মুক্তিযুদ্ধের এক অপূর্ব বয়ান ‘জলপাই রঙের কোট’

লোকটিকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাটিতে উবু হয়ে পড়ে আছে সে। ডান চোখের পাতা ফুলে বুঁজে গেছে চোখটা। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটের ওপর। ওপরের ঠোঁট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। ঢোল হওয়া ঠোঁটে গড়িয়ে পড়া রক্ত লেগে লাল রঙা ট্যাপট্যাপা শুয়ো পোকার মতো লাগছে। সে একটু পরপর বলছে-
‘আঁরে জানে মাইরো না। আঁরে জানে মাইরো না! আঁই নির্দোষ। আল্লাহর কসম খাই হইদ্দি, আঁই আর জীবনে এই কাজ ন...!’
লোকটির কথার শেষটা কেমন গোঙানোর মতো মনে হলো। শেষ শব্দগুলো স্পষ্ট বোঝা গেল না। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। নড়াচড়া করতে গিয়ে এক পাশে গড়িয়ে পড়ল বেঁধে রাখা মাংসের দলার মতো।’
ঠিক এভাবেই শুরু হলো ‘জলপাই রঙের কোট’। রবিউল করিম মৃদুলের উপন্যাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত এই বই আসন্ন অমর একুশে বইমেলা-২০১৮তে প্রকাশ করবে দেশ পাবলিকেশন্স। যুদ্ধকালিন এক অব্যক্ত, আনকোড়া গল্প জীবন্ত হয়ে উঠেছে ‘জলপাই রঙের কোট’-এর পাতায় পাতায়।
সাধারণত উপন্যাসের গল্পগুলো যেভাবে আগায়, জলপাই রঙের কোট ঠিক সেভাবে আগায়নি। এগিয়েছে একটা ভিন্নরূপে। অনেকটা গল্প শোনার ঢঙে। গল্প বলার ঢঙে। কখনো ১৯৭১, কখনো ২০১৬ আবার কখনো ফিরে গেছে শতবর্ষের অধিক আগে সেই ১৯৩০ এর দশকে। অতীত ও বর্তমানের মিশেলে এমন এক আলেখ্য লেখক নির্মাণ করেছেন এখানে, যা পাঠককে সহজেই বইয়ের ভেতর ডুবিয়ে দেবে।
উপন্যাসের মূল প্রটাগনিস্ট তার দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে বর্তমান সময়ে বের হয় নির্দিষ্ট একটি গল্প খুঁজতে। তারা গিয়ে হাজির হয় চট্টগ্রামে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধের সামনে।সে-ই মেলে ধরে গল্পের ঝাঁপি। তার ঝাঁপির ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে লোমহর্ষক সব বাস্তব অভিজ্ঞতার বয়ান। সে গল্প বলে, আঙুল তুলে ঘুরে ঘুরে দেখায় লোকেশন। ‘এইখানে, এই তো এইখানে এলএমজি নিয়ে বসে ছিলাম আমি। আমার ঠিক পাশে ছিল কফিল ভাই। আমাদের কমান্ডার। পজিশন নিয়ে বসে আছি আমরা। উত্তেজনায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এদিকে শ্বাস জোরে ফেলবার জো নাই। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রোড ধরে এগিয়ে আসছে পাক আর্মির বহর!’ এই বৃদ্ধ লোকটিকেই পরবর্তী সময়ে দেখা যায় কেন্দীয় চরিত্র রূপে। এই বার্ধক্যের চাদরের নিচে লুকিয়ে গেছে যে যৌবন, সেইকালে সে ছিল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।
বর্তমান সময়ে বসে বৃদ্ধের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে শুনতে জীবন্ত হয়ে ওঠে ৭১। মার্চের উত্তাল সেই দিনগুলো। সাত মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত্রি।
হানাদারদের অতর্কিত আক্রমণে পর্যুদস্ত বিপর্যস্ত ঢাকা। ঢাকার রাজপথ, ঢাকার মানুষজন। নির্দিষ্ট একটি পরিবার। গল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে যাদের জীবন্ত চলাফেরা করতে দেখা যায়। গল্প আগাতে থাকে। ৭১ ফিরে আসে আবার বর্তমানে। যেখানে বৃদ্ধ দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বিকেলবেলা তিন তরুণকে সাথে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। হাঁটতে হাঁটতে তারা গিয়ে হাজির হয় ইতিহাসের অনেক পেছনে। সেই ক্ষীরদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে। যেখান থেকে ধরা পড়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা সূর্যসেন।
গল্প ফিরে যায় একশ কুড়ি বছর আগে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সেই অগ্নিযুগে। সেই পর্বে জীবন্ত হয়ে ধরা দেন মাস্টারদা, বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। রেলওয়ে ডাকাতি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। চলে তথ্যনির্ভর জীবন্ত ইতিহাসের পাতায় হাঁটাহাঁটি। সূর্যসেনের বিপ্লব, প্রীতিলতার আত্মদান পাঠককে মুহূর্তেই ব্যথাতুর করে তুলবে এই পর্বে।
পরের পর্বেই আবার ৭১। এখানে দেখা মিলবে সুজিত নামের এক দুর্ধর্ষ যুবকের সাথে। লিকলিকে গড়নের যে যুবক হাত তিনেক দূর থেকে খানসেনা, দেশীয় দালালদের বুকে চালিয়ে দেবে গুলি। অথচ তার চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়বে না। বাবা মার অতি আদরের সন্তান সুজিতের সব বন্ধন অগ্রাহ্য করে যুদ্ধে চলে যাওয়া, ক্রমেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হয়ে ওঠা, একের পর এক সম্মুখ সমর জীবন্ত হয়ে উঠবে বিভিন্ন ভাগে। তারই ফাঁকে পরিচয় হবে আরো একটি পরিবারের সাথে। যে পরিবারটি ঘটনাচক্রে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের গৈরলা গ্রামে এসে আট ফুট বাই ছয় ফুটের একটি কক্ষে বন্দি। বাইরে চলছে যুদ্ধ। আর বন্দি ঘরের ভেতর তাদের যুদ্ধ কেবলই টিকে থাকার। কোনো রকমে বেঁচে থাকার। দুর্দশা, হতাশা, অনাহারের এক অবর্ণনীয় আখ্যান। এরই ভেতর সহজাতভাবেই কখনো কখনো ফুটে উঠবে ফুল কোমল হৃদয়ে। সুজিতের সাথে মন ছুঁয়ে যাবে ঘরবন্দি পরিবারের বড় মেয়ে দীপান্বিতার। তা ঠিক প্রেম নয়, অথবা প্রেম, অথবা তারও চেয়ে বেশি, অথবা অন্যকিছু।
গল্প আগাবে সামনে। তিন তরুণ ঘুরে ঘুরে দেখবে ঐতিহাসিক পটিয়া গ্রাম আর পাঠক পরিচিত হতে থাকবে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের সাথে। সবীরময় সেন, রেনুকা, বিমলা, সুষমা, মনসুর দর্জি, ছোট্ট মেয়ে কুট্টির সাথে। দেখা হবে ডাক্তার ইদ্রিসের সাথে। সাদা পাঞ্জাবি পরা গ্রাম্য ডাক্তার- ‘আই ডু সার্ভ ফর দ্য রুরাল পিপল। হোয়াট ইজ মাই ফল্ট?’ তার কথা কেউ শুনবে না। রক্ত শুষে নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে থাকবে ঘোষের হাটের শতবর্ষী সেই কড়ই গাছটা।
‘জলপাই রঙের কোট’-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো- এর তিনটি প্লট। প্লটগুলো একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে মিলে মিশে এগিয়ে গেছে গল্প। এই পাঠক চলে গেছে একাত্তরে আবার ফিরে এসেছে বর্তমানে। অতীতে হাঁটাহাঁটি করে ঘুরে এসে সেটার একটা পরিণতি দেখতে পাবে বর্তমানের বর্ণনায়। মিলাতে সক্ষম হবে কর্ম আর কর্মফল। জালের মতো গুটিয়ে আনতে পারবে তিনটি প্লটের উৎপত্তি, বিকাশ আর পরিণতি।
এমনিতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ রচনা খুব বেশি নেই। গল্প উপন্যাসও হাতেগোনা। সেদিক থেকে লেখক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন প্লট হিসেবে। শুধু বেছে নিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি, তার পরিস্ফূটনও ঘটিয়েছেন হৃদয় ছোঁয়াভাবে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই প্রজন্মেরই এক লেখকের কলমে মুক্তিযুদ্ধের গল্প সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এর মাধ্যমে আমাদের এই প্রজন্ম অন্তত কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারবে যে এই মানচিত্র, এই পতাকা এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে আছে কত ত্যাগ, কত রক্ত, কত মা-বোনের সম্ভ্রম! কী কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই স্বাধীন দেশ।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই উপন্যাস ‘জলপাই রঙের কোট’-এর প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশিত হবে অমর একুশে বইমেলা- ২০১৮তে। প্রকাশ করবে দেশ পাবলিকেশন্স।