গল্প
পথ

লোকটা শিয়রের কাছে এসে দাঁড়াতেই জয় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। বাড়ির পাশের মাসকলাই আর মিষ্টিকুমড়ো খেতের মধ্য দিয়ে মেঠোপথ বেয়ে আসার সময় জয় দেখেছে তাকে। এতক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে তার পৌছার অপেক্ষায় প্রহর গুনেছে। জয়কে তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নেওয়ার তাগাদা দিয়ে মেঝেতে লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারী করতে থাকে আগন্তুক। কিছুক্ষণ বাদে সে আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়, জলদি করো, হাতে সময় খুব কম, আমাদের এক্ষুনি রওনা করতে হবে। জয় কথাগুলো কান পেতে শোনে মাত্র আর সাথে সাথে কাজের গতি আরো বাড়িয়ে দেয়; আগন্তুকের দিকে একবারের জন্যও তাকায় না পর্যন্ত- পাছে দেখতে গেলে খানিকটা সময় অপচয় হবে।
যাত্রাটা অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত। বহু বছর হয় জয় অপেক্ষা করে আছে আজকের এই যাত্রার। বলা বাহুল্য, এখন জয়ের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন বহুপ্রতীক্ষিত এই যাত্রায় সফল হওয়া; ঠিক তার বাপ-দাদার কথা মতো- এ যাত্রা তাদেরও জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল। জয়ের প্রস্তুতি শেষ হলে ওরা পাশাপাশি পা চালিয়ে ঠিক আগন্তুকের আসার পথ বেয়ে রওনা করে।
চাঁদের আলোয় পরিচিত সবজিক্ষেতের সীমানা পার হয়ে প্রাগৈতিহাসিক ছত্রাক জন্মানো শরীর সমেত বড় বড় গাছ আর ঘন লতাগুল্মের গহীন জঙ্গল পেরোনোর সময় জয়ের গা ছমছম করে। গোড়ালি সমান কাদা-পানি মাড়িয়ে হনহন করে হেঁটে চলে আগন্তুক সহযাত্রী- যিনি ঠিক মাঝ বয়সী নয় বরং আরো বেশি বয়সী, সম্ভবত সে জীবনের শেষ দিনগুলো যাপন করছে- প্রথমে না বুঝলেও এখন জয়ের তাই মনে হয়, অন্তত তার কোঠরে ভেসে থাকা দুটো অভিজ্ঞ চোখ দেখে। তবুও তার হাঁটার গতি এত বেশি যে তার সাথে পা মেলাতে জয়ের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা! চারদিকে সবকিছু চুপচাপ, এমন ভীতিকর থমথমে নীরবতা ভেঙে থেকে থেকে মাটি প্রকম্পিত করে প্রথমে পা, তারপর ক্রমশ শরীরের নিম্নদেশ কাঁপিয়ে কানে আসে কেমন যেন দূরাগত প্রাগৈতিহাসিক চাপা স্বরের গর্জন।নিজের হাঁটার সর্বোচ্চ গতিতে, বলতে গেলে, প্রায় দৌড়ে ওর সহযাত্রীর সাথে পা মেলায় জয়। ভীতবিহ্বল চোখে সংকোচের সাথে সহযাত্রীর কাছে জানতে চায়, আমরা এখন কোথায়?
সে তো জানই, শুধু শুধু কেন প্রশ্ন করছ!
ঠিক আছে, কিন্তু, এই জায়গাটার তো একটা নাম আছে?
না, অন্য কোনো নাম নেই। এখানে পথের একটাই নাম, এর অন্য কোনো নাম হয় না আর যাত্রাকালে এটা জানাও সম্ভব না যে তুমি এখন ঠিক কোথায় অথবা গন্তব্য থেকে কতটা দূরে রয়েছ। জানতে হলে তোমাকে শেষ অব্দি যেতেই হবে!
এবড়ো-থেবড়ো উঁচুনিচু পাথর আর ভয়ানক সব গিরিখাদে ভরা এই বনের পথ ধরে চলা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার। এমনিতেই সরু পথ- কোথাও কোথাও পথের কোনো নিশানা নেই, যেন চলতে হলে পথ তৈরি করে নিতে হবে- তার ওপর জল-কাদা, ছোট ছোট লতাগুল্ম- যার বাঁকগুলো জোকের মতো পা আকড়ে ধরে- মরা গাছের ডালপালা আর বিশাল বিশাল অমসৃণ গাছের গুঁড়ি, বিভিন্ন প্রকার প্রাণীর বিষ্ঠা, পচে যাওয়া অদ্ভুত, বিভৎস সব প্রাণীর কঙ্কাল আর জায়গায় জায়গায় বড় বড় পদচিহ্ন। জয়ের মনে ক্রমশ এই প্রশ্ন দানা বাধতে থাকে যে, এই পথ এত বন্ধুর কেন?
সম্মুখে ঘটতে থাকা কিছু একটা আচ করতে পেরে সহযাত্রী চলার গতি কমিয়ে আনে, বলতে গেলে প্রায় থেমেই যায়। দৃশ্যপট জয়ের খুবই পরিচিত, দুর্গম গিরিখাদ আর উঁচু উঁচু গাছপালার বন পেরিয়ে ওরা এখন মধ্যরাতে। মধ্যরাতে ল্যাম্পোস্টের আলোয় মহল্লার শেষ মাথার গলিটা চকচক করে। ডানে ঔপনিবেশিক আমলের পরিত্যক্ত দোতলা বাড়িটা আর বাঁয়ে চায়ের টং দোকানটা রেখে ক্রমশ সরু হয়ে গলিটা সামনের দিকে চলে গেছে প্রায় আধা মাইল, যার দুই পাশে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার ঘিঞ্জি সব নতুন-আধা-নতুন-পুরনো বাড়িগুলো। নিজের বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মফস্বল শহরের এই অংশটায় বেশ আনাগোনা আছে জয়ের। এখানেই এই গলির মুখে দরদাম পাকা করে গলির শেষ মাথায় মেয়েটার ঘরে গিয়ে কি উন্মত্ত খেলায়ই না মেতে উঠে সে! সপ্তাহন্তের ছুটির দিনগুলোতে মেয়েটার নরম মসৃণ ঊরু, রেশম কোমল নিতম্ব আর হিমালয়ের মতো ঊর্ধ্বমুখী টানটান স্তনযুগল মাড়িয়ে মায়াবি মুখ আর হৃদয় হরণ করা চোখ জোড়ায় যেন তাজা শরাবের স্বাদ পাওয়া যায়। বাড়ি ফিরে গোসলের জল মাথায় ঢাললে মনে হয় যেন এখনো তার স্পর্শ গায়ে লেগে আছে। জলের কলকল শব্দ ছাপিয়ে মেয়েটার ক্লান্ত শ্রান্ত কন্ঠস্বর দূরাগত সুখধ্বনির মতো কানে আসে, ‘খুশি হয়েছ তো? আর একটু সময় থাক, কিছু বকশিস দিও।’
সেই মেয়েটাকেই আজ টেনে হেচড়ে নিয়ে যাচ্ছে মোড়ের ছেলেগুলো- যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ হরহামেশাই ওঠে- দিনরাত মোড়ে বসে থাকা আর নিয়ম-আইনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছে মতো যা খুশি তাই করাই ওদের কাজ। ওরা সংখ্যায় চারজন। মেয়েটা সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ওদের সাথে ঠিক পেরে ওঠে না। হেচকা টানে পেছন ফিরে দেখে ফেলে জয়কে আর প্রবলভাবে ডাকতে থাকে ওদের হাত থেকে রক্ষা পেতে। সে হয়তো আশা করে জয় তার জন্য কিছু একটা করবে! ওদের টানাহেচড়া আর মেয়েটার বিপরীতমুখী ধস্তাধস্তিতে শাড়ির আচলটা খসে পড়লে, তার স্তনযুগল আর নিতম্বের নড়াচড়া দেখে এক পৈশাচিক আনন্দ পায় ওরা। জয় ওকে রক্ষা করতে এগিয়ে যাবে কি বরং মনে পড়ে যায়, ওই অঙ্গগুলো কী আশ্চর্যভাবে সুখী করেছে তাকে। মেয়েটার কন্ঠ অস্পষ্ট হয়ে আসে, সহযাত্রী উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে, মেয়েটা বিপদে পড়েছে, তোমার কাছে সাহায্য চাইছে, তোমার কিছু করা উচিত জয়।
আমি ওকে চিনি, ও একটা বেশ্যা। এসব ওর জন্য নতুন কিছু না।
কিন্তু এখন তো সে বিপদে পড়েছে, সে ওদের সাথে যেতে চায় না আর দেখ তোমার কাছেই আশ্রয় চাইছে!
পড়ুক, বেশ্যাদের এমনটা হবেই। ওরা ওর সাথে কি বা করবে? কাজ তো একই, শুধু পয়সা দেবে না। আপনি চলুন, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে! আপনি না বললেন হাতে সময় খুব কম?
ও হ্যাঁ, নিশ্চয়। চল ...
বেশ্যাপল্লীর দৃশ্যগুলো যেন নাট্যমঞ্চের আলো নিভে যাওয়ার মতো হারিয়ে যায়। বনের আরো গহীনে উঁচু উঁচু তিনটা উঁইঢিবিকে পাশ কাটিয়ে শতবর্ষী এক বটগাছের নিচে লম্বা সাদা চুলদাড়িতে এক ঋষি ধ্যানমগ্ন। সহযাত্রী শব্দ করে তার ধ্যান ভাঙালেন; কমরেড ওঠ, ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি, চল রওনা করি।
খুব ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে, যেন হাজার বছর পর এই প্রথম চোখ খুলে জয়কে দেখলেন তিনি। তারপর কমরেডের অনুসরণে ওরা একটা ছোট্ট নদী ঘাটে- নৌকা না থাকলে যাকে কোনো ভাবেই ঘাট বলে মনে হবে না- এসে পৌঁছায়; ভেসে ওঠা অগুনতি শিকড়ের মাঝে জল ছুঁইছুঁই একটা বড় সাদা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে, ডান দিকে উলম্ব ভাবে পুতে রাখা এক খণ্ড পচা গুঁড়িতে হাতের লাঠি দিয়ে গুনে গুনে ঠিক তিনবার আঘাত করেন কমরেড। ঘন কুয়াশার মধ্য থেকে গঁলুই পচা জীর্ণশীর্ণ একটা নৌকা নিয়ে হাজির হয় এক মাঝ-বয়সী মাঝি, যার হাতের বাতিটা লাগে যেন যুগ-যুগান্তের পুরনো, রাজকীয়।
নৌকা চলতে শুরু করলে ক্রমশ চারদিকটা অন্ধকার হতে শুরু করে। বাইরের আলো যতই কমে বাতির আলো আপনা থেকে ততই বাড়ে। পেছনের ছেড়ে আসা বনভূমি শেষবারের মতো দেখতে সেদিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে জয়। তার ধারণা সঠিক, মাংসাশী সব জন্তু-জানোয়ার ক্ষুধাতুর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে গোংরাচ্ছে অথচ এই বনেই কত নিশ্চিন্তে কমরেড ধ্যান করছিলেন। সাথে সাথে জয়ের ধারণা হয় অনেকের সাথে বসবাস করা এই অরণ্যের জীবন কতটা বিপৎসংকুল আর অনিশ্চিত। আসলে এই লোকটা কে, তার নাম কী? সত্যিই কমরেড, কমরেড কারো নাম হয়- নিজের সাথে কথা বলতে শুরু করে জয়।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ওদের বহনকারী জীর্ণ নৌকাটির দিকে মনযোগ দিয়ে জয় বিস্মিত না হয়ে পারে না- এটা এখন আর মোটেও কোনো জীর্ণ নৌকা নয়; উজ্জ্বল সোনালি রঙ ধারণ করে ধায়ধায় করে এগিয়ে চলেছে, নিঃসন্দেহে যেকোনো স্পিডবোট কিংবা জাহাজের চেয়ে ক্ষিপ্র গতিতে। কমরেডের পরিচয় নিয়ে জয়কে ভাবতে দেখে তিনি নিজেই মুখ খুললেন: ‘আমার নাম কমরেড না, তুমি অচিরেই আমার আসল পরিচয় জানতে পারবে। তবে তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো। জানোই তো ফরাসি ভাষার কমরেড মানে বন্ধু। জয়ের মাথায় ঘুরতে থাকা আরো একটা বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের জবাব আপনা থেকেই জানিয়ে দেয় কমরেড; ‘তুমি ভাবছ মধ্যরাতে রওনা দিয়ে বন পেরোনোর সময় কি করে সন্ধ্যা হয়? আমরা এতক্ষণ সূর্যের দিকে এগোচ্ছিলাম আর এখন সবকিছু কে পেছনে ফেলে কেবল সত্যিকারের গন্তব্যের দিকে চলেছি।’ কমরেড কেবল আজগুবি একটা নামের অধিকারীই নয় বরং অন্তর্যামিও। এসব অভাবনীয় দৃশ্য আর অত্যাশ্চর্য মানুষ জয় আগে দেখেনি কখনো। এক অজানা ভয়ে হিম হয়ে আসা চোখে সাহস করে আর কমরেডের মুখের দিকে তাকায় না সে।
স্বপ্নের মতো গোছানো পরিপাটি এক বন্দরে এসে নৌকাটা নোঙর করলে দুজন ভৃত্য ওদের অভিবাদন জানিয়ে নিয়ে যায় চেকপয়েন্টের বিশালাকার দরজার সামনে। দরজাটা এতটাই বিশাল আর জাঁকজমকপূর্ণ যে মনে হয় বাকিংহাম প্যালেসের কাছে কিছুই না। বন্দর থেকে এই বিশাল দরজা অব্দি আসতে একটা অনাথ ছেলে বেশ ঝামেলা করেছে পথে; রেল স্টেশন, বাস স্টপ আর লঞ্চ ঘাটে যেমন থাকে- ওত পেতে থেকে পা জড়িয়ে ধরে শুরু করে তার পাঁচাল, ‘সে দু-দিন হয় কিছুই খায়নি!’ গল্প! ওসব ধান্দা আমি বুঝি। আমি যে পথে রওনা করেছি তা এতটা স্বস্তা নয়, এ যেনতেন বিষয় নয়; বেটা বজ্জাত কাপড়টাই নষ্ট করে দিল!’ চেকপয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে সফলভাবে এড়িয়ে যেতে পারলেও চোখের কোনে অবশিষ্ট বিরক্তির রেখা টেনে এমনটাই ভাবছিল জয়।
ডেস্কের পেছনে দাঁড়ানো দুজন মহিলা ভিতরে যাওয়ার টিকেট দিচ্ছে। কমরেড আর সহযাত্রী গিয়ে দাঁড়াতেই টিকেট পেয়ে গেল, ওদের টিকেটে জড়ানো প্যাঁচানো বাঁকা হরফে কি যেন লেখা। জয়ের টিকেটটা হাতে দিয়ে দু-জন মহিলার অপেক্ষাকৃত বয়স্কজন বললেন: ‘এটা যত্ন করে রাখবে।’ অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মহিলাটির চোখজোড়া বড় বেশি তীক্ষ্ণ, তার চোখে চোখ রাখলেই স্বর্গের দরজা খুলে যায় আর পরম তৃপ্তির বাতাস চোখের মধ্য দিয়ে বয়ে এসে যেন গোটা শরীরে আবেশ বুলিয়ে দেয়। তারার মতো জ্বলজ্বলে দুটি মোহনীয় চোখে চেয়ে সে বলে: ‘দেখবে, এটা যেন কোনোক্রমে সাদা না হয়ে যায়; এটা পুরোপুরি সাদা হয়ে গেলে কিন্তু তুমি সপ্তম আসমানের ওপরে প্রবেশের সব যোগ্যতা হারাবে!’ জয় সবিস্ময়ে টিকেটের দিকে তাকায়, টিকেট ভর্তি কুচিকুচি অস্পষ্ট সব লেখা আর তার জন্য সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার যে, টিকেটের প্রায় অর্ধেকটা সাদা। জয় অবাক হয়, ‘কিন্তু এর অর্ধেকটা তো আগে থেকেই সাদা?’
আমি এর বেশি কিছু জানি না জনাব, আপনার জন্য এই টিকেটটাই নির্ধারিত ছিল। আমার জানা মতে শুরুতে সব টিকেটই পূর্ণ থাকে।’
জয়ের ভাগ্য তবুও অনেক ভালো; অনেকে শুরুতেই সাদা টিকেট পেয়েছে আর তাদের টিকেট দেওয়া হয়েছে বাঁ-হাতে। যারা বাঁ-হাতে সাদা টিকেট পায় তাদের এখান থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এমন ভাগ্যাহত লাখ লাখ মানুষ বিশালাকার এই দরজাটার সামনে বিক্ষোভ করছে অথচ তাদের চিৎকার-চেচামেচিতে কোনো শব্দই হচ্ছে না; তাদের কেউ কেউ মিছেই দরজাটা ভেঙে ফেলার বৃথা চেষ্টায় মত্ত অথচ দরজার রঙের একটা টুকরোও কেউ খসাতে পারেনি এখন অব্দি।
সহযাত্রী জয়কে ডাকে, ‘জয়, তাড়াতাড়ি এসো, আমাদের গাড়িটা ধরতে হবে।’ দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে জয় উজ্বল নয়না নারীকে আরো একবার দেখার লোভ সামলাতে না পেরে পেছন ফিরে তাকায়। পেছনে মা আর পছন্দের মেয়েটিকে দেখে বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না তার, দুজনেই ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে- জয় বিশ্বাসই করতে পারে না যে, মা আর সঙ্গিনীর কাছ থেকে এই অনন্ত যাত্রার টিকেট নিয়েছে সে! পেছনের মানুষ দুটোর কাছে আরো একটু সময় থেকে যেতে খুব ইচ্ছে করে তার কিন্তু এখন সেই সময় আর নেই!
ওরা একটা গোলাকার চ্যাপ্টা যানবাহনের কাছে এসে উপস্থিত হয়, যেটা দেখতে অনেকটা মানুষের বিবেচনায় এলিয়েনদের যানবাহনের মতো। ছোট্ট এই যানের ভেতর অসংখ্য যাত্রী। পেছনের সারিতে বসা কয়েকজন তাদের টিকেট সাদা হয়ে যাওয়া নিয়ে সমানে চেচামেচি করে চলেছে। এত মানুষের ভিড়ে জয় নিজের আসন খুঁজে না পেয়ে, এই বিশাল যানবাহনে খোঁজাখুঁজির ঝামেলা এড়াতে পছন্দমতো এক জায়গায় বসে পড়ে- কিছুক্ষণ বাদে এক বৃদ্ধ এসে ছিট দাবি করলে বোঝা যায় জায়গাটা তার। বৃদ্ধের ঘ্যানঘ্যানানি সত্ত্বেও জয়ের মধ্যে ছিট ছেড়ে দেওয়ার কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না দেখে উপায়ান্তর না পেয়ে বৃদ্ধ চলে যায়।
অল্প কিছুক্ষণ পরই যেন যানবাহনটি নেই হয়ে যায়। একটা বিশালাকার সোনালি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওরা। এবারের দরজাটা আরো বেশি জমকালো, যার সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। কমরেড জয়ের ঘাড়ে হাত রেখে বলে, আমরা এসে পড়েছি বন্ধু। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এবার নিজের পরিচয় দেয় কমরেড: আমি গ্যাব্রিয়েল, এবার বিদায় বন্ধু। সহযাত্রীর কাছেও বিদায় নেন গ্যাব্রিয়েল, শুভ বিদায়, লর্ড। তারপর ছদ্মবেশী গ্যাব্রিয়েল চলে গেলে তার দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায় সে আসলে খুবই সাধারণ একজন, পৃথিবীর কোনো ঋষি বা সাধকের মতোই; পেছন থেকে দেখলে খুব পরিচিত মনে হয় তাকে। সহযাত্রীকে এখন আর মোটেও বয়স্ক কেউ মনে হয় না, যেন জয়ের মতোই তরুণ, না পুরুষ না নারী; কেমন যেন না মানুষ না অন্যকিছু; অপার মুগ্ধতা নিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে- সময়টা যেন মুহূর্তের লক্ষ ভাগের এক ভাগ। দরজাটা স্পর্শ করে খুলে সহযাত্রী আগে প্রবেশ করে। তারপর প্রচণ্ড শব্দ করে, যেন চিরতরে, বন্ধ করে দেয় বিশালাকার সোনালি দরজাটা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয় জয়, এ কি! আপনি দরজা বন্ধ করে দিলেন যে? আমাকে ভেতরে নিন!
না, এই দরজা দিয়ে তোমার প্রবেশ নিষেধ। তুমি এই দরজা দিয়ে প্রবেশের সব যোগ্যতা হারিয়েছ! ভালো করে দেখ তোমার হাতের টিকেটটা পুরোপুরিই সাদা!
কিন্তু আমার আপরাধ কী? এটা কেন এমন হলো?
তোমার অপরাধ! সে তুমিই ভালো জান!
বিস্ময় আর হতাশা পুরোপুরি গ্রাস করে জয়কে। কাঁপতে থাকা হাতের টিকেটের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে জানতে চায়, কিন্তু আপনি কে? ততক্ষণে এক প্রবল আলোর ঝলকানি দিয়ে বিশালাকার দরজাটা নেই হয়ে গেছে; এতক্ষণ লম্বা রাস্তা ভ্রমণ করা সহযাত্রীও দরজার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। জয়ের মাথার ওপর মধ্য দুপুরের উত্তপ্ত সূর্য, প্রচণ্ড তাপে দরদর করে ঘামছে, ডানে, বায়ে, উপরে, নিচে শুধুই শূন্য; শূন্য আকাশ থেকে যেন রকেটের গতিতে ছিটকে পড়ছে পৃথিবীতে। মহল্লার পতিতা, অভাগা অনাথ শিশু, সিট না পাওয়া বৃদ্ধ, নৌকার মাঝি, ছদ্মবেশী গ্যাব্রিয়েল, পছন্দের মেয়েটি এমন কি মাও কেমন নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে হাসে। জয় নিষ্ফল উন্মুখতায় শুধুই তার সহযাত্রীর চেহারাটি মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু আর সব মনে পড়লেও কেবল ওই একটি চেহারাই সে হারিয়ে ফেলেছে- ভয়ে আতঙ্কে প্রচণ্ড চিৎকারে বিছানায় উঠে বসে জয়। শরীরের ঘামে বিছানা-বালিশ ভিজে একাকার, হৃৎপিণ্ড বুকের উপর ধপাস ধপাস বাড়ি দিচ্ছে, যেন ছাতি ফেটে বেরিয়ে আসবে। জয়ের উচ্চরবে এমন কি মাও এসে পড়ে, দরজায় টোকা দিয়ে জানতে চায়, কী হয়েছে জয়? দরজা খোল বাবা! কী হয়েছে?
অনন্ত যাত্রার টিকেটটা তখনো জয়ের হাতে এবং এটা সত্যিই সাদা! তবে টিকেটের অপর পাশটা দেখে আরো একবার শিহরিত না হয়ে পারে না, ভয়, বিস্ময়, আনন্দ একসাথে আচ্ছন্ন করে জয়কে; বাক্যটা যেন কোনো কালেও ভোলার নয়, ‘ঈশ্বর তোমার সাথেই ছিল!’
শ্যামলী, ঢাকা, মার্চ ১৮ ২০১৩