চিত্রকলা
কিউবিজমের জ্যামিতিক চোখ

শিল্পের ভাণ্ডারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন নতুন দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তির। চিন্তার অভিনবত্ব ছাড়া শিল্পী যেমন টিকে থাকতে পারেন না, তেমনি টিকে থাকে না তাঁর শিল্পকর্মও। শিল্পের রাজপ্রসাদে শিল্পী যে প্রসারিত জীবনের স্বপ্ন দেখেন, তা কেবল স্বতন্ত্র্য দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিনব চিন্তার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। শিল্পের উপকরণের বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে অনেক শিল্পীই একই উপকরণ আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের শিল্পমাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তাই উপকরণের অভিনবত্ব না থেকেও উপস্থাপনের অভিনবত্বের কারণে তাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘কিউবিজম’ শিল্প আন্দোলনটি অন্য মতবাদগুলোর চেয়ে আলাদা এই কারণে যে, এ ধারার শিল্পীদের জীবনকে দেখার বিশেষ একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কিউবিস্ট শিল্পীরা বস্তুকে জ্যামিতিকভাবে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলে তাঁদের চিত্রকর্মগুলো স্বাভাবিক দৃশ্যের উপস্থাপন থেকে অনেক দূর সরে গিয়েছিল। কিউবিস্টরা শিল্পকলায় নতুন অনেক কিছু যোগ করেছিলেন। আধুনিক চিত্রকলায় কিউবিজম প্রথমবারের মতো বিমূর্ত শৈলীর উপস্থাপন করে। শিল্পীরা চিত্রকর্মে কোলাজের যথার্থ ব্যবহার শুরু করেন।
উত্তম গুহ কিউবিজমের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘জ্যামিতিক আকার-আয়তনের সমাবেশ ঘটিয়ে কোনো বিশেষ বস্তুর ঘনত্ব বা তার ভেতর ও বাইরের রূপ এবং প্রতিটি পার্শ্বরূপ, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একই সঙ্গে একই চিত্রে সন্নিবেশিত করার মাধ্যমে এ শিল্পধারার সূচনাটা ঘটল। এতে সমতল ক্ষেত্র খণ্ড-বিখণ্ডিত ও বর্ণিল।’ ফলে এ ধারার চিত্রকর্মে ‘বিভিন্ন মাত্রায় আলোছায়া এবং অঙ্কনরেখার পুনঃপৌনিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এক নবতর আঙ্গিকের চিত্রের দেখা মিলল। এ ধাঁচের ছবির গায়ে যে আকারসমূহ ফুটে ওঠে, তা তাদের একটা একান্ত নিজস্ব চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে শুরু করল।’ এই জ্যামিতিক চিন্তাই কিউবিস্টদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলল। তাঁরা কোনো বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থা আঁকার চেয়ে ওই বস্তুর ‘খণ্ড-বিখণ্ডিত’, ‘ভেতর, বাহির ও পাশ্বরূপ’ আঁকতে আগ্রহী ছিলেন। এর আগের শিল্পীরা রঙের প্রাধান্যে আঁকায় নিবিষ্ট হলেও কিউবিস্টরা প্রথমদিকে রংকে গৌণ এবং জ্যামিতিক যুক্তিকে প্রধান মনে করলেন। উত্তম গুহের মতে, ‘শিল্পীরা প্রত্যেক বস্তুর অন্তর্নিহিত যে কাঠামোগত কাঠিন্য আছে তা আনার চেষ্টা করলেন। এটা কিউবিক শিল্পের একটি প্রধানতম দিক। তাঁরা প্রত্যেক বস্তুকে তাঁদের জ্যামিতিক কাঠামোতে ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। আর জ্যামিতিক কাঠামো প্রয়োগ করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের ছবিতে সার্থকভাবে বিজ্ঞানের প্রবেশ ঘটিয়েছেন। তাঁরা বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণাত্মকভাবে ভেঙে ভেঙে ছবিতে উপস্থাপন করতেন। ... এভাবে ভাঙতে ভাঙতে দেখা গেছে তাঁদের ছবি থেকে রং প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।’
আবার এও সত্য, কিউবিজমের চিত্রকলায় রঙের প্রাধান্য ফিরেও এসেছিল। কিউবিজম ধারার যেসব চিত্রকর্মে ভাঙচুরের আধিক্য ও রঙের ব্যবহার লুপ্ত হয়েছে সেগুলোকে শিল্পবোদ্ধারা ‘অ্যানালাইটিক্যাল কিউবিজম’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের মতে, অ্যানালাইটিক্যাল কিউবিজমের চর্চা ১৯০৯ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অন্যদিকে কিউবিজম ধারায় ১৯১২ সালের পরে কিউবিস্টদের ক্যানভাসে রঙের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। রংকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে শিল্পীরা বস্তুর ভাঙচুরের মাত্রা কমিয়ে আনেন। এ প্রবণতাকে ‘সিনথেটিক কিউবিজম’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৯১৬ সাল পর্যন্ত রঙের প্রাধান্য অব্যাহত রেখে শিল্পীরা কাজ করেছেন।
পাবলো পিকাসো বলতেন, ‘কিউবিজম হাতে নেওয়া যেতে পারে এমন কোনো বাস্তবতা নয়। এটি কোনো পারফিউমের মতো, যা কি না আমাদের সামনে, পেছনে ও পাশে রয়েছে। কিন্তু তারপরও আমরা বলতে পারি না এর উৎস কোথায়।’ তাঁকে কিউবিজম ধারার প্রাণপুরুষ বলা যায়। যদিও এ ধারাতে তিনি শেষ পর্যন্ত কাজ করেননি। তাঁরই সমসাময়িক ও বন্ধু জর্জ ব্রাক কিউবিজম ধারায় প্রচুর কাজ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত এ ধারাতেই থিতু হয়েছিলেন। কিউবিজম ধারার আদি চিত্রকর্ম The Young Ladies of Avignon। পাবলো পিকাসো এ ছবিটি এঁকেছিলেন ২৫ বছর বয়সে, ১৯০৭ সালে। পল সেজান দ্বারা প্রভাবিত পিকাসো এ চিত্রকর্মে জ্যামিতিক দৃষ্টিকোণ ব্যবহার করে ব্রোথেলের নারীদের নগ্নদেহ এঁকেছিলেন। তখনো কিউবিজমের বৈশিষ্ট্য ওইভাবে প্রকাশিত হয়নি। সে জন্য The Young Ladies of Avignon চিত্রকর্মে ভাঙচুরের প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠেনি। ‘পাবলো পিকাসো’ গ্রন্থে ফকরুল চৌধুরী জানিয়েছেন, এ ছবিটি চূড়ান্ত সংস্করণ করার পূর্বে পিকাসোর একশটি প্রাথমিক স্কেচ করেছিলেন। তাঁর এই নতুন শৈলীকে সে সময়ে অনেকেই গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি হেনরি মাতিস, জর্জ ব্রাক, আন্ড্রে ডেরই এ চিত্রকর্মটি দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। যদিও এঁদের মধ্যে জর্জ ব্রাক পরবর্তীকালে এ ধারাটিতেই মনোনিবেশ করেন। আন্দোলনটির নামকরণ ‘কিউবিজম’ হওয়ার পেছনেও জর্জ ব্রাকের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। তাঁর একটি চিত্রকর্ম দেখে চিত্রসমালোচক লুই ভকসেল ১৯০৮ সালে cubism শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন। পিকাসো ও ব্রাক কিউবিজম নিয়ে একসাথে কাজ করেছিলেন। এ আন্দোলন সৃষ্টি ও প্রসারে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়।
কিউবিজম ধারার প্রথম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। ১৯০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলনটি ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তার শক্তিশালী প্রবাহ অব্যাহত রেখেছিল। পিকাসোর ‘হাউস অন এ হিল’, ‘দ্য থ্রি মিউজিশিয়ান’; জর্জ ব্রাকের ‘দ্য পোর্ট’, ‘দ্য মিউজিশিয়ান’; জুয়ান গ্রিসের ‘ভায়োলিন অ্যান্ড গ্লাস’, ‘ওমেন উইথ এ ম্যান্ডোলিন’, ‘দ্য বোটল অব রোজ ওয়াইন’; ফার্নান্ড লেগার-এর ‘দ্য সিটি’; আলবার্ট গ্লেইজের ‘হারভেস্ট থ্রেসিং’ ইত্যাদি চিত্রকর্মের মতো কিউবিজম ধারার আরো উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম রয়েছে। জেন মেটজিংগার, হেনরি লরেন্স, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, রর্বাট দিলোনে, ভিলোঁ, মার্চেল দুসাম্প প্রমুখ শিল্পী এ ধারাকে আরো সমৃদ্ধ ও ফলবতী করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কারণে কিউবিজম আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও এ ধারার চিত্রকর্মগুলো এখনো শিল্পরসিকদের মনের খোরাক মিটিয়ে যাচ্ছে।