পর্ব ১
দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস

১
বুড়ো হওয়া পাখিগুলো মৃত্যুর সময় কোথায় যায়?
তিনি গোরস্থানে বাস করতেন এক বৃক্ষের মত। ভোরে বিদায় দিতেন কাকগুলোকে আর বাদুড়দের জানাতেন গৃহে অভ্যর্থনা। সন্ধ্যায় করতেন উল্টোটা। এর মাঝখানে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন শকুন ভূতদের সাথে। যেসব ভূতরা দৃশ্যমান হতো তার উঁচু উঁচু ডালগুলোতে। তাদের নখগুলোর মৃদু খামচে ধরার স্পর্শ অনুভব করতেন তিনি। যেন কেটে ফেলা কোন অঙ্গের সূক্ষ্ম বেদনা। তিনি সিদ্ধান্তে আসতেন যে, নিজেদের অব্যাহতি দিয়ে সব মিলিয়ে খুব একটা দুঃখে নেই শকুনেরা। আর তারা বেরিয়ে পড়ত গল্পটি ছেড়ে।
যখন প্রথম এখানে তিনি থাকতে এলেন, মাসের পর মাস সহ্য করলেন দৈনন্দিন সব নিষ্ঠুরতা। অকুন্ঠিত চিত্তে, একটি বৃক্ষ যেমনটা করে থাকে। তাকে পাথর ছুড়ে মেরেছে কোন বাচ্চা ছেলেটা তিনি ঘুরেও দেখতেন না, ঘাড় ঘুরিয়ে পড়তেন না তার অপমানজনক বাণীগুলো। যখন লোকেরা তাকে আজেবাজে নামে ডাকত-সার্কাসবিহীন সঙ, প্রাসাদবিহীন রাণী- তিনি সেই আঘাতকে তার ডালপালার ফাঁক দিয়ে বইতে দিতেন মিষ্টি হাওয়ার মত। আর মর্মররত পাতাগুলোর সুরকে বানাতেন তার ব্যথার আরামের জন্য কষ্টনাশক।
একমাত্র যখন অন্ধ ইমাম সাহেব জিয়াউদ্দীন, যে এককালে নামায পড়াত ফাতেহপুরী মসজিদে, তাঁর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াল আর তাঁকে দেখতে আসা শুরু করল, তখন আশেপাশের লোকেরা ঠিক করল যে এইবার ওনাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তিতে থাকতে দেয়ার সময় হয়েছে।
বহুদিন আগে একজন লোক যে ইংলিশ জানত তাঁকে বলেছিল যে তাঁর নামটা উল্টো করে লিখলে (ইংলিশে) বানানটা দাঁড়ায় ‘মজনু’। লায়লা আর মজনুর ইংলিশ সংস্করণে, বলেছিল লোকটা, মজনুকে ডাকা হয় রোমিও আর লায়লাকে জুলিয়েট। বিষয়টা হাস্যকর ঠেকেছিল তাঁর কাছে।
“মানে আমি ওদের গল্পের একটা খিচুড়ী পাকিয়েছি?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। “যখন ওরা দেখবে লায়লা আসলে মজনুও হতে পারে আর রোমিও হতে পারে আসলে জুলি তখন কি করবে?”
দ্বিতীয়বার যখন তাঁর সাথে দেখা হল তার, ইংলিশ জানত যে লোকটা, সে বলল, তার একটা ভুল হয়ে গেছে। তাঁর নামটা উল্টো দিক থেকে বানান করলে হয় ‘মুজনা’, যেটা আসলে কোন নাম না এবং ওটার কোন অর্থও হয় না সেভাবে। এর উত্তরে বলেছিলেন তিনি, “এসবে কিছু যায় আসে না। আমি ওদের সবকটাই, আমি রোমিও আর জুলি, আমিই লায়লা আর মজনু। আর মুজনা, কেন নয়? কে বলে আমার নাম আঞ্জুম? আমি আঞ্জুম না, আমি আঞ্জুমান। আমি এক মহামিলন, আমি একটা সমন্বয়। সবার এবং কারোরই না, সবকিছুর এবং কোন কিছুরই না। আর কেউ আছে যাকে ডাকতে চাও তুমি? সবাই আমন্ত্রিত।”
সেই লোকটা যে ইংলিশ জানত, বলেছিল যে এরকমটা বলে তিনি বেশ বুদ্ধিমানের মত করেছেন। সে বলেছিল যে এমনটা তার নিজের মাথায় কখনই আসত না। তিনি বললেন, “কিভাবে আসবে, তোমার উর্দুর এই অবস্থা নিয়ে? কি মনে কর তুমি? ইংলিশ তোমাকে আপনা আপনি চালাক বানিয়ে দেবে?”
লোকটা হেসেছিল। তিনি হেসেছিলেন তার হাসিতে। তারা দুজন মিলে একটা ফিল্টার সিগারেট টানছিলেন। সে অভিযোগ করছিল যে উইলস নেভি সিগারেটগুলো ছোট আর কেমন মোটা মোটা আর অবশ্যই ওগুলোর এত দাম হওয়ার কোন মানে নেই। তিনি বলেছিলেন যে ফোর স্কয়ার অথবা ওই অতি পুরুষোচিত রেড এন্ড হোয়াইটের তুলনায় এগুলোকেই তার ভালো লাগে।
এখন আর তার নাম ওনার মনে নেই। হয়তো বা কখনও নামটা তিনি জানতেনই না। সে চলে গেছে বহুদিন হয়, সেই লোকটা যে ইংলিশ জানত, যেখানেই হোক তার যাবার কথা ছিল। আর তিনি সরকারি হাসপাতালের পিছনে গোরস্থানে বাস করছিলেন। সঙ্গী হিসেবে সাথে ছিল তাঁর স্টিলের গোদরেজ আলমারী। যেটার মধ্যে তিনি তার গানগুলোকে রেখেছিলেন-ঘষা খাওয়া রেকর্ড আর টেপ-একটা পুরোনো হারমোনিয়াম, তাঁর কাপড়চোপড়, গহনা, তাঁর বাবার কবিতার বইগুলো, তার ছবির অ্যালবাম আর কিছু খবরের কাগজ থেকে কাটা অংশ যারা খোয়াবগার আগুন থেকে বেঁচে ফিরেছে। একটি কালো সুতায় চাবিটাকে তিনি নিজের গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন তাঁর বাঁকানো রূপালী টুথপিকটার সাথে। তিনি ঘুমাতেন একটা জীর্ণ পারশিয়ান কার্পেটে। সকালবেলায় সেটাকে তিনি তালাবদ্ধ করে রাখতেন আর রাতে বিছিয়ে দিতেন দুটো কবরের মাঝে (একটা ব্যক্তিগত কৌতুক হিসেবে কখনই পরপর দুরাত একই কবরদের মাঝে নয়)। এখনও ধূমপান করেন তিনি। এখনও নেভি কাট।
এক সকালে, যখন তিনি জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ে শোনাচ্ছিলেন তাকে, বৃদ্ধ ইমাম সাহেব, যিনি নিশ্চিতভাবেই এতক্ষণ কিছুই শুনছিলেন না, জিজ্ঞেস করলেন-বিঘœ ঘটিয়ে এক সরল বাতাসে-“এটা কি সত্য যে তোমাদের মধ্যে হিন্দু যারা, মরার পর তাদেরকেও কবর দেয়া হয়, পোড়ানো হয় না?”
ঝামেলা বুঝে, আঞ্জুম আলাপ ঘুরিয়ে দিলেন। “সত্য? কোনটা সত্য? সত্য কি?”
নিজের প্রশ্ন থেকে সরে যেতে অনিচ্ছুক, ইমাম সাহেব বিড়বিড় করলেন একটি যন্ত্রস্থ প্রত্যুত্তর। ‘সাচ খুদা হ্যায়। খুদা হি সাচ হ্যায়।’ সত্য হল ঈশ্বর। ঈশ্বরই সত্য। যে ধরনের জ্ঞান সদা সুলভ্য লেখা থাকে ওই রঙ করা ট্রাকগুলোর পশ্চাৎভাগে, যারা হাইওয়েগুলো ধরে গর্জন করতে করতে চলে যায়। তারপর সে তার অন্ধসবুজ আঁখিদ্বয় সরু করল আর ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞাসা করল: ‘আমাকে একটা কথা বলো, যখন তোমরা মারা যাও, তোমাদেরকে ওরা কবর দেয় কই? তোমাদের লাশের গোসল দেয় কে? জানাযা পড়ায় কে?”
আঞ্জুম কোন কথা বললেন না অনেকক্ষণ। তারপর তিনি ঝুঁকে আসলেন অন্ধ ইমামের কাছে। আর ফিসফিস করলেন তিনিও, অবৃক্ষ সুলভভাবে, “ইমাম সাহেব, যখন লোকজন রঙ নিয়ে কথা বলে-লাল, নীল, কমলা, যখন তারা আলাপ করে সুর্যাস্তের আকাশ নিয়ে বা রমযানের সময় চাঁদ ওঠা নিয়ে- আপনার মনে তখন কি আসে?”
একে অন্যকে আঘাত করে, গভীরভাবে, প্রায় মরণঘাতীভাবে, অতঃপর তারা দুজন বসে রইলেন চুপচাপ পাশাপাশি কারো একজনের রৌদ্রসিক্ত কবরের ওপরে, রক্তক্ষরণরত। একসময় আঞ্জুমই নীরবতা ভাঙলেন।
“একটা কথা বলেন আমাকে,” তিনি বললেন, “ইমাম সাহেব তো আপনি, আমি না। বুড়ো হয়ে যাওয়া পাখিগুলো মরার জন্য কই যায়? তারা কি আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথরের মত খসে পড়ে? আমরা কি রাস্তায় তাদের লাশগুলোর উপর হোঁচট খাই? আপনার কি মনে হয় না যে যিনি সব কিছু দেখেন, সবচেয়ে শক্তিমান যিনি আমাদের এই পৃথিবীতে রাখেন, আমাদেরকে ফেরত নেয়ার জন্যেও তিনি ঠিকঠাক ব্যবস্থা করে রেখেছেন?”
ওইদিন ইমামের বেড়াতে আসাটি অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি শেষ হল। আঞ্জুম দেখছিলেন তার চলে যাওয়া, কবরগুলোর মাঝখান দিয়ে ঠক-ঠক ঠক-ঠক করে নিজের পথ করে নিচ্ছিলেন তিনি, তার দেখার-চোখ বেতের ছড়িটি সৃষ্টি করছিল সংগীতের যখন সেটার সংঘর্ষ ঘটছিল ইমাম সাহেবের পথ নোংরা করে রাখা খালি হওয়া মদের বোতল আর ফেলে দেয়া সিরিঞ্জের সাথে। তিনি তাকে আটকালেন না। তিনি জানতেন সে ফেরত আসবে। যত বিশদই হোক না কেন একাকীত্বের নাট্যকলা, তাকে তিনি দেখলেই চিনে নিতে পারতেন। তিনি অনুভব করতেন যে কোন এক অদ্ভুত স্পর্শরৈখিক উপায়ে, তাঁর ছায়া ইমাম সাহেবের প্রয়োজন যতটা আঞ্জুমের প্রয়োজন তারটা। এবং অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিখেছিলেন যে ‘প্রয়োজনীয়তা’ হল একটা গুদামঘরের মত যার যথেষ্ট পরিমাণ নিষ্ঠুরতাকে জায়গা করে দিতে কোন সমস্যা হয় না।
যদিও খোয়াবগা থেকে আঞ্জুমের প্রস্থানটি আন্তরিকতার ধারে কাছেও ছিল না, তিনি জানতেন যে সেটার স্বপ্নগুলোর আর গোপনীয়তাগুলোর সাথে ছলনা করাটা তার একার ব্যাপার নয়।
(চলবে)
(সালেহ মোহাম্মদ অনূদিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি থেকে। বইটির প্রকাশক চারদিক।)