রফিকউল্লাহ খান : শিক্ষক ও মননশীল লেখক

আজ ২১ জানুয়ারি বিশিষ্ট মননশীল লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. রফিকউল্লাহ খানের জন্মদিন। ষাটের দশকের এই দিনটিতে মানিকগঞ্জে জন্মের পর যে শিশুটিকে নদীভাঙনের গল্প শুনতে শুনতে বড় হতে হয়েছে এবং একসময় নিজেদের বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে ঢাকা শহরে আশ্রয় নিতে হয়েছে, সেই শিশুটি এখন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক হিসেবে সারাবিশ্বের বাংলা সাহিত্য চর্চাকারীদের আপনজনে পরিণত হয়েছেন।
‘বঙ্গবিদ্যা’ বলতে গেলে তাঁর একক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যপ্রেমীদের একত্র করেছেন। আন্তর্জাতিক চিন্তক হিসেবে পরিচিত রফিকউল্লাহ খান এখন অনেকেরই গবেষণাকর্মের পথপ্রদর্শক। অন্যদিকে দেশের ভেতর এমন কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যেখানে তাঁর চিন্তাধারার পরিচয় ও প্রভাব অনুভূত হয়নি। এমন কোনো সাহিত্য কিংবা শিল্পকলা অথবা সাহিত্যিক-স্মরণানুষ্ঠান নেই, যেখানে তাঁর বক্তব্য অশ্রুত থেকেছে। আবার দেশের জাতীয় অনুষ্ঠানের বক্তা হন তিনি কিংবা কবিতা পরিষদের উৎসবের মধ্যমণিতে থাকেন। কিংবা বলা চলে প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রধান পৃষ্ঠপোষকও তিনি। বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ সংগঠন তৈরি ও সকলকে সংঘবদ্ধ করা, তাঁর অন্যতম অবদানের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। গণজাগরণ মঞ্চে যুবসমাজের সঙ্গে কাঁধ মেলানো এবং ব্লগার হত্যার প্রতিবাদ সরাসরি তাঁর কাছ থেকেই এসেছে। ফলে তিনি পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের যুবসমাজের প্রিয়মুখে, যাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহায়তা পেয়েছেন অনেক অসহায় ছাত্রছাত্রী।
২.
রফিকউল্লাহ খান আমার শিক্ষক। তিনি কেবল শিক্ষক নন, আমার এমফিল ও পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধায়কও। অন্যদিকে তাঁর মননশীল লেখনী চর্চা আমার সাহিত্যচর্চায় প্রবলভাবে প্রভাব রেখেছে। একজন উদার ও প্রগতিমনস্ক মানুষকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া আমার সৌভাগ্য বলতে হয়। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। আমি ছাত্র হিসেবে তাঁর প্রথম ক্লাস পাই ১৯৮৯ সালে প্রথমবর্ষে। তখন ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্ত। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আমাদের নিয়মিত ক্লাস করতে হয়েছে। একদিনের ক্লাসে তাঁর একটি কথা খুব মনে পড়ে। ক্লাসটির আগের দিন ক্যাম্পাসে গোলাগুলিতে দুজন ছাত্র নিহত হন। সেই ক্লাসে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন মানুষের চেতনা কেমন নিশ্চল। গতকাল দুজন ছাত্র মারা যাওয়ার পরও তোমরা সকলে এখন ক্লাস করছ। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তোমাদের মনে।’ কথাটা এখনো মনে আছে। তখনকার বীভৎস সব হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো মাঝেমধ্যে স্মরণ হয়। তবে রাজনৈতিক চেতনা বলতে যা বোঝানো হতো, তখনো আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে জাগ্রত হয়নি।
প্রথম বর্ষের ছাত্রত্ব ঘোচার পর সেই চেতনা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আমার ভেতর। এবং তার জন্য সহায়ক ছিলেন আমার শিক্ষকরা। রফিকউল্লাহ খান স্যার তখন পিএইচডি গবেষণা কাজে নিয়োজিত। একদিকে ক্লাস, অন্যদিকে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে তাঁকে দিনরাতের পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকতে হয়েছিল। এই ২০১৮ সালেও তাঁকে রাতদিন একাডেমিক কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। গবেষকদের নির্দেশনা দিতে গিয়ে তাঁকে সাহিত্যের নতুন নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তৈরি করতে হচ্ছে। তাঁর গবেষকরা কেউ কেউ উত্তরাধুনিক সাহিত্যবিচার পদ্ধতি অনুসারে সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নির্দেশ করেছেন। কেউ বা নিম্নবর্গীয় তত্ত্বের দৃষ্টিতে সাহিত্য বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের বাইরে দেশ-বিদেশের গবেষকদের পরীক্ষক হিসেবেও সমান জনপ্রিয়। আমি তাঁর অধীনে প্রথম এমফিল গবেষক; আর পিএইচডি গবেষক হিসেবে দ্বিতীয়। সে সময় গবেষণা-নির্দেশক হিসেবে তাঁকে কাজ করতে দেখেছি আন্তরিকতার সঙ্গে। অবলীলায় তিনি নিজের সংগ্রহে থাকা গ্রন্থ ব্যবহার করতে দিয়েছেন। অন্য শিক্ষকদের সহায়তা দরকার হলে বলে দিয়েছেন। বৃত্তির টাকা তুলতে সহায়তা করেছেন। তাঁর সেই আচরণ এখনকার গবেষক ও শিক্ষার্থীরাও পেয়ে থাকেন বলে আমার বিশ্বাস।
৩.
রফিকউল্লাহ খান একজন ব্যতিক্রমী লেখক; মননশীল অবশ্যই। এ মুহূর্তে তাঁর গ্রন্থগুলো একত্র করলে কয়েকখণ্ডের রচনাবলি প্রকাশিত হবে। বাল্যকাল থেকেই তিনি সাহিত্য বিষয়ে নিবন্ধ লেখা শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তা বেগবান হয়। জীবনের অধিকাংশ সময় তাঁকে প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। ইচ্ছে করলে কবিতা-উপন্যাসে তিনি পারঙ্গমতা দেখাতে পারতেন। তিনি বাংলাদেশের প্রায় সব উপন্যাসই পাঠ করেছেন। কারণ তাঁর পিএইচডি থিসিস ছিল ‘বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ’। বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি ভিন্ন একটি ধারার প্রচলন করেছেন। যদিও তাঁর অনুপ্রেরণার জায়গা ছিল শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেনের সাহিত্যকর্ম। যখন ছাত্র ছিলাম, তখনই বুঝতে শিখেছি বাংলাদেশের সাহিত্য গবেষণায় আমাদের শিক্ষকদের ভেতর এই দুজনের নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র স্কুল তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বেগম আখতার কামাল, সিদ্দিকা মাহমুদা, ভীষ্মদেব চৌধুরী, বিশ্বজিৎ ঘোষ, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ। প্রয়াত অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান স্যার আমাদের সিনিয়র শিক্ষকদের অন্যতম ছিলেন। ভিন্নতর ধারা ছিল হুমায়ুন আজাদ স্যারের লেখনীতে।
ছাত্রাবস্থায় আমি সাহিত্য-বিচার ও বিশ্লেষণে অনুসরণ করতে শুরু করি রফিকউল্লাহ খানকে। বিশেষত বাংলাদেশের সাহিত্য মূল্যায়নে তাঁকে অনুসরণ করতে হয়েছে নিরন্তর। তবে এ কথা ঠিক যে, বাংলা একাডেমি থেকে প্রথম প্রকাশিত তাঁর একটি ক্ষুদ্র বই আছে, যেখানে কবিতা ও সমাজের সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়। সেটি পাঠ করে বাংলা কবিতা সম্পর্কে আমাদের বেশ কিছু বোধের জন্ম হয়। পরে যখন ‘বাংলাদেশের কবিতা : সমবায়ী স্বতন্ত্র স্বর’ ও ‘হাসান হাফিজুর রহমান : জীবন ও সাহিত্য’ পড়েছি তখন বুঝেছি তিনি কেবল কথাসাহিত্য বিশ্লেষণে দক্ষ নন, তিনি কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উদঘাটনে প্রাজ্ঞ। উপন্যাসতত্ত্ব এবং কাব্যকলা সম্পর্কে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা আমাদের আকৃষ্ট করে এখনো। তিনি একসময় সহস্র পৃষ্ঠার পরিসরে বাংলাদেশের কবিতা নিয়ে একটি বৃহৎ গ্রন্থ সংকলন করেন। যা পরে আর কাউকে সম্পাদনা করতে দেখা যায়নি। বইটির এখন মুদ্রণ কপি শেষ, বাজারে পাওয়া যায় না। রফিকউল্লাহ খান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সাহিত্যে তার প্রভাব নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। তিনি তাঁর একাধিক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা বৈপ্লবিক যুগান্তরের সম্ভাবনায় তাৎপর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী। জীবন ও শিল্পবোধের ইতিবাচক অন্বেষায় লেখকদের মনোজগৎ তিনি বিস্তৃত পরিসরে লিপিবদ্ধ করেছেন।
বর্তমান সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত কবিতার চরণ ও শব্দ পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তিনি একটি মন্তব্য করেন অসামান্য বুদ্ধিদীপ্ততায়। তিনি মনে করেন, কারো মৌলিক লেখা পরিবর্তন করা ঠিক নয়। ছোটবেলায় যে কবিতার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে পরিচয়, পরিণত বয়সে এসে দেখা গেল তার পাঠ বদলে দেওয়া হয়েছে। এই বদলানোর বিরুদ্ধে তিনি। একজন লেখকের মৌলিক লেখা কেউ কখনো পরিবর্তন করতে পারে না। পরিবর্তন করলে সেটা ওই কবির প্রতি অসম্মান করা হয়। তাঁর কথা, ‘এর আগেও বেশ কিছু লেখা পরিবর্তন আনা হয়েছে, নজরুলকে নিয়েও এমন হয়েছে। কিন্তু জসীমউদদীনের কবিতাগুলোর মূল টেক্সটা আমাদের কাছে নেই। ফলে কখনোই জানা যায় না, আসলে কবি কোনটি লিখেছেন। বা তিনি কোনো পরিবর্তন করেছিলেন কি না। তার কোনো রচনাবলি বের হয়নি, সেগুলো এখনো তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ক্রসচেক করারও সুযোগ নেই।’
৪.
রফিকউল্লাহ খান আমার শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকের চেয়ে তিনি বড় লেখক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিমানী মানুষও বটে। দেশের এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যিনি তাঁর কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়েছেন। তিনি ছাত্রবান্ধব শিক্ষক ও দিলখোলা মানুষ। প্রাণবান এই ব্যক্তি সাহিত্যের আসরে, সাহিত্য সৃজনে এবং বিশ্বসাহিত্যের বাগানের অগ্রপথিক। তিনি শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন লেখনীতে। তিনি ঠিক করে দিতে পারেন জীবনের লক্ষ্য। তিনি পাশে দাঁড়ান অসহায় মানুষের। আর স্বার্থপর মানুষের পৃথিবীতে তিনি একজন নিঃস্বার্থ ও দয়াবান মানুষ। তিনি আরো দীর্ঘদিন মানুষের পাশে থাকবেন, সাহিত্য চর্চায় সারা জীবন নিবেদিত থেকে নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবেন। জন্মদিনে এই প্রত্যাশা আমার।