পল গগ্যাঁ ও ভ্যান গঘ : বন্ধুত্ব ও দ্বন্দ্ব

ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গঘের জন্ম ১৮৫৩ সালের ৩০ মার্চ, নেদারল্যান্ডের জুনডারটে। ভ্যান গঘ শৈশব থেকেই বিষণ্ণ প্রকৃতির ছিলেন। যৌবনে সে বিষণ্ণতা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল। আবার চরিত্রের রুক্ষতার কারণে তাঁর সাথে কারো বন্ধুত্ব বেশিদিন টিকেনি। বন্ধুত্ব ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের। শিল্পী বলেই ভ্যান গঘের বন্ধুত্ব ও দ্বন্দ্বের গল্প কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নয়। পৃথিবীর আরেক বরেণ্যশিল্পী পল গগ্যাঁর সাথে ভ্যান গঘের বন্ধুত্ব হয়েছিল। অন্যসব সম্পর্কের মতো গগ্যাঁর সাথেও বন্ধুত্ব স্থায়ী করতে পারেননি গঘ। পল গগ্যাঁর সাথে ভ্যান গঘের প্রথম দেখা হয় ১৮৮৭ সালে, প্যারিসে। গগ্যাঁ তাঁর চেয়ে চার বছরের বড় ছিলেন। শিল্পী হিসেবে গঘ পল গগ্যাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। বন্ধুত্বের স্রোতে ভেসে এ বছরই দুই শিল্পী পরস্পরের কাছে নিজেদের চিত্রকর্ম বিনিময় করেন। তখন ভ্যান গঘ তেমন খ্যাতিমান শিল্পী না হলেও পল গগ্যাঁ খ্যাতিমান ছিলেন। দুজনেই চিত্রশিল্পী, তাই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট হতে দেরি হয়নি।
ভ্যান গঘ স্বপ্ন দেখেছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের নিয়ে একটি কলোনি হবে। সেখানে শিল্পীরা একত্রে থাকবে, তাঁদের চিন্তার কথা বলবে। ছবি আঁকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকবে সেই কলোনিতে। প্যারিস ছেড়ে ভ্যান গঘ যখন আর্লেসের ‘ইয়োলো হাউজে’ উঠলেন, তখন তাঁর মনে হলো শিল্পী কলোনি গড়ে তুলতে আর্লেসই যথার্থ স্থান। তাই গঘ ঠিক করলেন প্রথমে বন্ধু গগ্যাঁকেই এই ইয়েলো হাউজে আমন্ত্রণ জানাবেন। কারণ, শিল্পের জগতে পল গগ্যাঁ তখন নিজের অবস্থান পোক্ত করে নিয়েছেন। গগ্যাঁ এলে পরবর্তীকালে তাঁর দেখাদেখি আরো অনেকে শিল্পীই এখানে চলে আসবেন। শিল্পীদের আগমনে আর্লেস হয়ে উঠবে গঘের স্বপ্নের শিল্পীনিবাস। গঘের আমন্ত্রণ পেয়ে ১৮৮৮ সালে নয় সপ্তাহের জন্য ছবি আঁকতে পল গগ্যাঁ আর্লেস এলেন। এখানে এসে তাঁদের বন্ধুতে চির ধরা শুরু হলো। প্রতিদিনের অসংযত ঘটনাবলি তাঁদের সুন্দর সম্পর্কটিকে তীব্র ভাঙচুরের কাছে নিয়ে যেত। পল গগ্যাঁ ও ভ্যান গঘ—দুজনের বন্ধুত্ব চিত্রশিল্পের কল্যাণে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দুজনের চিন্তা এক ছিল না। শিল্প নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা সবসময় লেগেই থাকত।
ভ্যান গঘ মনে করতেন, একজন শিল্পী সেটাই আঁকবেন, যেটা তিনি দেখেছেন। অন্যদিকে পল গগ্যাঁ ভাবতেন, শিল্পী প্রত্যক্ষ দর্শনের মধ্য দিয়ে ছবি আঁকবেন না, স্মৃতি হাতড়ে শিল্পী তাঁর ক্যানভাস রাঙাবেন। তবে ভাবনার অমিল থাকলেও আর্লেসের দিনগুলোতে ইয়োলো হাউজে গঘ ও গগ্যাঁ দিনরাত এক করে ছবি এঁকেছিলেন। দুজনে মিলেও একটি ছবি এঁকেছিলেন। কেবল ছবি আঁকা নয়, বন্ধু হিসেবে ভ্যান গঘ তাঁর ভাইয়ের মাধ্যমে পল গগ্যাঁর ছবি বিক্রিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ইয়েলো হাউসের দিনগুলোতে ছবি আদান-প্রদান, শিল্প নিয়ে তর্ক, আলোচনা এবং অসংখ্য ছবি আঁকা হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে তিক্ততাই সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত হয়েছিল। ভ্যান গঘের উন্মাদনা, আবদার, ভিন্নমত, গগ্যাঁর অবহেলা, অভিমত—সব মিলিয়ে খুব দ্রুতই দুই শিল্পীর সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। বন্ধুত্ব রূপ নেয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে। সেজন্য পল গগ্যাঁ আর্লেস ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
১৮৮৮ সালের ক্রিসমাসের দিন তাঁদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, ভ্যান গঘ রাগের মাথায় পল গগ্যাঁকে মদের গ্লাস ছুঁড়ে মারলেন। গ্লাস লক্ষ্যচ্যূত হলে গঘ ক্ষুর নিয়ে আক্রমণ করেন গগ্যাঁকে। গগ্যাঁ ক্ষুরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে দৌড়াতে শুরু করলে ভ্যান গঘও তাঁর পিছু তাড়া করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সেদিন গগ্যাঁ নিজেকে বাঁচিয়ে প্যারিসে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ভ্যান গঘের রাগ কমল না। সেই রাগ ঝাড়লেন নিজের ওপর। ক্ষুর দিয়ে কেটে ফেললেন নিজের ডান কানের লতি। আর কাটা কান তিনি উপহার হিসেবে পাঠালেন র্যাচেল নামের এক পতিতাকে। এই পতিতাকে গঘ বিয়েও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাই থিওয়ের অমত থাকার কারণে এ বিয়ে আর হয়নি।
ভ্যান গঘের কান কাটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। কয়েক বছর আগে কজন জার্মান ইতিহাসবিদ ১০ বছর গবেষণার পর জানিয়েছেন, ভ্যান গঘ নিজে নিজের কান কাটেননি। তাঁর কান মূলত কেটেছেন পল গগ্যাঁ। পরে নিজেকে বাঁচাতে গগ্যাঁ সবাইকে বলেছেন, উন্মাদনায় ভ্যান গঘ নিজেই নিজের কান কেটেছেন! কান কাটার এই দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর।
পল গগ্যাঁকে শ্রদ্ধা করতেন ভ্যান গঘ। গঘের এই শ্রদ্ধা যদিও গগ্যাঁর কারণেই শরবিদ্ধ। তাই গঘের বন্ধুত্বের আবেদন গগ্যাঁর কাছে ভালোভাবে উন্মোচিত হয়নি। ইয়োলো হাউস থেকে পল গগ্যাঁর চলে যাওয়া ভ্যান গঘ কখনো প্রত্যাশা করেননি। যখন গঘের দুর্ব্যবহারে পল গগ্যাঁ চলে গেলেন সেটিও তিনি মানতে পারেননি। ১৯৮৮ সালের ২৩ ডিসেম্বরের ভ্যান গঘের সাথে পল গগ্যাঁর আর দেখা হয়নি। কয়েক মাস পরই গঘ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল গঘের। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি লিখেছেন, ‘আমি এখনো দারুণ দুঃখ ভারাক্রান্ত। ...এমনিতে আমি খুব হাসিখুশি আর মিসুক একজন মানুষ হয়ে থাকতে চাই। কিন্তু আমার জীবনও এখন আপাদমস্তক আক্রান্ত। আমার পদক্ষেপ ভারী হয়ে আসছে।’ অবসাদ, অর্থদৈন্য, তিক্ততায় আক্রান্ত ভ্যান গঘ শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে জীবনের অবসান ঘটান। মৃত্যুর পর পল গগ্যাঁ তাঁকে নিয়ে বহুবার আলোকপাত করেছেন। এমনও হয়েছে মৃত্যুপরবর্তী ভ্যান গঘের চিত্রকর্মের মূল্যায়ন দেখে গগ্যাঁ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলেন। ভ্যান গঘ সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক মন্তব্যও করেছিলেন তিনি।
পল গগ্যাঁ ও ভ্যান গঘ—দুজনেই শিল্প চর্চায় চিত্রকলার ইতিহাসে তাঁদের অমৃতের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য থাকলেও শিল্পে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই পড়েছে। গগ্যাঁ ও গঘের চিত্রকলা নিয়ে প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা, সামর্থ্য প্রদর্শনের স্পৃহার কারণে চিত্রকলার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে—ইতিবাচক দৃষ্টির আলোয় এটিই শিল্পরসিকদের বৃহৎ প্রাপ্তি।