর কব্জির জোর ধরা পড়ে এরকম সব উৎপ্রেক্ষা নির্মাণে :
‘মূলত শব্দই মূর্ত শক্তিমান কবি
উচ্চারিত হতে হতে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়।’
মাঝেমধ্যে তাঁর বিচিত্র কথ্যরীতি চমকে দেয় আমাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কবিরা কতখানি স্বাধীনতাবিহারী। তাঁর ‘মধ্যাহ্নের টোকা’ কবিতা থেকে দুটো উদাহরণ নেওয়া যাক :
‘বিস্মৃতি ফুঁকাই দিনে রাতে’ কিংবা ‘ভীষণ রগড়ে গেছি’
তবে বিমল গুহ সম্বন্ধে বড় কথা এই, তিনি স্মিত রসের কবি। অতি হৃদয়সংবেদী তাঁর কবিতা। এটাই প্রধান সুর তাঁর। যদিও দ্বিতীয় কাব্য, অর্থাৎ সাঁকো পার হলে খোলাপথ থেকেই সংসারের রূঢ় বাস্তবতা কবিকল্পনাকে প্রয়োজনে কুলিশকঠোর করে তুলেছে। স্বজন হারানো একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য তাঁর একাধিক কবিতার বিষয়বস্তু হয়েছে। এমনকি প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে দ্বিতীয় কাব্যের শেষ কবিতা ‘আগামী উৎসবে’ অনাগত স্বপ্নের দিন গুনেছেন কবি, সেটাই একজন সৎ কবির শেষ আশ্রয়।
তৃতীয় কাব্য স্বপ্নে জ্বলে শর্তহীন ভোর-এ কবি যেমন প্রতিরোধে প্রত্যয়ী [‘দ্বৈরথ’], তেমনি মানবতাবোধে উদ্দীপিত [‘প্রেক্ষাপট-৩]। চতুর্থ কাব্য ভালোবাসার কবিতাতে কবি ফিরে গেছেন তাঁর নিজস্ব প্রেমার্ত লিরিক সুরে। তবে এবারের উচ্চারণে পরিণতকণ্ঠ তিনি। নষ্ট মানুষ ও অন্যান্য কবিতা বিমল গুহর পঞ্চম কাব্য। কবি এখানে সমাজ-জীবনের কাছে অনেক দায়বদ্ধ। বিষয় নির্বাচনেও সিরিয়াস। তাঁর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ‘পরিচিত পথ’ ও ‘নূর হোসেন’ এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা। ষষ্ঠ কাব্য প্রতিবাদী শব্দের মিছিল মিশ্র বিষয়ের কাব্য। রোমান্টিকতার সরণি থেকে আরো বেশি বাস্তবের রূঢ় সত্যে সরে এসেছেন কবি। মানবসমাজের স্মরণীয় সব ব্যক্তিত্ব নেলসন ম্যান্ডেলা, বঙ্গবন্ধু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কবিতা লিখেছেন।
এইই তো শেষ নয়। কেবলই অর্ধশতকের চৌকাঠে পা ফেলেছেন কবি। শতবর্ষ বাঁচুন তিনি, অমিত সৃষ্টিসম্ভারে সমৃদ্ধ হোন তিনি। কবির কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে আমরাও বলি সমস্বরে :
‘প্রত্যুষে সাজাই বসে একবিংশ শতাব্দীর নতুন কবিতা,
এইভাবে শুদ্ধ হয়ে উঠি প্রতি ভোরে।’