এই বেশ আতংকে আছি
লেখকের দায়বোধের দলিল

তাপস রায়। লেখালেখির জগতে তাঁর বিচরণ নতুন নয়, বহুদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে লিখে চলেছেন অহোরাত্রি। তাপস রায়ের সাথে তাঁর অন্য সমসায়িকদের ভিন্নতা হলো তাপস রায় যেকোনো বিষয়কে ধারণ করতে পারেন এবং যেকোনো ধারার সাথে তার নিজের একটা যোগসূত্র আছে। আছে ভাষা কাঠামো নির্মাণের প্রাতস্বিকতাও। সম্প্রতি তিনি অর্জন করেছেন কালি ও কলম তরুণ লেখক পুরস্কার। পুরস্কারের মধ্য দিয়ে কোনো লেখকের মেধা বিচার করা যায় না। তবুও পুরস্কারে ভেদ আাছে বলেই কালি ও কলমের কথা লেখা। যে বইটা নিয়ে লিখতে এসব কথার অবতারণা সে বইয়ের নাম ‘এই বেশ আতংকে আছি’। এটি রম্য গল্পের বই বা গদ্যকার্টুন বলতে পারেন যে কেউ। তবে এর আগে যেসব গদ্য কার্টুনে রসের যে সংকট তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এটার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।
লেখার প্রয়োজনে লেখার বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রম্য গল্পের দিকে তাকালে আমরা পরশুরাম বা রাজশেখর বসুর যে রস, সৈয়দ মুজতবা আলী বা শিব্রাম চক্কোত্তির যে রস, সেটার স্বাদ পাই তাপস রায়ের লেখায়। তাপসের ভিতরে যে ভিন্নতা তাহলো একজন লেখকের সামাজিক দায়-দায়িত্ব। এটা সত্যি খুব ভেবে দেখার দিক। আমাদের সমাজ ও সামাজিকতার ছাপ লেখায় উঠে না এলে অর্থাৎ লেখকের লেখায় রাজনীতি না থাকলে সে লেখা কতটুকু ধোপে টেকে তা আমরা দেখেছি। একজন লেখকের লেখা পড়ে যদি সে সময়কালের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চালচিত্র বোঝা না যায় তাহলে সেটা লেখকের দুর্বলতার শামিল। তাপস রায়ের এই বেশ আতংকে আছি ব্যঙ্গ রসাত্মক লেখা। এর মধ্যে সময়কালটা স্পষ্ট।
লেখকের লেখার মুন্সিয়ানা দেখাতে একটি লেখার কিছু অংশ উল্লেখ করতে চাই, ‘দুশ্চিন্তার শুরু হয় গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে। চিকিৎসকের দেয়া তারিখ এক পা, দুই পা করে এগিয়ে আসে, বাড়তে থাকে দুশ্চিন্তা। তারিখ পার হলে দুশ্চিন্তা রূপ নেয় আতংকে। গর্ভে সন্তান আড়াআড়িভাবে নেই তো? ডেলিভারিটা ঠিকমতো হবে তো? মহাতংকে শুকিয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর মুখ।’( পৃষ্ঠা-৮৫)। এটা লেখার শুরু এরপরে ডাক্তারদের বহু টেস্টের জমানার সব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। কালো মায়ের কালো সন্তান জন্মের বিড়ম্বনা যেমন সামাজিক সংকটের তালিকায় এখনো রয়েছে সেটিও বাদ পড়েনি লেখকের মানসদৃষ্টি থেকে। পথ চলতে ছিনতাইকারির উৎপাত কোনটাই আতংক থেকে বাদ পড়েনি। এরপরে এসেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রসঙ্গও। তার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর মর্ষকামী চরিত্রও বেরিয়ে এসেছে। এই লেখার শেষ পাতার উপরের প্যারাটি খুবই অর্থবহ।
লেখক লিখেছেন- ‘শেখ মুজিবকে নিয়ে ইয়াহিয়া, নিয়াজিও কম আতঙ্কে ছিলেন না। একবার পাকিস্তানের সেনা ছাউনি পরিদর্শনে এসে নিয়াজি দেখলেন, পুরানো পত্রিকায় ছাপা হওয়া শেখ মুজিবের ছবির একাংশ পড়ে আছে। নিয়াজি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, এটা এখানে কেন? সবাই নিশ্চুপ। কে এনেছে এটা? তবুও সবাই নিরুত্তর। আমি জানতে চাই এটা এখানে কেন? নিরীহ গলায় এক সৈনিক বলল, স্যার এটা তো ছবি। এই ছবি দেখে আমরা কেউ ভয় পাইনি।’ (পৃষ্ঠা-৮৮) । অর্থাৎ জীবন্ত একজন মহান নেতার চেয়েও তাঁর ছবি যে বড় আতংক হতে পারে সেটা ইতিহাসের পথে পথে ঘুরে এ লেখায় চলে এসেছে।
সব কিছুর পরে এ আতংকের মধ্য দিয়েও লেখক সাহসী হওয়ার কথা যেমন বলেছেন তেমনি নিজেই নিজের আতংকের কারণ এটাও যুক্ত করেছেন অকাট্য যুক্তি ও বাস্তবতার মিশেলে। তাপস রায়ের রম্যের সামাজিকতা ও ইতিহাস সচেতনতা তদুপরি পাঠককে মূল মেসেজটি পৌঁছাতে তাঁর যে কৌশল সেটা তাঁর নিজস্বতাকে পোক্ত করেছে। ‘গৃহকর্তার ঈদ’ লেখার দিকে তাকিয়ে আমরা আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে পারি। ঈদের বাজার মধ্যবিত্ত না তথাকথিত মধ্যবিত্তের পকেটের জন্য কতটা কষ্টকর এই বাজার অর্থনীতি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দিচ্ছে। শপিং কেনাকাটা না করে ফি বছর কচুকাটা হতে যিনি রাজি নন তাঁর জন্য লেখক একটি ইতিহাসের ঘোড়াকে দাঁড় করিয়েছেন। ঘোড়াটি বীর আলেক্সান্ডারের বিখ্যাত ঘোড়া বিসোফেলাসে সাথে স্ত্রীর গগনবিদারী চিৎকারের ভয়াবহতা ও গৃহকর্তার সাধ্যহীন জীবনকে মুখোমুখি করে দিয়েছেন। এর জন্য যেসব কর্মসূচিকে উল্লেখ করেছেন তা নাম সর্বস্ব কয়েকটি দল অযথাই ডেকে দেন। রম্যের আঘাতে সামাজিকতাকে চাবুক পেটা করার এ শক্তি লেখকের যে রয়েছে তা তাঁর এ বইটিকে ঋদ্ধ করেছে।
‘আজিম পুরের আগে মাদ্রাজ’ লেখাটির মধ্যেও দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে লেখক কফিনে তুলতে শুধু বাকি রেখেছেন। এখানে বর্ণনা রীতিটাকে প্রকাশের লোভ সামলাতে পারছি না— ‘ রানওয়ের মতো লম্বা ফ্লোর। ফ্লোরের দুই পাশে সমান্তরাল শিরা বিন্যাসের মতো সারি সারি বেড। বেডগুলোর বেহাল দশা, বালিশ আছে তোশক নেই, তোশক থাকলে চাদর নেই; সেই চাদর ছাড়া বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে চিকিৎসার চান্স পাওয়া চাট্টিখানে কথা নয়। ফ্লোরে অক্সিজেন সিলিন্ডার সবেধন নীলমণি। অথচ পুরো ফ্লোরে রোগী ছেচল্লিশজন। ফলে সিলিন্ডার নিয়ে চলে বালিশ খেলা।’ (পৃষ্ঠা-৩২)
লেখক এই বইয়ের প্রত্যেকটি লেখায় যেমন লেখকের দায়বদ্ধতাকে মাথায় রেখে লেখার রাজনীতিটাকে তুলে ধরেছেন, তেমনি ভাষা বিন্যাসের পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন লেখায়। আমাদের সমাজ ও সামাজিকতার যে চিত্র আতংকের মধ্যে নিপতিত তা লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এ বইয়ের মধ্যে। একজন লেখক তাঁর কথা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যেভাবে লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন এই বইয়ে তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তাপস রায়ের লেখার ভাষা সাবলীল, সহজ ও গতিশীল। ভাষার গতি তাঁর লেখাকে ভিন্নতা দিয়েছে। একবার লেখা পড়তে শুরু করলে পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে ভাষার যে শক্তি লাগে তার রয়েছে এই বইটির সব লেখায়। বইটির সফল প্রচার ও প্রসার কামনা করি।
এই বেশ আতংকে আছি
তাপস রায়
প্রকাশক : অনার্য
প্রচ্ছদ : আজহার ফরহাদ
মূল্য :১৫০ টাকা