মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জনপ্রিয় লেখক, টিভি টক শোর বক্তা এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা’ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। সমসাময়িক বিষয় ও চিরায়ত অনুষঙ্গ নিয়ে তিনি ব্যতিক্রমী সব কথা লিখে পাঠককে আন্দোলিত করেছেন। গত বছর (২০১৭) প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি মূল্যবান বই। এ দুটি গ্রন্থ একত্রে পড়লে মীজানুর রহমানের বিষয় পর্যালোচনায় স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই চোখে পড়বে। তিনি মার্কেটিংয়ের অধ্যাপক। কিন্তু সমসাময়িক বিষয় নিয়ে যখন কথা বলেন, তখন তাঁকে একটি গণ্ডির ভেতর আটকে রাখা যাবে না। তিনি শতমুখী স্রোতের মতো বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে যান। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে কুপোকাত করেন, দেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন; তবে উন্নয়নের বিভ্রান্তিগুলোও ধরিয়ে দেন। এভাবে একদিকে দলীয় আদর্শ লালন, আবার অন্যদিকে মুক্তচিন্তার দিশারি মীজানুর রহমানের বিভিন্ন বিষয়ের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা’র অন্যতম দিক।
৫২টি প্রবন্ধের মধ্যে এ গ্রন্থের শিরোনাম দিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা’ রচনার সমধর্মী নিবন্ধ হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম আজকের জঙ্গিবাদ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক ভিত্তি ও আজকের প্রত্যাশা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই রুখতে পারে জঙ্গিবাদ’, ‘বিজয়ের ৪৫ বছর’। লেখক মীজানুর রহমান বিজয়ের ৪৫ বছর অতিক্রম করে লিখেছেন, ‘দেশ যেভাবে এগিয়ে চলছে, তাতে আমরা একসময় উন্নত দেশ হবো। কারণ কেউ না চাইলেও দেশের উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকসমূহ খুবই সক্রিয়। কেবল আইনশৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বজায় থাকলে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ বেগমান হবে। কিন্তু আমাদের এই দেশ সত্যিকার অর্থে অনেকগুলো আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ার। কিন্তু এই সোনার বাংলা ডলারের হিসেবে চিন্তা করেননি বঙ্গবন্ধু। তাঁর স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা এমন হবে, যেখানে মানুষের কোনো অভাব-দারিদ্র্য থাকবে না। মানুষে মানুষে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং বিভেদ থাকবে না। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমানসহ সব ধর্মের লোকের পারস্পরিক সহ-অবস্থান থাকবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান থাকবে না। আমাদের এই ভূখণ্ডে, বিশেষ করে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করার ইতিহাস দীর্ঘদিন থেকেই ছিল। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এর অবসান ঘটবে। এখানে একে অপরের বিরোধী মতামত গ্রহণ করে আমরা এক সঙ্গে থাকব। আমাদের কৃষ্টি-কালচারগত বৈচিত্র্য আমরা রক্ষা করব। এসব বিবেচনায় আমাদের এখনো অনেক কাজ করার বাকি আছে।’ আমরা মনে করি, তাঁর এই পর্যবেক্ষণ যথার্থ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর গত নয় বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দেশের যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে, তা বিস্ময়কর। তবু সামাজিক বৈষম্য রয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে; সাম্প্রদায়িকতাও। তারই অবসান কামনা করেছেন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান রাজনীতি ও অর্থনীতিকে সমন্বিত করে যেমন কথা লেখেন, তেমনি এক প্রাজ্ঞ চেতনায় বিষয়বস্তুকে উন্মোচন করেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠে দার্শনিকসুলভ। এ জন্য ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখার সময় সামগ্রিকতা নিয়ে ভিন্নতর বক্তব্য উপস্থাপিত হয়। যেখানে সতর্কবার্তাও থাকে আমাদের জন্য। যেমন একটি অংশ, ‘আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে হবে, যা বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান এবং তাদের দোসররা কেবল ১৫ আগস্ট ঘটিয়ে চলে গেছে, তাই নয়। ১৫ আগস্টের পর গণতন্ত্রকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে গিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টেই আমাদের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, এমনকি বেসামরিক তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাসেও। ক্যান্টনমেন্ট ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর ঠিকানাই ছিল ক্যান্টনমেন্ট। ফলে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতিতে ১৫ আগস্টের মতো ঘটনা বারবার ঘটানোর চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবে কিনা? সম্পর্ক আমরা কোন পর্যায়ে রাখব? এসব বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ...তবে পাকিস্তানি দূতাবাস এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতেই হবে। কারণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ক্ষমতার পালাবদল তথা জুডিশিয়াল ক্যু লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেই ভারত বিরোধিতা এবং ক্যান্টনমেন্টের শক্তির ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। তারা এই ষড়যন্ত্র কেবল পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না, বাংলাদেশেও রপ্তানি করার চেষ্টা করবে।’
তবে অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের বিবেচ্য বিষয় কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়নি। তিনি নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। শেখ হাসিনার সাফল্যকথা বর্ণনা করেছেন। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে বিস্তৃত আলোকপাতও তাঁর গ্রন্থে লক্ষণীয়। নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন, তৈরি পোশাক রপ্তানি, ক্ষুদ্রঋণ, জলজট, ঢাকা শহরের সংকট, নাগরিক জীবনের সমস্যা এবং সর্বোপরি শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো পূর্ব ধারণা নিয়ে বক্তব্য দেননি। বরং সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে সাবলীল ভাষায় লিখেছেন নিবন্ধসমূহ। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে লিখেছেন, শরণার্থী সমস্যায় মিয়ানমারকে অবদান রাখতে হবে। আর তাঁর মতে, মুসলিম বিশ্বের দ্বন্দ্বও প্রত্যাশিত নয়। বরং বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে সেখানে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা নিয়ে তিনি লিখেছেন যথার্থই পথনির্দেশকের মতো।
মূলত অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা’ গ্রন্থের ৫২টি নিবন্ধে সচেতনভাবে বিচিত্র বিষয়ে নিজস্ব অভিমতসমূহ ব্যক্ত করেছেন। ভিন্নমত পোষণের দৃষ্টান্ত পাঠক খুঁজে পাবেন একটি পর একটি নিবন্ধ পাঠ শেষ করে পরেরটিতে উপস্থিত হলে। প্রতিটি রচনায় লেখকের চিন্তার অভিনবত্ব চোখে পড়বে। তিনি জটিল প্রপঞ্চ নিয়ে কথা বলেন না বরং তিনি যা বলতে চান, সহজ-সরল ভাষায় কিন্তু দার্শনিকচেতনায় গভীর অনুধ্যান নিয়ে উপস্থাপন করেন। এ জন্য তিনি স্বতন্ত্র একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং অর্থনৈতিক পথনির্দেশক। তাঁর গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
(মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়ন ভাবনা, অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, মেরিট ফেয়ার প্রকাশনা, ২০১৮, প্রচ্ছদ : মশিউর রহমান, মূল্য : ৪০০ টাকা। )