বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ

‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান
সারামাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান
ধানে ধান লাগিছে বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়
কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কুল নাহি পায়।’
- জসীমউদ্দীন (নকশী কাথার মাঠ)
গ্রামবাংলার ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব। বাংলার মাস কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ। নীরবে আবির্ভাব ঘটে এই অগ্রহায়ণের। এ মাসেই ফসলের ক্ষেতে সোনালি হাসি আবার ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাতাসে উড়ে বেড়ায় নবান্নের ঘ্রাণ আর শিউলি ফুলের সৌরভ। এর সঙ্গে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় হিমেলের ছোঁয়া। সকাল-সন্ধ্যায় দেখা মেলে হেমন্তের মৃদু কুয়াশার।
কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এই মাঠে- এই ঘাসে- ফলসা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে/আজো তার; যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক- দুপুরের রোদে/সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি- অঘ্রানে যে ধান ঝরিয়াছে,/তাহার দু’এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদের/পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে/জানি সে আমার কাছে আছে আজো- আজো সে আমার কাছে আছে।’ কবির সেই ধানের অগ্রহায়ণ, নবান্নের অগ্রহায়ণ এসেছে বাংলার বুকে। আগামীকাল (বুধবার) বাংলা সেই মাসটির প্রথম দিন, নবান্ন উৎসব।
বাংলার কৃষক সমাজ সেই প্রাচীন কাল থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে। কালের পরিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসব পালন করতে ভুলে যায়নি আজও। গ্রামবাংলার কৃষকরা নবান্ন উৎসব পরিপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য মেয়েজামাইসহ আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে নতুন চালের পোলাও, পিঠা ও পায়েশ রান্না করে ধুমধামে ভূরিভোজের আয়োজন করে। গ্রামের বধূরা বাপের বাড়িতে গিয়ে নবান্ন উৎসব পালনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। নবান্ন উৎসবে কৃষকরা সবাই মিলেমিশে গরু, খাসি ও মহিষ জবাই করে। হাটবাজারের বড় মাছ কিনে আনে।
বছর ঘুরে আবার এসেছে সেই সময়। বাংলার ঘরে ঘরে উদযাপন শুরু হচ্ছে নবান্ন উৎসব। নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবে মেতেছে কিষান-কিষানি। ধানের ম-ম গন্ধে ভরে উঠেছে বাড়ির আঙিনা। বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য নতুন ধান কাটা ও সেই ধানের প্রথম অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। হেমন্তের এই কুয়াশা ভেজা দিগন্ত জোড়া মাঠে পাকা ধান ক্ষেতের হলদে রং দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভাসছে। প্রতিটি কৃষকের গোলাঘর ভরে যাচ্ছে আমনের নতুন ধান দিয়ে। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি হবে পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ নানান ধরনের খাবার।
গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে এখন কুয়াশার খেলা, ভোরের আলো ফুটতেই জেগে ওঠে চারপাশ। কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দ। কারণ, গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। যদিও অনেকের ক্ষেতে এখনো সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। কিন্তু আমন ধান কাটার উৎসবটা শুরু হয়ে গেছে আরো আগেই। কৃষক রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নিয়ে এসেছে ঘরে। ঢেঁকির তালে মুখর হচ্ছে বাড়ির আঙিনা। অগ্রহায়ণে কৃষক নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। নবান্ন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবে মেলা। সে মেলা পরিণত হবে গ্রামবাংলার মিলনমেলায়।
ইতিহাস বলে বাঙালির জীবনে পয়লা অগ্রহায়ণকে দেখা হয় বার্ষিক সুদিন হিসেবে। তাই নতুন ধানের ভাত মুখে দেওয়ার আগে অনেক এলাকায় মিলাদ পড়ানো হয়। মসজিদে শিরনি দেওয়ার রেওয়াজও আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকের ঘরে পূজার আয়োজনও চলে। নবান্ন উৎসব হিন্দুদেরও একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে।
নবান্ন উৎসবের অন্যতম প্রথা হচ্ছে কাকবলি। একটি কলার ডোগায় নতুন চাল, কলা, নারকেল নাড়ু কাককে খাওয়াতে হয়। প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। এ নিয়ে ছড়া আছে। ছোট ছেলেমেয়েরা ছড়া কেটে দাঁড়কাককে নিমন্ত্রণ করত।
কাকবলির আগে আরো তিনটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হতো লক্ষ্মীপূজা, পিতৃশ্রাদ্ধ, বীরবাঁশ। বীরবাঁশের প্রথা অন্য অঞ্চলে প্রচলিত না থাকলেও বরিশালে প্রচলিত। বাড়ির উঠানের মাঝখানে একটি গর্ত করা হয়। তার চারপাশে পিটুলি দিয়ে আলপনা আঁকা হয়। গর্তে জ্যান্ত কই মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোঁতা হয়। সে বাঁশের প্রতি কঞ্চিতে ধানের ছড়া বাঁধতে হয়। এটাকে বীরবাঁশ বলে।
এমন আরো বহু আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই বাঙালি বরণ করে নেয় নবান্নকে। নবান্ন শুধু উৎসব নয়, বাঙালির কাছে ঐতিহ্য, অবশ্য এখন যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে পুরোনো ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বদলে গেছে। তারপরও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো নবান্নকে বরণ করা হয় সেই পুরোনো ভালোবাসা নিয়েই।