হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষ

একটা কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিম্নবর্গের। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’–পান্তার দিন হয়তো ফুরিয়েছে, তাই বলে জীবন তার সব ঐশ্বর্য খুলে দেয়নি আমাদের হাতে আজও। কাজী নজরুল ইসলাম যত উদার কণ্ঠেই বলুন না কেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছে মহান’, আদতে দারিদ্র্যের ভয়াবহ চাবুক আমাদের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে হেনেছে তীব্র আঘাত। বাংলা সাহিত্যে বিশেষত, ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষের বাস্তব এবং বিশ্বস্ত চিত্র উঠে এসেছে অসংখ্যবার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বটেই, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষের দেখা পাই। উল্লেখ্য, এঁদের একাধিক ছোটগল্পে দারিদ্র্য ও অভাবক্লিষ্ট মানুষের ছবি আঁকা হয়েছে নিখুঁত আর ধ্রুপদি বাস্তবতায়। কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, অভাবী, অনাহারী মানুষের কথা সব মহৎ সাহিত্যিকের রচনাতেই পাই। পাশ্চাত্যে চার্লস ডিকেনস, শেখভ, মোঁপাসা, গোর্কি প্রমুখের লেখায় নিম্নবর্গের মানুষের দেখা পাই। তবে বিশেষত, এই রচনায় আলোচ্য বিষয় হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষ।
লেখার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে নবীন এবং আধুনিকতর ধারা ছোটগল্প। বিষয়, বক্তব্য, চরিত্র, করণ কৌশলে সারাবিশ্বে অসংখ্য অসাধারণ ছোটগল্প লেখা হয়েছে। মোঁপাসা, শেখভ কিংবা এলেন পো’র মতো বিশ্বসেরা সাহিত্যিকদের পাশাপাশি বাংলায় রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা শাহেদ আলী প্রমুখ ছোটগল্পের মানচিত্রকে ক্রমাগত ঋদ্ধ করেছেন। চিরায়ত ছোটগল্পের এই শক্তিশালী ধারার বাহক হিসেবে স্বাধীন বাংলায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক ও শহীদুল জহিররা আলোকবর্তিকা বয়ে নিয়ে গেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় ও প্রকাশনা-সফল লেখক হুমায়ূন আহমেদ। অবশ্য তাঁর উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছোটগল্পের জগতে পরিমাপগত বিচারে কমই হেঁটেছেন। তবু সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে পিছিয়ে থাকলেও তার নিজের মতে এবং অনেক আধুনিক সমালোচকের মতেও তাঁর ছোটগল্প গুণগত অর্থে অগ্রগামী। ছোটগল্পের ঐতিহ্যবাহী ধারায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রসঙ্গত, সৈয়দ শামসুল হকের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য, ‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা— হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন তার ছোটগল্পের জন্য। তার কিছু ছোটগল্প কেবল বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে তো বটেই, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতেও অসাধারণ। জীবনের ছবি তিনি এঁকেছেন অনবদ্যভাবে।’ (সৈয়দ শামসুল হক, দৈনিক সমকাল, ২১-০৭-২০১২)
জীবনের বিচিত্র ছবি এঁকেছেন হুমায়ূন আহমেদ তাঁর গল্পে। তবে নিম্নবর্গের মানুষকে তিনি দেখেছেন অসীম মায়ায়। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের সার্থক গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিম্নবর্গের মানুষকে তাঁর গল্পে তুলেছেন দরদি কথাকার হিসাবে।
“... কেন্দ্রীয়ভাবে না হলেও রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্পে খণ্ড খণ্ডভাবে চিত্রিত হয়েছে নিম্নবর্গের জীবনবাস্তবতার অখণ্ড এক রূপ। ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতন, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর রাইচরণ, ‘বিচারক’-এর ক্ষীরোদা, ‘আপদ’-এর নীলকান্ত, ‘উলুখড়ের বিপদ’-এর গিরিশ, ‘মাস্টারমশায়’-এর হরলাল, ‘পণরক্ষা’র রসিক, ‘হালদারগোষ্ঠী’র নীলকণ্ঠ— প্রভৃতি চরিত্রে কখনো নিম্নবর্গের প্রতিবাদ, কখনোবা জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ-প্রবণতা শিল্পিত হয়েছে। গল্পগুলোর বয়ান থেকে অভ্রান্তভাবে উন্মোচিত হয় নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অতুল ভালোবাসা, অতল সহানুভূতির কথা। এসব গল্প উনিশ-বিশ শতকে বাংলাদেশের জমিদারি ব্যবস্থা এবং নিম্নবর্গের ঐতিহাসিক ডিসকোর্স অনুধাবনে উল্লেখযোগ্য টেকস্ট বা পাঠকৃতি হিসেবে বিবেচনাযোগ্য।” [বিশ্বজিৎ ঘোষ (২০১৪), অশেষ রবীন্দ্রনাথ, নান্দনিক, ঢাকা]
হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষের হতাশা-বেদনার পাশাপাশি ছোট ছোট আনন্দ-হাসিও ঝিলিক দেয়। একরৈখিকভাবে নিম্নবর্গের মানুষকে দেখেননি তিনি। তাঁর পরিমিত এবং সরস রচনাশৈলী বাংলা ছোটগল্পে নিম্নবর্গ মানুষের দালিলিক উদাহরণ হয়ে থাকবে।
দারিদ্র্য, অভাব মানুষকে এমন এক তীব্র অসহায়ত্বে ফেলে যে স্নেহ-মমতাও তখন বাহুল্য হয়ে যায়। এমনই এক অসহায় অথচ মমতার গল্প ‘সুলেখার বাবা’। পুরো গল্পে তিনি সুলেখার বাবা অথবা লোকটি হিসেবে পরিচিত। নাম নেই তার। এমন নিম্নবর্গের এক নামহীন অসহায় মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সন্তান বিক্রি করলেও মানুষের মায়া, মমতা আর আত্মা তো বিক্রি হয় না। তাই সে মাঝেমাঝেই মেয়েটিকে দেখতে আসে। মেয়ের সঙ্গে তার ফারাক আজ শ্রেণিগত। মেয়ে আজ উচ্চবিত্তের, সংস্কৃতিবান, রুচিশীল কন্যা। ‘কী বিশ্রী দাঁত লোকটার, হলুদ এবং কালো! এই লোক বোধহয় কোনোদিন দাঁত মাজে না। আরে কী আশ্চর্য, লোকটা হাত ইশারা করে তাকে ডাকছে! সুলেখা এগিয়ে গেল। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, ‘ডাকছ কেন?’
লোকটি কিছু বলল না। মুখ ভর্তি করে হাসল। সুলেখা বলল, ‘নাম কী তোমার?’
‘আমার নাম নাই গো মা।’
‘সবারই নাম থাকে।’
শিশু সুলেখা বুঝতে পারে না, নামহীন মানুষও হয়। এ জগতের অসংখ্য অগণিত নামহীন মানুষ আসে আর চলে যায়। তাদের কোনো অস্তিত্বই নেয়। নামহীন এই লোকটিকে ভর্ৎসনা করে সুলেখার বর্তমান মা। কেন এসেছ প্রশ্নের উত্তরে লোকটি যখন বলে মনটা বড় টানে। জবাবে সুলেখার মা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘তোমাকে যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে যাতে মন না টানে।’ আরো কিছু টাকা দিয়ে লোকটিকে বিদায় করতে চান তিনি। সুলেখার হাতে টাকা পাঠালে, ‘লোকটি টাকা নিল না। কুঁজো হয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল। একবার পিছনে ফিরে তাকাল না।’ দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বই যেন কুঁজো হয়ে একবারও পেছনে ফিরে না-তাকিয়ে চলে গেল।
‘সুলেখার বাবা’র মতো ‘সৌরভ’-ও বাৎসল্য রসের গল্প। এ গল্পের নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতা আজহার খাঁ সংসারের খরচ চালিয়ে ছেলেমেয়েদের কোনো সখই পূরণ করতে পারেন না। বড় মেয়ে লিলি একটা জিনিস এনে দেওয়ার জন্যে পিতাকে অনেক দিন ধরেই বলছে। পিতার আয়ের কথা জেনেও মেয়ের এই অহেতুক আবদার তাকে বিরক্ত করে। অভিমানী মেয়ে করে একদিন তার জমানো তিনটা দশ টাকার নোট দিয়ে পিতাকে জিনিসটা এনে দেওয়ার জন্য বলল। লজ্জা ও হতাশার এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো লিলি যেন তাঁকে লজ্জা দেওয়ার জন্যেই তিনটা দশ টাকার নোট দিয়ে জিনিসটা এনে দিতে বলল। তাঁর আরো মনে হলো তিনি কুকুরের জীবন অতিবাহিত করছেন। তখন ঝপ্ ঝপ্ করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির ধারা ঝরছে। এক দোকানে গিয়ে মেয়ের আবদার করা ‘ইভিনিং ইন প্যারিস’ নামের সেন্টের শিশিটা খুঁজে পান, কিন্তু ছাব্বিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা দাম দিতে গিয়ে দেখেন তাঁর পকেটে লিলির দেওয়া টাকাগুলো নেই, পড়ে গেছে, অন্য পকেটে মাত্র আড়াই টাকা আছে।
নির্বিকার দোকানি যথাস্থানে জিনিসটা রেখে দেয়। ব্যথিত, লজ্জিত আজহার খাঁ উদভ্রান্তের মতো রাতের রাজপথ বেয়ে ছুটে চলেছেন। পিতার বেদনার সঙ্গে মিলিয়ে তখন প্রবল বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টিতে উপেক্ষা করে তিনি বন্ধু রফিকের কাছে টাকা ধার করতে যান। ইতোমধ্যে তাঁর জ্বর এসে গেছে। বন্ধুর সহানুভূতি ও টাকা নিয়ে তিনি দোকানির ঘুম ভাঙিয়ে সেন্টের শিশিটা যখন জোগাড় করলেন, তখন রাত সাড়ে ১২টা বাজে। রিকশায় করে বাসার কাছে আসতেই তিনি লক্ষ করেন, হারিকেন জ্বালিয়ে লিলি আর লিলির মা তাঁর জন্য উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশা থেকে নামতে গিয়ে আজহার খাঁ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সেই সঙ্গে শিশিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। চারদিকে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।
‘তিনি ধরা গলায় বললেন, লিলি তোর শিশিটা ভেঙে গেছে রে।’ লিলি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘আমার শিশি লাগবে না। তোমার কী হয়েছে বাবা?’
বাবা ঘরে ঢুকলেন। গভীর রাতে তিনি জ্বরে আচ্ছন্ন। হারিকেনের রহস্যময় আলো জ্বেলে উৎকণ্ঠিত মেয়ে লিলি আর লিলির মা জেগে আছেন। জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ‘আর সেই হাওয়া সেন্টের ভাঙা শিশি থেকে কিছু অপরূপ সৌরভ উড়িয়ে আনল।’
গল্প এখানে শেষ হলো, এই সৌরভ পাঠকের মনে ছড়িয়ে থাকে দীর্ঘকাল। সেন্টের শিশির এই সৌরভ যেন প্রকারান্তরে পিতা ও কন্যার ভালোবাসার সৌরভ, দরিদ্র পরিবারে ভালোবাসার সৌরভ।
সমালোচক আজহার ইসলাম তার ‘বাংলাদেশের ছোটগল্প : বিষয়-ভাবনা স্বরূপ ও শিল্পমূল্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সংসারের অনেক যন্ত্রণার মধ্যেও বাৎসল্যের এই ছোঁয়াটুকু না থাকলে তো পুরো সংসারটিই মিছে হয়ে যায়। হুমায়ুন আহমেদ অদ্ভুত কৌশলে কন্যার প্রতি যেমন পিতার বাৎসল্যের ছবি অঙ্কন করেছেন, তেমনি সংসারের ভারে ন্যুব্জ পিতার প্রতিও উৎকণ্ঠিত কন্যার, যেন ছেলের প্রতি এক মায়ের, বাৎসল্য সঞ্চার করে মায়া আর মমতার এক অপরূপ ছবি পাঠককে উপহার দিয়েছেন।’
‘জুয়া’ গল্পের দরিদ্র শিক্ষক প্রণব বাবুও একজন দরিদ্র পিতা। তাঁর পুত্র সুবল মানুষ হয়নি আর কন্যাকে কোনোরকম চেষ্টায় কলকাতায় বিয়ে দিয়েছেন। স্কুল শিক্ষক প্রণব তিন মাস ধরে বেতন পান না। তাঁর দৈনিক আহারেও সংকট। পুত্র সুবল কোনো একটা বিপদে পড়েছে। সে বারবার পিতার কাছে টাকা চেয়ে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতা একজন পিতাকে তীব্র আহত করে। টানাটানির দিনে হেডমাস্টারের প্ররোচণায় বাধ্য হয়ে প্রণব বাবু পাঁচটি লটারির টিকেট কিনেছিলেন। সেই লটারিতেই তিনি দুই লাখ টাকা পুরস্কার পেয়ে যান। “তিনি দু’লক্ষ টাকার একটি টিকেট পকেটে নিয়ে একজন নিঃস্ব মানুষের মতো কাঁদতে লাগলেন। সুবল বাবাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। তিনশ টাকার তার সত্যি খুব প্রয়োজন। তার নিজেরও ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু সে কাঁদল না। নিচু গলায় বলল, ‘চিন্তার কিছু নাই বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রণব বাবু ধরা গলায় বললেন, ‘কিছুই ঠিক হয় না।’
তাঁর কথাকে সমর্থন করেই যেন ঘরের ভেতর থেকে তক্ষক ডেকে উঠল। বাইরে মাছের চোখের মতো মরা জ্যোৎস্না।”
মাছের চোখের মতো মৃত জোছনার উপমা দিয়েই গল্প শেষ হয়ে যায়। সদ্য দুই লাখ টাকার লটারি পাওয়ার পরও এ গল্প থেকে বেদনার আঁচ যায় না। নিম্নবর্গ মানুষের জীবন এতটাই ওলটপালট হয়ে যায় যে আকস্মিক অনেকগুলো টাকাও পুরোনো ক্ষতগুলোকে সারাতে পারে না।
ভয়াবহ দারিদ্র্যকে আরেকটি ক্রুর চিত্র আমরা দেখতে পাই হুমায়ূন আহমেদের ‘খাদক’ গল্পে। এ গল্প যেন নিম্নবর্গ মানুষের জীবন নিয়ে মূর্তিমান প্রহসন। উচ্চবিত্তের লেখক স্যার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলে তাকে খুশি করার নানা চেষ্টা চলতে থাকে। তারই অংশ হিসেবে তাঁর সামনে হাজির করা হয় খাদক মতিকে। এলাকার গর্ব মতির ক্ষমতা হলো সে একজন বিরাট খাদক। বিয়েবাড়ি বা নানা অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যপক্ষের খাবার আয়োজনে সে কমতি ফেলে দেয়। খাওয়ার জন্যই সে পেয়েছে একাধিক মেডেল। লেখক স্যারের আগমন উপলক্ষেই মতি এইবার একটা আস্ত গরু খেয়ে ফেলার রেকর্ড করবে। অথচ মতির সন্তানেরা দুবেলা খেতে পায় না। তার সন্তানেরাও খাদক কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মতি বলে, ‘জ্বি-না। তারা না-খাওন্তির দল। খাইতে পায় না। কাজকাম তো কিছু করি না, খাওয়ামু কী? তারা হইল গিয়ে আফনের দেখক।’
মতি অন্য কোনো কাজ করে না। ফলে তাঁর সংসারে অভাব-অনটন নিত্য ব্যাপার। পরিবার-সন্তানরা অনাহারে থাকে, অথচ মতি আস্ত গরু খাওয়ার বিদ্যা দেখাতে বসে। কেন কাজকর্ম করে না তার জবাবে সে বলে—
‘একসঙ্গে দুই-তিনটা কাম করলে কোনোটাই ভালো হয় না। আল্লাহতায়ালা একটা বিদ্যা দিছে। খাওনের বিদ্যা, অন্য কোনো বিদ্যা দেয় নাই।
আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত বিদ্যার অহংকারে মতি মিয়ার চোখ চিক চিক করতে লাগল। আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না।...’
পাঠক হিসেবে আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। বেদনা আর প্রহসনের অদ্ভুত মিথস্ক্রিয়ায় নিম্নবর্গের সমাজ চিত্রের ভয়াবহ চিত্রায়ণ হুমায়ূন আহমেদের ‘খাদক’।
সমালোচকের ভাষায়— ‘খাদক’ অতিশোয়ক্তি আর জীবন নিয়ে প্রহসনের গল্প। মানুষের বাজির কাছে মানবিক গুণও তুচ্ছ। খাদক গল্পে হুমায়ূন সেই স্বাক্ষরই এঁকেছেন।’ (মোহাম্মদ নূরুল হক, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮-১১-২০১২)
নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবনের ছোটখাটো ঘটনার চিত্রায়ণে হুমায়ূন এক কুশলী শিল্পী। ‘ফেরা’ গল্পে সে অর্থে ঘটনাই নেই। ভালোমতে খেতে পায় না এমন এক পরিবারের এক রাতের ভাত খাওয়ার সাধারণ চিত্রকে ধ্রুপদি বাস্তবতায় তুলে ধরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। জরী, পরী, দিপুকে নিয়ে হাসিনার সংসার। জরী প্রতিদিন এক জিনিস দিয়ে ভাত খেতে চায় না, একটা ডিম ভাজি হলেও সে খুশি, তার সঙ্গে ছোট ভাই দিপুও খেতে চায় না। ভাত নিয়ে রাগ করে। অন্যদিকে অসুস্থ পরী মরিচ দিয়ে হলেও একটু ভাত খেতে চায়। কিন্তু তাকে দুধ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দিপুর বাবা সুখবর নিয়ে আসে, তার বেতন বেড়েছে চল্লিশ টাকা। সেই খুশিতে তিনি একটি রুই মাছ নিয়ে এসেছেন। দারিদ্র্য-জর্জর নিম্নবিত্ত এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছেই রাতটি আনন্দময় হয়ে ওঠে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে একটি মাত্র রুইমাছ আনন্দধারা বইয়ে দেয়, একমুহূর্তে দারিদ্র্য ও বেদনা কাটিয়ে জোছনার আলো প্রকটিত হয়ে ওঠে। একটু আগেও হাসিনার কাছে অভাব জর্জরিত যে জীবন বিষাদময় ছিল, সে হাসিনা এখন চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়। গল্পের শেষাংশের কাব্যিক-বাস্তবতা অতুলনীয়—‘বাসন-কোসন কলতলায় রাখতে গিয়ে হাসিনা অবাক হয়ে দেখে মেঘ কেটে অপরূপ জোছনা উঠেছে। বৃষ্টিভেজা গাছপালায় ফুটফুটে জোছনা। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকেই। অকারণেই তার চোখে জল এসে যায়।’ ‘ফেরা’র মতোই ‘নিশিকাব্য’ গল্পটি নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজ বাস্তবতার শৈল্পিক রূপ। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-ভাশুর-দেবর পরিবেষ্টিত পরী তার শিশু মেয়েকে নিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্তের এই সংসারে বাস করে। গরিব স্বামী আনিস শহরে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে তাকে কখনো কখনো ট্যুরে যেতে হয়। এবার ট্যুরের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় সে সামান্য এক রাত্রির সময় হাতে নিয়ে স্ত্রী-পরিজনের সঙ্গে মিলিত হতে গ্রামে বাড়িতে আসে। সবাই তাকে পেয়ে খুব খুশি। সুখের কী দুঃখের যে কোনো ঘটনাই ঘটুক না কেন, আনিসের মায়ের স্বভাব কিছুক্ষণ কাঁদা। পুত্রের আগমনে অতএব তিনি কাঁদতে শুরু করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তাকে ধমক না দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রায় বিলাপ করে কাঁদেন। এবারও তিনি তাঁর স্বভাবের ব্যতিক্রম করলেন না। শেষ পর্যন্ত আনিসের ধমক খেয়ে তিনি স্বাভাবিক হন। তারপর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের মতো ছেলের কুশলাদি নেন।
ছোট বোন রুনুর বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। খবরটা আনিসকে দেওয়া হলো। আনিস বলল, রুনুর পছন্দ হলে তার কোনো আপত্তি নেই। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই গোল হয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে। তারপর যে যার ঘরে চলে যায়। খুব সকালে আনিসের ট্রেন ধরতে হবে। ঘরে গিয়ে আনিস ঘুমন্ত মেয়েকে চুমু দেয়। আনিস পরীর জন্য একটি শাড়ি এনেছে। কিন্তু শাড়িটা না পরে ননদের জন্য রেখে দেয়। তারপর তার বিয়ের লাল রঙের শাড়িটা পরে স্বামীর মনের সাধ পূরণ করে। সকালবেলা আনিসের যাওয়ার ক্ষণে রুনু মাকে জিজ্ঞেস করে, ভাবী আজ বিয়ের শাড়ি পরেছে কেন। এই অহেতেুক শাড়ি পরার মধ্যে হয়তো কোনো লজ্জা লুকিয়ে আছে। তাই,—
‘কেউ তার কথার কোন জবাব দিল না। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী আকাশের চাঁদ, পরীকে অহেতুক লজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্যই হয়তো একখণ্ড বিশাল মেঘের আড়ালে তার সকল জ্যোৎস্না লুকিয়ে ফেললো।’ চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও জীবনের একটি ভিন্ন রূপ এই গল্পে খুঁজে পাই। পাঠকের সহানুভূতিই যেন এখানে প্রকৃতির আবরণে ঠাঁই নেয়। নিম্নবিত্ত জীবনের ছোট্ট স্বপ্ন-সাধ ও ব্যর্থতা ঢেকে দেয় বিশাল প্রকৃতি। দারিদ্র্যের কাছে মানুষ তাই পরাজিত হয় না। প্রকৃতি রক্ষক হয়ে এগিয়ে আসে।
এই গল্পে হুমায়ূন আহমেদকে আমরা চেকভের রূপে দেখি। বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা ছোটগল্পকার আনন্ত চেকভ যেমন জীবনের ছোটখাটো বেদনা ও গ্লানিকে ফুটিয়ে তুলতে দরদ আর মায়া দিয়ে, নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনের শোচনীয় বিপর্যয় আর পরাজয় বিশ্বস্তভাবে তার লেখায় ফুটে উঠত, অন্যদিকে সেই পরাজয় আর বেদনার গ্লানিকে তিনি সৃষ্টির অপার মহিমায় ঢেকে দিতেন। হুমায়ূনের ছোটগল্পেও আমরা তাই দেখি।
তবু, জীবন সবাইকে জয়ী করে না। অভাব-অনটনের কাছে হার মানে কোনো কোনো অসহায় মানুষ। তেমনি এক অসহায় পিতা মতি মিয়া। ‘শীত’ গল্পের মতি মিয়া তাঁর একমাত্র পুত্র মেছের আলীকে যুদ্ধে হারিয়েছে। এখন হারানো পুত্র আর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে অবলম্বন করে জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়া। তীব্র শীতের কষ্ট সইতে পারে না বৃদ্ধ মতি মিয়া। তাই সোহাগীর সি.ও রেভিন্যু রশীদ সাহেবের কাছে শহীদ পুত্রের দোহাই দিয়ে কম্বল আনতে যায়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতা সব হারিয়ে ছেলের নাম ভাঙিয়ে এখন শুধু একটু উত্তাপের জন্যে কম্বল ভিক্ষা করে আনে। পুত্র হারানো মতি মিয়ার শহীদের জনক হিসেবে গর্বও করতে পারে না, বরং শহীদের নাম ভাঙিয়ে শীতের প্রকোপ কাটাতে কম্বল ভিক্ষা করে আনে।
বিধাব বৌমাকে বলে, ‘মেছের আলির কারণে পাইলাম, বুজলা না? মেছেরের নাম কইতেই মন্ত্রের মতো কাম হইল। বিলাতি জিনিস, হাত দিয়া দেখ। জবর ওম। চাইর পাঁচশ’ টেকা দাম হইব, কি কও?’ শহীদ মেছের আলীর বিধবা স্ত্রী ফুলজান কিছুই বলে না। দাদি-নাতি কম্বলের ওমে ঘুমায়। যথাবিহিত রাত্রি গভীর হলে ফুলজানের কান্না শোনা যায়। ‘তার কান্না শুনতে মতি মিয়ার কোনো কালেই ভালো লাগে না। কিন্তু আজ ভালো লাগছে। কেমন যেন গানের সুরের মতো সুর।’ অসহায় মতি মিয়ার রুদ্ধ গ্লানিই হয়তো ফুলজানের কণ্ঠে তুলে আনেন লেখক। দারিদ্র্যের কাছে পরাজয়ের লজ্জা, গোপন গ্লানির গল্পটি তীব্র শীতের মতোই শ্লেষ নিয়ে শেষ হয়। লেখক গল্পের শেষে বললেন, ‘আরাম করে ঘুমায় মতি মিয়া। বাইরে প্রচণ্ড শীত। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়ছে। উত্তর দিক থেকে বইছে ঠান্ডা হিমেল হাওয়া।’ প্রচণ্ড শীত, হিমেল হাওয়া, ঘন কুয়াশা—এইসবই গল্পের শেষে নেহাত আর পরিবেশ বর্ণনা থাকে না।
প্রকৃতির সঙ্গে নিম্নবর্গের মানুষের লড়াই করে বাঁচার আরেকটি গল্প ‘বান’। গ্রামীণ জীবনের রুঢ় চিত্র উঠে এসেছে এ গল্পে। গল্প নয়, বরং এটিকে বলা যায় আকস্মিক দুর্যোগের এক স্থিরচিত্রকলা। রহমান, রহমানের বৃদ্ধা মা, রহমানের স্ত্রী বাতাসী, রহমানে ছোট বোন পুতি এবং রহমানের সন্তান রাতের অন্ধকারে আকস্মিক বন্যার পানির ঢল নামতে দেখে দিশেহারা হয়ে যায়। তারা দ্রুত জিনিসপত্র গোছাতে থাকে। সকালের মধ্যেই রেল সড়কের উঁচু জায়গায় যেতে হবে। নইলে বানের জলে ভেসে যেতে হবে। একসময় বুড়ি কেঁদে ওঠে। ‘কুপি ধরাও গো মা, ভেন্দার মত চাইয়া থাইক্য ন।... আরে বেকুব বেটি বুদ্ধি-শুদ্ধি ছটাকটাও নাই।’ দুর্যোগের কালে মাকে ‘বেকুব বেটি’ বলতে ছাড়ে না সে।
অন্যদিকে হাসু চাচা কলাগাছের ভেলায় এগিয়ে এলে, তাকে বলে, ‘তামুক খাইবেন চাচা?’ গ্রামীণ মানুষের আন্তরিকতার চিত্রটি ফুটে ওঠে এ সংলাপে। একে অপরকে সহায়তার চেষ্টাটি এখানে অকৃত্রিম। এই দুর্যোগেও রহমান সাহস রাখে। ছোট বোন পুতির চোখে কান্না, সে নিচু গলায় জানায় তার ভয় করছে। জবাবে রহমানের সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃঢ় উত্তর, ‘ডর লাগনের কিছু নাই। কাম কর।’ আবার বাতাসী যখন আক্ষেপ করে বলে, ধান-চাল সবই যাচ্ছে তখন সে আবার ধমক দেয়, ‘খবরদার প্যান প্যান করবা না।’ বানের পানির তীব্র অসহায় স্রোতের বিরুদ্ধে সর্বস্ব হারানো মানুষের করুণ অথচ দৃঢ় চিত্র পাই এ গল্পে।
হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প ‘সংসার’ একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক গল্প। একটা পাইপের মধ্যে বসবাস করে কুদ্দুস মিয়া। পুত্র মজিদকে নিয়ে আলস্যে, হেলাফেলায় কাটে তার দিন। তার একটা পা অবশ। তার স্ত্রী মনোয়ারা সংসার চালায় আর টাকা জমায় একটা রিকশা কেনার জন্য। কিন্তু কুদ্দুস রিকশা চালাতে চায় না। এতে তার ইজ্জত নষ্ট হবে। ‘রিকশাওয়ালাকে সবাই তুই-তুমি করে। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বলে আপনি করে।’ গল্পের শেষ পর্যায়ে দেখি মনোয়ারা রাতের বেলা এক ভদ্রলোককে নিয়ে ফেরে এবং কুদ্দুস ও মজিদকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে। কুদ্দুস ভাবে—‘রোজ হাশরে মনোয়ারা কঠিন বিপদে পড়বে। স্বামীর সুপারিশ সেদিন গ্রাহ্য হবে না। গ্রাহ্য হলে সে অবশ্যই বলতো, আল্লাহপাক, এই মেয়ে তার সংসার বড় ভালোবাসে। সে যা করছে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যেই করেছে। স্বামী হয়ে আমি তাকে ক্ষমা করেছি। তুমিও তাকে ক্ষমা করে দিও।’ অকর্মণ্য মজিদ পাইপের ভেতর বসে জ্ঞানের কথা বলে। স্ত্রী মনোয়ারা ধমক দিলে সে ভাবে—‘এটাও আদবের বরখেলাপ। স্বামীকে ধমক। স্বামী বড়ই আদরের জিনিস, তারে ধমক দেওয়া যায় না। এর জন্যও রোজ হাশরে মনোয়ারার জটিল অসুবিধা হবে।’ কুদ্দুস সংসার চালাতে পারে না। অথচ সারাদিন সে রোজ হাশর আর বেহেশত নিয়ে ভাবে। এ গল্পের কুদ্দুস মিয়া বলে—‘ও বউ, মনে হইতেছে কবরের ভিতর শুইয়া আছি। মানকের-নেকের আইসা সোয়াল-জোয়াব শুরু করব। মনোয়ারা জবাব দেয়নি। স্বামীর অধিকাংশ কথার সে কোনো জবাব দেয় না। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। রোজ হাশরে মনোয়ারা এই বেয়াদবির কারণে বিপদে পড়বে।’ স্ত্রীর শরীর বিক্রি করা টাকা সে খেতে পারে, কিন্তু ইজ্জত যাওয়ার ভয়ে রিকশা চালাতে চায় না। নিম্নবর্গের মানুষের কথিত ‘ইজ্জত’ সচেতনতা এ গল্পে শ্লেষ তৈরি করে।
এ কথা বলা দরকার, হুমায়ূন আহমেদের গল্পের নিম্নবর্গের মানুষের জীবন ও সমাজ একরৈখিক নয়। সেখানে যেমন পরজায়ের গল্প আছে, তেমনি আছে লড়াইয়ের গল্প, যেমন খণ্ড খণ্ড বিষাদের গল্প আছে, তেমনি আছে টুকরো আনন্দের গল্পও। নগর, মফস্বল, গ্রাম সব পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি নিম্নবর্গের মানুষ নিয়ে গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্পের ক্যানভাসে নিম্নবর্গ শ্রেণি ও সমাজ চেতনার বহুমুখী রূপ বিদ্যমান।