হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প : নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণ

হুমায়ূন আহমেদের প্রতি একশ্রেণির পাঠক-পাঠিকার প্রেমের অংশভাগী হওয়ার চেষ্টায় তাঁর কিছু প্রেমের গল্প পড়ে ফেলা যাক। ‘রূপা’ গল্পের ন্যারেটর স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ এক যাত্রীকে একটি ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে চান। তা হলো— একসময় তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ছাত্র, রসায়নের একটি মেয়েকে তাঁর ভীষণ ভালো লেগে যায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে ভুল ঠিকানায় অন্য মেয়েকে চিঠি দিয়ে জানান— আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। তাকে রাজি হতেই হবে। ড্রাইভার ভুল ঠিকানা দিয়েছিল। সে এমন একটি মেয়ের বাড়ির দরজায় চলে আসে যে রসায়নের সেই ছাত্রী নয়। সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত এই মেয়েটির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, ভারি বর্ষণেও অবিচল থাকে। একসময় জানা যায়, মেয়ে তার অবস্থা দেখে কাঁদছে, মেয়ের বাবা পুলিশ আনতে উদ্যত হন। শেষপর্যন্ত মেয়েটি তাঁকে বাড়িতে ডেকে নেয়, হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। এই মেয়েটির সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। এটাই তাঁর ইন্টারেস্টিং গল্প। রোমান্টিক ইচ্ছাপূরণের বিভ্রান্তির গল্প।
‘একটি নীল বোতাম’ গল্পের ন্যারেটর এশা নামে একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিল। এই বর্ণনাকারী রঞ্জু এশার বাবার সঙ্গেই গল্প করে, মেয়ের সঙ্গেও। রঞ্জু একটি অ্যাড ফার্মের সামান্য কর্মী। স্বপ্নবাজ রঞ্জু তার হোস্টেল ঘরে ফুল, ছবি দিয়ে সাজায়, দেয়াল চুনকাম করে। বন্ধুরা এসে ঠাট্টা করে। ইচ্ছে করে ঘর নোংরা করে। গল্পের ক্ল্যাইম্যাক্স হলো— এশার বিয়ে ঠিক হয় এক কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। রঞ্জু একটি নীল বোতাম পেয়েছিল এশার। এটাকেই সে অপরাজিতা ফুল মনে করে। এ হলো প্রেম ব্যর্থতার, ধনী-দরিদ্রের মনোকষ্টের সনাতন গল্প। ‘কল্যাণীয়াসু’ গল্পে আছে প্রেমে ব্যর্থতায় দীর্ঘশ্বাস, পূর্বতন স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার আকুতি, রুশ চিত্রগ্যালারি, দস্তয়েভস্কি নেহাৎই বাহ্যিক উপকরণ। জয়ী কেন যে বয়স্ক স্যারকে ভালোবেসেছিল, কেন সে শিল্পী স্বামীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করল, কেন এ ‘শূন্যতা বুকের ভেতরে হা হা করে’ তার কারণ সন্ধানে তৎপর নন লেখক।
‘দ্বিতীয়জন’ গল্পের নববিবাহিত প্রিয়াঙ্কার অসুখ, পাগল বোধ, অস্থিরতা, পাশের ঘরে কিসের যেন শব্দ, এ কেন ‘ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ’ এ প্রশ্ন উঠবে। এ গল্প, প্রিয়াঙ্কা ও জাভেদের গল্প পাঠককে জড়াবে কোন সূত্রে? ‘চোখ’ গল্পে মনস্তত্ত্ববিদ মিসির আলির কাছে আসে টেক্সাসের গণিত অধ্যাপক রাশেদুল করিম, যে তার দাম্পত্যের কথা, স্ত্রী জুডির ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার কথা, রাশেদুলের আঁকা ছবি ইত্যাদি। চরিত্রদ্যোতক গল্প— খারাপ নয়। ‘একজন ক্রীতদাস’ গল্পে একজন ব্যবসায়ী, তার বিয়ে হবে পারুলের সঙ্গে, বিয়ের দিনই সে ফোনে বলে মাস্টারি পেয়েছি, বিয়েটা পিছিয়ে দাও, তারপর অন্য জায়গায় বিয়ে, গল্প শেষে আমিরের উপলব্ধি ‘প্রেম নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার’।
গল্প ‘সঙ্গিনী’তে বলা হয় ‘প্রেমের ক্ষমতা যে কী প্রচণ্ড হতে পারে, প্রেমে না পড়লে বোঝা যায় না।‘ মিসির আলি গল্প বলে চলে, স্বপ্নের, মনের কথা বলে— কিন্তু আজকের দিনে এ গল্প কোন দিক থেকে গণ্য হতে পারে? ‘শঙ্খমালা’ গল্পে উপলব্ধি—‘আমরা খুব দুঃখ পুষে রাখি। হঠাৎ হঠাৎ এক একদিন আমাদের কত পুরানো কথা মনে পড়ে।’ ঠিক আছে, কিন্তু এই রোমান্টিক গল্পে জানা যায় অভিমানী দাদা পরী-বঞ্চিত হয়ে আত্মহত্যা করেছিল, বাবা মাকে সান্ত্বনা দেয়—‘কাঁদে না, কাঁদে না।’ আর নায়ক আকাশভরা জ্যোৎস্নার দিকে চেয়ে পরী আপাকে ক্ষমা করে দেয়। এই অভিমানের গল্পকেও বিষাদমণ্ডিত শিল্পরূপ দেওয়ার জন্য যে রীতিকুশলতা দরকার ছিল, দুঃখের বিষয় তা এখানে নেই।
‘অচিনবৃক্ষ’ চরিত্রদ্যোতক গল্প, যাতে তিনি হেডমাস্টার চরিত্রটিকে সাধ্যমতো নির্মাণ করেন। ‘নিশিকাব্য’ দাম্পত্য প্রেমের স্নিগ্ধ গল্প, চলনসই, তবে হুমায়ূনের গল্পে খুব বেশি পরী, জ্যোৎস্না, সুখ-দুঃখের সাথী চাঁদ এসে ভিড় করে। ‘ভালোবাসার গল্প’ রঞ্জু, নীলুর প্রেমের মিষ্টিমধুর গল্প, কিন্তু অন্যত্র বিয়ে ঠিক হওয়ায় দুঃখে শেষ হয় গল্প। ‘নন্দিনী’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের আবহ আছে শুধু বহিরঙ্গ সজ্জায় নয়। নন্দিনীর বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, আজিজ দালাল বলে মুক্তিবাহিনীর হাতে মরেছে, যদিও নন্দিনী তারই বউ, সে ইন্ডিয়া পালাতে চেয়েছিল। এই একটি গল্পে তীব্র সামাজিক প্রসঙ্গ চরিত্রগুলোকে আলোড়িত করে। ‘লিপি’ এক আমেরিকান দম্পতি প্রেম ও বিষাদের সুন্দর গল্প, যাতে একটু বুদ্ধিজীবীত্বের ‘ব্যাখ্যা’ দেওয়া আছে। সেটা হলো লুপ্ত ভাষার পাঠোদ্ধার, যদিও গল্পে তার গুরুত্ব প্রযুক্ত হয়নি। কিন্তু তবুও স্ত্রীর সঙ্গে ঝটিতি প্রেম, অল্প দিনেই তার মৃত্যু গল্পটির সংহতি তৈরি করেছে। ‘পিশাচ’ গল্পে আছে পিশাচ সাধকের কথা, যে ভালোবাসার সমুদ্র ধারণ করে পিশাচ হওয়ার সাধনা করে যাচ্ছে। ‘বিভ্রম’ গল্পে মিলি ও সুজাতের রেস্টুরেন্টে আলাপচারিতা, পারস্পরিক যাচাই, পছন্দ ও বিয়ে। যে সংকলনটির গল্প এগুলো, তার নাম— ‘প্রেমের গল্প’। লেখক বলেছেন, এগুলো প্রেমের গল্প, প্রেম শুদ্ধ ও পবিত্র বিষয়, প্রেম ব্যাপারটার অনুধাবন কঠিন কর্ম ইত্যাদি। পাঠক বুঝবেন এ বইয়ের গল্পগুলোর বিষয়বস্তু দেশকালাতীত রোমান্টিক লঘু চিত্ত প্রেম। আর গল্পের ক্র্যাফট আশানুরূপ নয়।
কিশোরদের জন্যও অনেক লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় দুটি জিনিস ছিল— জ্যোৎস্না রাত ও শিশু। এবার কিশোরদের জন্য লেখা কয়েকটি গল্পের কথা তোলা যেতে পারে। ‘গোবরবাবু’ বেশ মজার গল্প। স্কুলের ব্যায়াম শিক্ষক ইয়াকুব ব্যায়ামের ওপর বই লিখেছেন, ছাত্রদের ব্যায়াম করান কবিতায়। হেডমাস্টার বিরক্ত, একদিন তিনি ইয়াকুবকে সাসপেন্ড করলেন। বিপত্নীক ইয়াকুব মনের দুঃখে যখন খিচুড়ি রাঁধছে, তখন এক ভূত এসে তার দুর্বল ছেলেটিকে সবল করার প্রার্থনা করল। এই বাচ্চা ভূত চাঁদের আলো খায়, তাকে চিবিয়ে খেতে বলা হলো, জোনাকি ধরে নিয়ে আসে ইয়াকুবের জন্য। ভূতের বাচ্চা তার কাছে থাকে। একদিন সে হেডমাস্টারকে, অন্যদিন এক ওসিকে গাছের ওপর তুলে দিয়েছিল। গোবর হলো এ ভূতের নাম। কিন্তু তাকে কোনো স্কুল-কলেজ ভর্তি করতে চায় না। এ গল্পে দু-একটি নীতিকথা আছে। যেমন : জগতের সমস্ত ভালোমানুষ সরল ধরনের হয়ে থাকেন, অথবা স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল বা এ যুগের পড়াশোনার মান খুব নিচে নেমে গেছে (এটি অবশ্য নীতিকথা নয়, মন্তব্য)।
কিছু মজার সিচুয়েশন অবশ্য আছে। কিন্তু গল্পত্বের মজা ছাড়া গল্পশৈলীর আর কী বা আছে। ‘নিউটনের ভুল সূত্র’ গল্পের মুখ্যচরিত্রও এক শিক্ষক যিনি বিজ্ঞাননিষ্ঠ, কিন্তু একদিন তিনি শূন্যে উঠে গেলেন, সিলিং-এ ঝুলন্ত অবস্থায় কিছু লিখলেন। সবাই ভাবল মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এক বিজ্ঞানী তো তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে পরামর্শ দিল, লোকে ঠাট্টা করে। শেষ পর্যন্ত নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্র বোঝাতে লাগলেন শীতের রাতে বানরদের। একসময় এ অঞ্চল ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। মাঝে মাঝে তিনি একটি চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে তার অবস্থা, কৌতুককর পরিস্থিতি সৃজনের চেষ্টা করেন। ঝঞ্ঝাট-ভীরু মতিনউদ্দিনকে কেউ পছন্দ করে না, পাত্তা দেয় না, শেষপর্যন্ত কল্পজগতের শিশুরা তাকে ঘিরে রাখে। এখানে তিনি বিজ্ঞানবুদ্ধির প্রয়োগ করেন।
উল্লেখ্য, তিনি অনেকগুলো সায়েন্সফিকশন রচয়িতা। ‘নিমধ্যমা’ এক গল্পে ফেল করা বড় মামা সংগীত ও নাটকের আগ্রহী, কিন্তু তার খেয়ালিপনার জন্য বাড়ির লোকে তাকে গাঁধা বলে। মামা ও নববিবাহিতা মামির বিরোধ গল্পের শেষে আছে। মামিকে রাজকুমারী সুবর্ণরেখার সঙ্গে তুলনা করলে সে কাছে সরে আসে। (বড় মামা এবং রাজকুমারী সুবর্ণরেখা) রূপকথার আবহ আছে। ‘কানা ডাইনী’ গল্পে ভাবের গভীরতা কম। রূপকথার ঢং ‘রানী কলাবতী’ গল্পেও। আলাদীনের প্রদীপ আবার ফিরে এলো ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’ গল্পে। দৈত্যের কৃপায় শিক্ষক নিশানাথ সোনার বালতি পায়। কিন্তু তাতে চরিত্র মাহাত্ম্য কোনো দিকেই বিকীর্ণ হয়ে না উঠে গল্প শেষ হয়ে যায়। রূপকথা ও বাস্তবের মেলবন্ধন আছে ‘বনের রাজা’, ‘হলুদ পরী’, ‘নীল হাতি’, ‘আকাশ পরী’ প্রভৃতি গল্পে।
‘জাদুকর’ গল্পে আবার ফিরে এলো অ্যাডভেঞ্চার। ‘স্মৃতিচিহ্ন’ একটি কিশোর নাটিকা, যাতে শিশুর করুণা, পিতা-মাতার কাব্যপ্রিয়তা এক চমৎকার আবহ নির্মাণ করে। হুমায়ূন আহমেদ প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন শিশুদের জগৎ বুঝতে, শিশু ও বড়দের মনোজগতের ভিন্নমাত্রাকে ধরতে। তিনি চেয়েছেন রূপকথা, ফ্যান্টাসি থেকে বাস্তব— নানা কিছুর মধ্য দিয়ে শিশুর সুস্থ সূক্ষ্ম মনের উন্মোচন ও ক্রমবিকাশ।
চঞ্চল কুমার বোসের পিএইচডি স্বীকৃত বই ‘বাংলাদেশের ছোটগল্পের শিল্পরূপ’। মোটা কলেবরের এ বইয়ে হুমায়ূন আহমেদের গল্প সম্পর্কে লেখা হয়েছে মাত্র দুটি ছোট্ট অনুচ্ছেদে। অথচ হুমায়ূন আহমেদ তখন অবস্থান করছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। চঞ্চল বোসের বক্তব্য হলো— ‘তাঁর (হুমায়ূন আহমেদ) শ্রেষ্ঠ গল্প জীবনের ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম আনন্দবেদনা, স্বপ্ন ও ব্যর্থতার শব্দরূপ। নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন, তার বিচিত্র আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নিভৃত উন্মোচন ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে। ব্যক্তিজীবনের অম্লমধুর অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের জীবন যন্ত্রণার অন্তরঙ্গ রূপটিকে সরল বর্ণনার মাধ্যমে তুলে এনেছেন গল্পকার। খণ্ড ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এক বিপুল জীবনসত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে তাঁর গল্পে। মানুষের ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়া, সুখ-দুঃখ, মিলন-বিষাদই তাঁর গল্পের উপজীব্য।’ কিন্তু পাঠক যদি হুমায়ূনের লেখা পড়েন তাহলে তার চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের জীবন যন্ত্রণার ছবি হুমায়ূনের কথাসাহিত্যে প্রথাগতভাবে অনুপস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্যক্তিগত ভয়াবহ স্মৃতি থেকে সম্ভবত হুমায়ূন উত্তীর্ণ হতে চান তাঁর নিজের মতো করে এবং সেই কারণেই তিনি মোটেই মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার নন। বিপুল জীবনসত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় শিল্পনির্মাণের বিস্ময়কর নৈপুণ্যে। তাঁর লেখায় সরলতা আছে, লোকচলতি কথা আছে, মজা আছে, স্বপ্ন কল্পনা আছে, ফ্যান্টাসি আছে, কিন্তু পৃথিবীর ছোটগল্পের ইতিহাসের কথা বাদ দিচ্ছি, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের রচনায় যে জীবনসত্যের আশ্চর্য শিল্প নৈপুণ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত, দুঃখের বিষয় তা হুমায়ূনের রচনায় অতি সামান্য। তাঁর রচনা থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো আইডিয়া করা অসম্ভব। বরং কিশোর-গল্পে তাঁর কৃতিত্ব, কিশোর মনের স্বপ্নিল আনন্দ ও বিষাদে তিনি বৃহত্তর পাঠক পেতে পারেন, কিন্তু সিরিয়াস কথাসাহিত্যে তিনি উপভোগ্যতা দিয়েছেন, কিন্তু পাঠযোগ্যতা দিতে পারেননি।