ঢাকার কথা ৪
মোগল আমলে পরাধীন ঢাকা

দীর্ঘদিন বাংলায় মোগল আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন বাংলার জমিদার বারোভুঁইয়ারা। বারোভুঁইয়াদের শেষ প্রতিরোধ ভেঙে যায় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের শেষ নেতা ঈশা খানের ছেলে মুসা খানের পরাজয়ের মাধ্যমে। ১৫৩৮ সালে মোগল সম্রাট হুমায়ুন গৌড় দখলের মধ্যদিয়ে সমগ্র বাংলা মোগল শাসনের আওতায় নিয়ে আসার যে চেষ্টা শুরু করেছিলেন- সম্রাট আকবরের জীবদ্দশায়ও তা সম্ভব করে তোলা যায়নি। পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অনেকটা অংশ দখল করলেও বারোভুঁইয়াদের দাপটে পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশ দখল করা সম্ভব হয়নি। এভাবে আড়াইশ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে থাকে বাংলার- বিশেষ করে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা। শেষ পর্যন্ত মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সুবাদার ইসলাম খানের হাতে বাংলা স্বাধীনতা হারায়।
পূর্ববাংলা দখলের আগে মোগল অধিকৃত বাংলার রাজধানী ছিল রাজমহল। রাজমহলের অবস্থান বর্তমান ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে। ঢাকা দখলের পর ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় সুবা বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। সম্রাটের নামে ঢাকার নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর। মোগল নথিতে এই নামকরণ থাকলেও ঢাকার মানুষ জাহাঙ্গীরনগর নামে অভ্যস্ত ছিল না। পরাধীনতার অস্বস্তিই এর কারণ। সাধারণ মানুষ ঢাকা নামটিই ব্যবহার করত। শুধু বাংলার মানুষ নয় এ সময় ঢাকা নামই ব্যবহৃত হতো ঢাকায় অবস্থানকারী ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের কাগজপত্রে। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীতেও ঢাকার বদলে জাহাঙ্গীরনগর নাম ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
ইসলাম খান ঢাকা দখলের পর বারোভুঁইয়াদের শেষ নৌঘাঁটি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে আক্রমণ করেছিলেন। এই লক্ষ্যেই শক্তি সুসংহত করার জন্য তাঁকে রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী সরিয়ে আনতে হয়।
মোগল অধিকারের আগে ঢাকা শহরের পরিধি সূত্রাপুর থেকে আজকের বাবুবাজার পর্যন্ত সীমায়িত ছিল। যে যুগে বাবু বাজারের নাম ছিল পাকুড়তলী। ঢাকা বাংলা সুবার রাজধানী হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই শহরের সীমানা বেড়ে যেতে থাকে। একটি রাজধানী শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে নানা অঞ্চল থেকে সম্প্রসারিত ঢাকায় অনেক মানুষ চলে আসতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে ঢাকার জনসংখ্যা। প্রশাসনিক কাজে শহরের বিভিন্ন অংশে নানা দপ্তর খোলা হয়। কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় সেনানিবাস। বিভিন্ন ধরনের কর্মচারীর বসতিও গড়ে ওঠে। নানা পেশাজীবীর অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখনো টিকে থাকা স্থানের নামগুলো সে স্মৃতি বহন করছে।
বখশি বাজার বখশি উপাধিধারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। মোগল সৈন্যবাহিনীর হাতির জন্য যে হাতিশাল ছিল তা পিলখানা নামেই বোঝা যায়। একইভাবে হাতি পরিচালনাকারী মাহুৎদের বাসস্থানটি মাহুৎটুলি নামে পরিচিত হয়। মোগলদের বাসস্থানের জন্যও যে নির্দিষ্ট এলাকা ছিল মোগলটুলি নাম তা মনে করিয়ে দেয়। এ সময় বাংলাদেশ সচিবালয়ের উত্তর পাশের রাস্তাটি তোপখানা রোড নামে পরিচিত। নামে বোঝা যায় মোগল ঢাকার এই শহরতলিতে অর্থাৎ মূল শহর থেকে একটু দূরবর্তী এলাকায় কামান এবং গোলাবারুদ রাখার ছাউনি তৈরি করা হয়েছিল।
প্রশাসনে নিযুক্ত হিন্দু কর্মকর্তারা সাধারণত কায়স্থ নামে পরিচিত ছিলেন। সাধারণ মানুষদের মুখে কায়স্থ উচ্চারিত হতো কায়েৎ বলে। এ কারণে কায়স্থদের বাসস্থান অঞ্চল কায়েৎটুলি নামে পরিচিত হলো। একইভাবে প্রাচীনকালে তাঁতিদের অবস্থানের এবং তাঁতবোনা বা কাপড়ের ব্যবসা কেন্দ্রের নাম হয়ে গেল তাঁতি বাজার। একই ধারায় শাঁখারি বাজার, বানিয়ানগর ইত্যাদি নামকরণ হয়। এ থেকে বোঝা যায় প্রাচীন ঢাকার এসব পেশা মোগল যুগেও অব্যাহত ছিল এবং পেশাজীবীরা ঢাকায় অবস্থান করতেন।
পনের শতকে প্রথম ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী গড়ে ওঠার কথা আমরা শিলালিপির সাক্ষ্য থেকে জানতে পারি। তখন স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্যতম ইকলিম বা প্রদেশ মুবারকাবাদের রাজধানী ছিল ঢাকা। স্বাধীনতা হারানোর পর দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা প্রায় ৪০০ বছর আগে দিল্লি নিয়ন্ত্রিত বাংলা সুবার রাজধানী হয়। তবে মানতেই হবে ঢাকা শহরের জমে ওঠার পথ প্রদর্শন ঢাকা জয় করা ইসলাম খান চিশতির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। ভৌগোলিক বিবেচনাতেই তিনি ঢাকাকে রাজধানী করার স্থান হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। এর তিনটি প্রধান কারণ ছিল। এক, শীতলক্ষ্যা নদীতে বারভুঁইয়াদের নৌবহরে আঘাত করার জন্য মোগল ঘাঁটি স্থাপনে ঢাকা ছিল উপযুক্ত স্থান; দুই, ঢাকা শহরের নাগরিক ঐতিহ্য এবং তিন, সে সময় বাংলা সুবার অনেকটা কেন্দ্রে ছিল ঢাকা শহরের অবস্থান। ঢাকায় ইসলাম খান দখলদার শক্তি হিসেবে এলেও অল্পদিনের মধ্যে তিনি ঢাকাবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন। এর অবশ্য বিশেষ কারণ ছিল। তিনি ছিলেন ফতেহপুর সিক্রির বিখ্যাত সুফি সম্রাট আকবরের পীর সেলিম চিশতির ভাস্তে। এ কারণে সাধারণ মানুষ তাঁকেও সুফি মনে করতেন। ইসলাম খান চিশতি ১৬১৩ সালে ঢাকার কাছে ভাওয়ালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে তাঁকে হাইকোর্টের অভ্যন্তরে সমাধিস্থ করা হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল যে পরকালে ইসলাম খান চিশতি বেহেস্তে যাবেন। তাই ঢাকাবাসী এই কবরটি দেখিয়ে বলতেন চিশতি বেহিস্তির মাজার। মৃত্যু সংবাদ জানার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর আদেশ দেন ইসলাম খানের শবাধার তুলে আনতে। শেষ পর্যন্ত ইসলাম খানকে ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতির সমাধির পাশে কবর দেওয়া হয়।
মোগল শাসন পর্বে উত্তর ভারত ও ইরানের সাথে যোগাযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায় বাংলার। ফলে রাজধানী ঢাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ পর্বের সবচেয়ে তথ্য সমৃদ্ধ বর্ণনা জানা যায় পর্যটক সেবাস্টিন মানরিকের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৬৪০ সালে। তত দিনে ঢাকায় মোগলদের প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পার হয়েছে। এ সময়ের ঢাকা শহরের সীমানা উল্লেখ করতে গিয়ে মানরিক পশ্চিম দিকের শেষ সীমানা হিসেবে মানেশ্বর নাম উল্লেখ করেছেন। স্থান নামটি পরিবর্তিত হওয়ায় এখন আর নিশ্চিত করে জায়গাটিকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। মানরিকের মতে শহরের পরিধি পূর্ব দিকে নারিন্দা এবং উত্তর দিকে ফুলগারি পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। মানরিকের ফুলগারি এখনকার ফুলবাড়িয়ার সাথে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলটি ঘিরে নানা ধরনের ইমারত গড়ে উঠতে থাকে। মানরিকের প্রায় ২০ বছর পর ঢাকায় এসেছিলেন আরেকজন পর্যটক। নাম তাঁর মানুচি। তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর দেখা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অপেক্ষকৃত ছোট শহর ছিল। কিন্তু এখানে লোক বসতি ছিল ঘন। সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ছিল খড়ের তৈরি। মানুচির কাছাকাছি সময়ে ১৬৬৬ সালে ঢাকায় আসেন পর্যটক টাভার্নিয়ার। তিনিও ঢাকাকে ঘনবসতিপূর্ণ শহর বলেছেন। টাভার্নিয়ারের সময় শহর আরেকটু বেড়েছিল। তাঁর হিসেবে ঢাকা নগরীর পরিধি এ সময়ে ছিল প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার। ১৬৭০ সালের দিকে টমাস বাউরি আসেন ঢাকায়। তাঁর বর্ণনায় অবাক করা তথ্য ছিল। মানুচির চার বছর পর চারপাশের শহরতলী মিলিয়ে ঢাকা শহরের পরিধি দাঁড়ায় প্রায় ষাট কিলোমিটার। এ কারণেই তিনি ঢাকা শহরকে বেশ প্রশস্ত শহর বলেছেন। এ পর্যায়ে উত্তর দিকে ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটেছিল। এর বিশেষ কারণ ছিল। ঢাকা শহরের চারদিকে নিচু জলাভূমি থাকলেও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল উঁচুভূমি। এ কারণে বর্তমান তেজগাঁও এলাকায় বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি তাদের শিল্পকারখানা স্থাপন করতে থাকে।
মোগল যুগে ঢাকা শহরে সুবাদার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রসাদ বা বাড়ির কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এর বড় কারণ সম্ভবত ঢাকায় তাদের স্বল্প দিনের অবস্থান। বহির্ভারতের এই মোগল কর্মকর্তারা উত্তর ভারতের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হলেও বর্ষাপ্রবণ ঢাকায় বসবাস করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। তাই তারা অল্প দিন থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তাই তাঁরা বড় কাটরা, ছোট কাটরার মতো অস্থায়ী নিবাসে কালাতিপাত করতেন। ফলে বসবাসের জন্য স্থায়ী ইমারত গড়ায় তাঁরা মনযোগ দেননি।