গল্প
মধু মিস্ত্রির পোড়া ঘর

মাথার ওপর খরখরে সূর্য।
গ্রীষ্মের দুপুর। মেঘমুক্ত আকাশ। ভীষণ গরম। আকাশে কয়েকটা চিল, অনবরত ঘুরছে। কখনো গোলাকার বৃত্ত রচনা করে উড়ছে। হঠাৎ আবার সাঁ করে তীরের মতো নিচে নেমে আসছে। কখনো কখনো উড়ছে এলোমেলোভাবে। মাঝে মাঝে চিলগুলো অনেক উপরে চলে যায় দৃষ্টি সীমার বাইরে– গোলাকার ছোট বলে রূপ নেয় চিলগুলো। দিগন্তবিস্তৃত ওই অসীম শূন্যতায় চিলগুলো কেন ঘোরে? কীসের ঘোরে টালমাটাল হয়ে ঘুরছে ওরা? মধুসূদন মিস্ত্রির মনে প্রশ্ন জাগে– ওরা কেন ওড়ে? চিলগুলোর ঠিকানা কোথায়? সে কোনো জবাব খুঁজে পায় না।
মধুসূদন মিস্ত্রিকে এ এলাকার সবাই চেনে। সংক্ষেপে মধু মিস্ত্রি ডাকে। নামটা সংক্ষিপ্ত করে ডাকলে কোনো আপত্তি নেই। কারণ মা বাবাই তো মধু নামে ডাকত। মধু মিস্ত্রির বয়স ষাট বছরের কাছাকাছি। মুখে লম্বা দাড়ি। অধিকাংশ দাড়ি পেকে সাদা। নাকের নিচে একজোড়া তেমন সাদা গোফ। পাকা দাড়ি আর গোফ মিলিয়ে দেখতে খানিকটা ঋষি মনে হয়। মধু মিস্ত্রি আপন মনে নানা জায়গায় হাতুড়ি-বাটালি পেটায় আর মরমি গান গায়। এই বয়সেও কণ্ঠস্বর দরাজ ও সুরেলা। ওর গান শুনে অনেক বৌ-ঝিয়েরা কান পেতে নীরবে শোনে।
অনেকে প্রশ্ন করে, মধু দা, তুমি প্রথম জীবনে গান গাইতে না কি?
আরে না। দরাজ হাসে সে–গান আমার ভালো লাগে। ছোটবেলা থেকেই গান আমার প্রিয়। এখনো মন ভালো থাকলে দু-একটা গান গাই। ছোটবেলায় গায়ের জলসায় যেতাম। এই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোনো দূর গ্রামে গানের জলসা হলেও যেতাম। তার জন্য মা-বাবার অনেক বকা খেয়েছি। মারও খেয়েছি।
তুমি নিজে গাইতে না মধু দা?
না। বাপে হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন হাতুড়ি-বাটালি। বানাতে শিখলাম ঘর। নৌকা। শুরু হলো আমার নতুন জীবনের ধারাপাত। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরোয় নাক চিরে। বোধহয় গান শিখতে না পারায় ভেতরের কষ্ট হামাগুড়ি দিয়ে হাটে। এক ধরনের বেদনা তাকে বিমর্ষ করে। মাঝে মাঝে মধু মিস্ত্রি নিজের কাছে নিজেই স্বগত সংলাপে বলে–আমার মনে তেমন কোনো কষ্ট নেই। গানের চেয়েও কঠিন শিল্পকর্ম শিখেছি। মানুষের জন্য ঘর তৈরি করছি। পারাপারের নৌকা, ঘর বানাই। আমার হাতে বানানো শত শত ঘর এ গ্রামে। এই ঘরে থাকে কত মানুষ। জন্ম হয় আরো নতুন মানুষের। স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে দুঃখে, আনন্দে জীবন যাপন করে। ছেলেমেয়ের বিয়ের বয়স হলে আমার বানানো ঘরে হয় অনুষ্ঠান। কত আনন্দের উৎস আমার বানানো ঘরে। এইতো আমার বড় গান। বড় শিল্পকর্ম। মধুমিস্ত্রির কথায় সবাই সমর্থন জানায়।
তার বানানো নৌকায় কত লোক আসা যাওয়া করে এখানে-সেখানে। খেয়াঘাটে চরণ মাঝি যে নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করে সে নৌকাটাও তার বানানো। খেয়া নৌকাটা দুইপারের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির সেতু।
গেদু মাঝি আসছে তার নৌকা নিয়ে। মধু মিস্ত্রি বসে আছে কচা নদীর পারে। নদীর স্রোত দেখছে। এখন নদীতে উল্টোস্রোত। ভাটা। ভরা গাঙ্গ আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাবে। যেন অনেকটা চিলের স্বভাব। পানি কোথায় যায়? কোথা থেকে এত বিপুল পানি আসে? পানির ঘরবাড়ি কি বিশাল সমুদ্র? তাহলে সমুদ্র থাকে কোথায়? না, সে জবাব পায় না। নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়া কচুরিপানা দেখছে মধু মিস্ত্রি। কোথায় ছিল এই ঝাঁক ঝাঁক কচুরিপানা? যাবে কোথায়? মাঝে মাঝে মরা গরু ভেসে যায়। মাংসের লোভে কাক ওড়ে। ছোট মাছরাঙ্গা পাখি ডানা ঝাঁপটায় তার ওড়ে। কখনো কোথাও একটা মাছ দেখলে সাঁই করে নেমে এসে মাছ মুখে তুলে নেয়। তাজা মাছটি দু’ঠোটের মাঝখানে লাফায়। অবাক চোখে মাছরাঙ্গার মাছ ধরার কৌশল দেখে। নদীর স্রোত বইছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। একটা জাহাজ আসছে। সামনে অনেকগুলো নৌকা। তিন-চারটে ডিঙ্গি। বাকিগুলো ছৈয়ালা নৌকা। সবার সামনে গেদু মাঝির নৌকা।
ও মধু দা করছেন কী বসে বসে? বৈঠা বাইতে বাইতে তাকে প্রশ্ন জুড়ে দেয় গেদু মাঝি।
কিছু না। উদাস কণ্ঠে জবাব দেয় সে। নদীর স্রোত দেখছি। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
পারেরহাট।
ধানের দর কেমন?
একটু বাড়ছে।
আর কথা বলা যায় না। গেদু মাঝি সওয়ারী নিয়ে দূরে সরে গেছে। স্রোতের টানে নৌকা দ্রুত চলে। এখনই সামনের খালে নৌকা ঢুকবে। ধান-চালের দাম বাড়ছে শুনে মধু মিস্ত্রির মুখ ছোট হয়ে যায়। কেমনে বাঁচবে মানুষ? তর-তর করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। মানুষের দাম বাড়ছে না। বরং দিন দিন সস্তা হয়ে যাচ্ছে। কচা নদীর স্রোতে প্রতিদিন লাশ ভেসে আসে। মানুষের বেঁচে থাকাই অপরাধ।
মাথার ওপর একটা শিমুল গাছ। গাছটায় একটাও পাতা নেই। ফুলে ফুলে গাছের ডালপালা ভরা। লাল ফুল। রক্তের রং। ফুলে ফুলে পাখিদের মেলা। নানা প্রকার পাখি। কিচিরমিচির ডাক। হাল্কা ছায়া।
কে? মধুদাদা?
মধু মিস্ত্রি পিছনে তাকিয়ে দেখে আলতাফ।
হ্যাঁ আমি। তুমি কী করছো?
গরু নিয়ে এসেছি। গোছল করাবো।
তোমার সাদা গরুটা বিয়োবার কথা ছিল না?
বিয়িয়েছে। দামড়ি বাছুর হয়েছে। আলতাফ কথা বলতে বলতে তার পাশে কোমড় থেকে গামছা বের করে বসে পড়ে।
মধু মিস্ত্রি ওর দিকে ফেরে-দুধ কয় সের হয়?
বেশি না দাদা। সের দুই।
আচ্ছা। চুপচাপ থাকে তারা। দুজন এক দৃষ্টিতে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। গরু ঘাস খেতে খেতে অনেক দূরে চলে যায়। খেয়াল থাকে না আলতাফের।
দাদা?
কী আলতাফ?
কী ভাবছেন?
ভাবছি?
হ্যাঁ! অত তন্ময় হয়ে কী ভাবছেন?
ভাবছি, তোমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেমন করে যাব-এই দেশ ছেড়ে তাই ভাবছি।
কেন যাবেন আপনি? অন্যায়কে আপনি মেনে নেবেন কেন?
অন্যায় কাকে বলছ? মধু মিস্ত্রি প্রশ্ন করে।
কোনো এইদেশ ছেড়ে যাবেন? জন্ম নিয়েছেন, বড় হয়েছেন এখানে, এই মাটিতে। বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। ছেলেমেয়ের বাপ হয়েছেন। মানুষের উপকার ছাড়া ক্ষতি করেননি– তারপরও কেন দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হবে আপনাকে?
আমি যে হিন্দু।
তাতে কি হয়েছে, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এর ওপর জোর চলে না। আমরা মানুষ। আপনি এ দেশের মানুষ–এটাই পরম সত্য। আপনি যাবেন না।
না গেলে আমার মেয়েটির সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বলেন কী দাদা?
হ্যাঁ ভাই। এটাতো আমারই দেশ। ঘর-সংসার মাটি ছেড়ে যেতে কি আমার কষ্ট হবে না?
হবে তো। কিন্তু আপনার মেয়ে বাসন্তীতো আমাদেরও মেয়ে। আমার মেয়ের সঙ্গে এক সঙ্গে স্কুলে পড়ে। আলতাফ অজস্র বেদনায় ফেটে পড়ে। মুখ হা, চোখ বিস্ফারিত। এ ছাড়া আলতাফ আর কি করতে পারে? বুক হাহাকারের হাওয়ায় উথাল-পাতাল।
মধু মিস্ত্রি আলতাফের বিক্ষোভে হাসে, বুক চেরা ম্লান-হাসি... তুমি আমি যেটাকে সহজ সরল স্বাভাবিক ভাবি, ওরা সেটাকে অন্যরকম ভাবে।
কিন্তু এভাবে পালিয়ে বেড়ান কেন? প্রতিবাদ করবেন না!
করব। তাই চলে যাচ্ছি।
এভাবে চলে গেলে মাটি, এই মাটি আপনাকে ক্ষমা করবে না। আমিও আপনাদের ক্ষমা করব না। আলতাফ উঠে চলে যায়। ওর খারাপ লাগে। ভীষণ খারাপ লাগছে। একই গ্রাম। পাশাপাশি বাড়ি। মাঝখানে ছোট্ট একটা মাঠ। জন্ম থেকে একই সঙ্গে বড় হয়েছে। মধু মিস্ত্রিকে কেন চলে যেতে হবে চিরকালের বাস্তুভিটা ছেড়ে? এর নাম কি? ধর্ম? কোথায় লেখা আছে ধর্মের এমন বিধান? আলতাফ গরু খোঁজে আর চোখ মোছে।
গতকাল সন্ধ্যায় আফসার মিয়া এসেছিল মধু মিস্ত্রির বাড়িতে। আগেও এসেছিল কয়েকবার। মধুর দু’ছেলে এক মেয়ে। ছেলে দু’টি বড়। মেয়েটিও বিয়ের উপযুক্ত। বাসন্তীর জন্যে এরই মধ্যে কয়েকবার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। রাজি হয় না। অসুস্থ বাসন্তীর মা। বিয়ে হলে সংসার চলবে কেমনে? মেয়েটিকে মধু মিস্ত্রি বড় বেশি ভালোবাসে। ভালোবাসায় এক ধরনের বিষাক্ত বিষয় আছে। বড় ছেলেটি বিয়ে দিয়ে একটা বৌ ঘরে আনার পর বাসন্তীর বিয়ে দেবে এ রকম একটা বিবেচনা মধু মিস্ত্রির মধ্যে আছে। ছেলের বিয়ের জন্যে মেয়েও দেখেছে। মেয়ে পক্ষ ছেলের বাড়ি দেখতে আসার কথা ছিল আগামী মাসে। মেয়েটিকে দেখে ভালোই লেগেছিল তাদের। কিছুই হলো না। যেভাবে যুদ্ধ শুরু হয়েছে! প্রতিদিন শহর থেকে সর্বশান্ত লোকগুলো গ্রামে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। এ সময়ে কোনো বিয়ের কথাবার্তা বলা যায় না।
আফসার মিয়া এই এলাকার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তার স্পষ্ট কথা এটা মুসলমানদের দেশ। এখানে মুসলমান থাকবে। কোনো মালাউন থাকতে পারবে না। থাকতে যদি হয় তাহলে ধুতি ছেড়ে, টিকি কেটে মুসলমান হতে হবে। দাড়ি রাখতে হবে। লম্বা জামা গায়ে দিয়ে মাথায় গোলটুপি পরে নিয়মিত নামায পড়তে হবে। অনেকগুলো ‘হবে’ যোগ করে আফসার মিয়া।
গতকাল সন্ধ্যায় এসে জানতে চেয়েছে মধু মুসলমান হবে না এ দেশে ছেড়ে চলে যাবে?
আফসার মিয়াকে শেষ কথা জানতে হবে। পাঁচ মাইল দূরে ইকরি বাজারের ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার না-কি বাসন্তীর খবর বারবার জানতে চেয়েছে। বাসন্তী ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে শুনছে। দুঃখে-কষ্টে অপমানে মধু মাটির সঙ্গে মিশে যায়। আক্রোশে বুকের পাঁজর ভাঙে। তার কাছে কেমন অশ্লীল লাগে সবকিছু। সভ্যতাকে ধ্বংস করার হিংস্র জিঘাংসা জাগে মধুর। কিন্তু কিছুই পারে না। মাঝে মাঝে প্রবল ঢেউ যেভাবে তীরে এসে অসহায়ভাবে মুখ থুবরে পরে। মধুও সেভাবে ভেঙে পড়ে। বাসন্তীর মুখ তাকে নাড়া দেয়।
আশপাশের সবাই চলে গেছে। মধুকে যাবার জন্য বারবার বলেছে তারা। মধু রাজি হয়নি। বাসন্তী তো যেতেই চায় না। ওর আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, পুই, মাচা পেপের সুন্দর বাগান রেখে কোথাও যাবে? বাসন্তীর অনেকগুলো হাঁস-মুরগী। নিজে যত্নের সঙ্গে বড় করেছে। এসব রেখে কোথায় যাবে বাসন্তী, কেন যাবে? কি অপরাধ তার? কি অন্যায় করেছে তারা? বাসন্তীর এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না মধু। সমস্যা আরো আছে। বাসন্তীর মা অসুস্থ। চার-পাঁচ বছর ধরে হাপানিতে বিছানা নিয়েছে। আরো আছে বিশ্রী মাথার যন্ত্রণা। সংসারটা বাসন্তীর মুঠোয়। অতটুকুন ১৬ বছরের মেয়ের আঁচলে সম্পূর্ণ সংসারের একটা চাবি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে মধুর মায়ের কথা মনে হয়। অবিকল তার মায়ের আকৃতি পেয়েছে মেয়েটি। বাসন্তীকে সে মা বলেই ডাকে।
কী মশাই, আমার কথাটা তোমার মনে আছে? বাজখাই গলায় জিজ্ঞেস করে আফসার মিয়া। সাথে চার-পাঁচজন লোক। ওদের কাঁধে রাইফেল।
আছে মিয়া সাব।
তোমরা এখানে থাকছ তাহলে? আফসার মিয়ার কঠিন জিজ্ঞাসা।
না।
না?
হ্যাঁ মিয়া সাব। আমরা চলে যাব।
অ–আফসার মিয়ার মুখ থেকে অদ্ভুত একটা জানোয়ার জাতীয় জান্তব শব্দ বেরোয়। মনের ভেতর লুকানো ইচ্ছেটা আর বোধহয় বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সে মেজর সাহেবকে বিশেষ উপহার পাঠাতে চেয়েছিল। অথচ মধুরা চলে যাবে। আর সময় নেই। যা করার এখনই অর্থাৎ খুব তাড়াতাড়ি করা দরকার।
মধু মিস্ত্রি বোধহয় আফসার মিয়াকে বুঝতে পেরেছে। আফসার পারে না এমন কিছু নেই। পাশের গ্রামের অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। যারা গেছে তারা আর ফিরে আসেনি। কোনো মা-বাবা কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। হুমকি দিয়েছে এসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে গেলে গুলি করে মারবে। ঘরে আগুন দিয়ে পুড়ে ছারখার করার হুমকিও দিয়েছে রাজাকারেরা। কখনো কখনো মানুষের কাছে ইজ্জতের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি হয়ে দেখা দেয়। অনেক তরুণ ছেলেকে ধরে নিয়ে রাজাকার বানিয়েছে। আশপাশ এলাকার মানুষ আফসার মিয়ার ভয়ে আতঙ্কিত। এলাকার অনেক হিন্দু মাথায় টুপি দিয়ে আফসার মিয়ার নও মুসলিম রেজিস্ট্রার খাতায় মুসলমান হওয়ার নাম তালিকাভুক্ত করে তার মসজিদে নামাজ পড়ছে। ও পাড়ার রমেশ শীলের ছেলে খগেনকে রাজাকারেরা ধরে নিয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে পাওয়া গেল কচা নদীর পাড়ে। লাশ সে। খগেন একমাত্র ছেলে ছিল রমেশ শীলের।
মধু মিস্ত্রির কাছে জীবন এখন একমুঠো ধুলোর সমান। পৃথিবীতে সস্তা যদি কিছু থাকে সে মানুষের জীবন। এত সস্তা জীবন পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাওয়া যাবে না। ভেবে অবাক মধু জীবনের এ কোনো অস্থি সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছল? কোনো সমস্যাই তো ছিল না। হাজার বছর ধরে হিন্দু-মুসলমান পরম্পরায় পাশাপাশি যমজ ভাইয়ের মতো বসবাস করে আসছে। মনে কখনো প্রশ্নই জাগেনি– কে হিন্দু, কে মুসলমান। হিন্দুধর্ম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই কি এ দেশে তার কোনো অধিকার নেই? ছেলেমেয়ে কি পরিবার-পরিজন নিয়ে মায়া-মমতার বন্ধন ছিড়ে তাদের যেতেই হবে? কোথায় যাবে? সেখানে, তাদের কী অধিকার? ধর্ম বড়? না জন্ম বড়? রাজনীতির প্রতি ঘৃণা ধরে মধুর। একটা ভূখণ্ডকে কতবার ভাগ করতে চায় এরা? মানুষের রক্ত পান করে কী লাভ ওদের? এতসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না মধু মিস্ত্রি। বুকের মধ্যে খরা। খরার আগুনে বুকটা জ্বলছে তার। লোকমুখে শুনেছে কচা নদীর ওপারে মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে। এপারে কেন আসছে না? ওরা কবে আসবে?
গ্রামের কেউ এখনো টের পায়নি বড় ছেলে মাখন মুক্তিযুদ্ধে গেছে। ও কবে আসবে, তাও জানে না মধু। কোথায় আছে, কেমন আছে– জানে না পিতা মধু মিস্ত্রি। মরণ সমুদ্রের মাঝে ছেলেকে পাঠাতে হয়েছে। ওরা যদি এ সময়ে আসত– আফসার মিয়াকে একটা কঠিন শাস্তি–মধু মিস্ত্রির জীবনের বড় সাধ এ দেশের মাটিতে মরা। এ যে জন্মভূমি। এ মাটি তার আপন আত্মার ঠিকানা। মরে যাওয়ার পর কচা নদীর পাড়ে শশ্মানে তার এই দেহ, পোড়ানো হবে। কচা নদীর অথৈ জলে ভাসতে ভাসতে তার ছাই মিশে যাবে গঙ্গায়। সে সব আর বুঝি হচ্ছে না। এ দেশের মাটিতে মরার অধিকারটুকু তার নেই? এই জন্য কি সে বিরাট চৌচালা ঘর বানিয়েছিল? মনের মতো করে ঘর বানিয়েছে মধু। জানালা কপাটে ফুল করা। রং মাখা। বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে কাঠের ময়ূর নাচে পেখম মেলে। সে ঘরটাকে দেখে। মুগ্ধ চোখে দেখে নিজের নির্মাণের সুনিপুণ কারুকাজ। মনের মাধুরী মিশিয়ে মধু মিস্ত্রি বানিয়েছে নিজের ঘর। ঘরের সামনে বড় উঠোন। নিকানো পরিপাটি সাজানো। পাশে বাসন্তীর ক্ষেত। মানুষের হাতে গড়া ছোট একটা স্বর্গ।
বিকেল হয়েছে। ঘরে ফেরা দরকার। কীসের ঘর? যে ঘর নিজের হাতে বানিয়েও বলতে পারছে না... এ আমার ঘর। তবুও ফিরতে হবে। যতক্ষণ থাকবে এ মাটিতে ততক্ষণ এ ঘর তার। ঘরে মেয়েটির করুণ বিষণ্ণ মুখ। সারাক্ষণ কাঁদে আর মালপত্র বাঁধে। সান্ত্বনার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মেয়েটিকে আর কাঁদাতে চায় না। বাসন্তীর মা বিছানায়। শারীরিক এবং অন্তরপোড়া মানসিক ব্যথা নিয়ে বিছানায় কাতরায়।
দাদা ও মধু দাদা?
ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় মধু মিস্ত্রি। সামনে জয়নাল দাঁড়ানো। জয়নাল থাকে আফসার মিয়ার সঙ্গে। বছর খানেক আগে জয়নালের ঘর তৈরি করে দিয়েছে সে। জয়নাল খুশি হয়ে তাকে একটা বড় কলসি উপহার দিয়েছে। সেই জয়নাল কেন তার সামনে?
ও দাদা? আবার ডাকে জয়নাল।
ভয়ে কেঁপে উঠে মধু মিস্ত্রি। জয়নাল কি তাকে নিয়ে যেতে চায়? আমাকে ডাকছ ভাই?
হ্যাঁ দাদা।
কেন? আমি তো ভাই তোমার কোনো ক্ষতি করিনি।
জয়নাল হাসল– আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। আমি আপনার বাড়ি গিয়ে বাসন্তীর কাছে শুনলাম আপনি এখানে। তাই এসেছি।
কেন এসেছ আমার কাছে? আমি তো চলে যাব ওপারে।
সে জন্যই তো এলাম। আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না দাদা। আমি আপনাদের লোক।
মানে?
আমি আফসার মিয়ার দলের কাজ করলেও আমি আসলে একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তাই?
হ্যাঁ দাদা। তবে এখানে এখন আমি একা। তাই কিছু করতে পারছি না। কিছুটা সময় লাগবে। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন–এখান থেকে চলে যাবেন।
চলে যাব?
হ্যাঁ যাবেন। কারণ দু-এক দিনের মধ্যেই আফসার মিয়া আপনার ঘরে আসবে। আপনাদের মেরে ফেলবে। আর বাসন্তীকে–
না ভাই, না– মধু মিস্ত্রি জয়নালের হাত ধরে কেঁদে ফেলে। তুমি আমাকে বাঁচাও। আমার ধর্ম মান-সম্মান...
দাদা, এখন কান্নার সময় নয়। শক্ত হোন। দুনিয়ার সবাই অমানুষ নয়। এখন চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর চলে আসবেন। আমি আছি। আপনার কোনো ভয় নেই।
দেশ স্বাধীন হবে? কবে? ওই এই হানাদারদের হাত থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পাবে?
হাসে জয়নাল… মধু দাদা, আগেই বলেছি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা আসবে। আফসার মিয়ারা ভয়ে কাঁপছে। তার আগে মরণ কামড় দিতে পারে। হয়তো হানাদার পাকিস্তানি সেনারাও আসতে পারে। এখানে মরণ-পণ লড়াই হবে।
ভাই আমার বুকে সাহস হলো, তোমার কথা শুনে।
এটা তো আমার কর্তব্য। আর আফসার মিয়া স্ট্যাম্প নিয়ে আসবে।
কেন?
আপনার সই রাখবে।
কেন?
আপনার বাড়িটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে আর মালিক হতে না পারেন সে জন্য সই রাখবে।
উপায়? মধু মিস্ত্রির কণ্ঠে কান্নার আবহ।
বললাম তো। আমি একা। আপনার সর্বনাশ কোনোভাবে একা ফিরাতে পারব না। চলে যান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। খুব শিগগিরই দেশে স্বাধীন হবে। জলে স্থলে মুক্তিযোদ্ধারা ওদের আক্রমণ করেছে। জেনারেল নিয়াজি চোখে অন্ধকার দেখছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন কি? পাকিস্তানি হারামজাদারা ভাবতেও পারেনি এ দেশের ফ্যান-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালিরা এমন সাঁড়াশি আক্রমণ চালাবে।
আমাকে যেতেই হবে?
হ্যাঁ দাদা। মাত্র কয়েকদিনের জন্য।
ঠিক আছে ভাই, আমার আশীর্বাদ রইল তোমরা … বলতে পারে না সে। কাঁদতে চাঁদতে চলে যায় মধু মিস্ত্রি।
সন্ধ্যার ঝিলিমিলি আকাশ।
চাঁদ নেই আকাশে। ঝাঁক ঝাঁক তারা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে মাটির পৃথিবীকে। অন্ধকার-মিশমিশে কালো অন্ধকার। এই অন্ধকারই চেয়েছিল মধু মিস্ত্রি। সে, মেয়ে বাসন্তী, বাসন্তীর মা অন্ধকারকে সঙ্গী করে চুপি চুপি নৌকায় ওঠে। বেশি জিনিসপত্র সঙ্গে আনেনি। পুরো সংসারটা পড়ে আছে। আহমেদ মাঝি ওদের পৌঁছে দেবে নদীর ওপারে। নৌকা এখনই ছাড়বে।
মা?
বাবা? বিষণ্ণ কণ্ঠে জবাব দেয় বাসন্তী।
তোরা যা আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছ বাবা?
ঘরে যাব। আমার জন্য অপেক্ষা করবি না। মাঝি ভাই ওদের পৌঁছে দিও, নৌকা থেকে নেমে যায় মধু। মিশে যায় গভীর অন্ধকারে। পিছন থেকে ডাকে বাসন্তী–বাবা? ও বাবা?
মধু মিস্ত্রি ফেরে না। হাঁটে। জোরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় ঘরের কাছে। নিজের শ্রমে-ঘামে শিল্পের মাধুর্যে বানিয়েছে ঘর। সেই ঘর ছেড়ে যেতে হচ্ছে? আত্মা ছিঁড়ে যায়। অন্তর কাঁদে। রক্তে জোয়ার আসে। ভিন্ন রকম জোয়ার।
আফসার মিয়া দলবল নিয়ে আসছে। মেজর সাহেব খবর পাঠিয়েছে জোয়ান হিন্দু লাড়কি পাঠাও। মুসলমান বানিয়ে নেব।
মধু মিস্ত্রি কাপড়ের কোচড় থেকে দিয়াশলাই বের করে। খচ শব্দে কাঠি জ্বালায়। অল্প আলো। হাত কাঁপে। ধরিয়ে দেয় ঘরের কার্নিস। ধীরে ধীরে আগুনের লেলিহান শিখা সমস্ত বাড়িটাকে গ্রাস করে। দূর অনেক দূর থেকে আগুনের লকলকে জিহ্বা দেখা যায়। মানুষজন ছুটে আসছে। বুঝতে পারছে না তারা, কী ঘটছে? রাজাকার বা হানাদারবাহিনীর আক্রমণ? না-কি অন্যকিছু? গোলাগুলির শব্দ নেই। মানুষজনের সঙ্গে আফসার মিয়াও দলবল নিয়ে এসেছে। বুঝতে পারছে না মধু মিস্ত্রির বাড়িতে আগুন লাগাল কে, কেন?
লোকজন যখন শুধু মিস্ত্রির ঘরের চারপাশে দাঁড়ানো তখন তারা আগুনে শিখায় পোড়া মাংসের গন্ধ পায়।
জয়নাল আগুনের গন্ধে মানুষের ডাক শুনতে পায়।
আর বাসন্তীদের নৌকা?
অনেক দূরে। কচানদীর অপর পাড়ে। আফসার মিয়া এবং তার দল মধু মিস্ত্রির স্বপ্ন, এই মাটিতে পোড়ার সাধ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। মধু মিস্ত্রির পোড়া দেহ, পোড়া ঘর প্রমাণ। পরাজিত আফসার ভবিষ্যতের কাছেও।