সাক্ষাৎকার
সংস্কৃতি আধিপত্য বিস্তার করে না : বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বেশকিছু দিন ধরেই শুনছিলাম পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বাংলাদেশে আসছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির আসার কথা শুনে সেদিন বেশ পুলকিতই হয়েছিলাম। গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে যখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ঢাকা থেকে রাজশাহীতে আসেন, তখনই আলাপ করার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি। তাই পরের দিন সকালে (১৭ নভেম্বর) রাজশাহী নগরীর পদ্মামঞ্চে গিয়ে ১০টা থেকেই অপেক্ষা করতে থাকি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় দুপুর ২টার দিকে। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলার পর, তাঁর যাওয়ার সময় হয়ে যায়। কিন্তু আমার কথা তো তখনো ফুরোয়নি। কথা শেষ হয়নি জানালে আমাকে পরে সাক্ষাৎ করতে বলেন। সাড়ে ৩টার দিকে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটিতে সাক্ষাৎ করলে তখনো সময় জোটে না। পরে তিনি সন্ধ্যা ৭টায় নগরীর সার্কিট হাউসে আসতে বলেন। সেখানেই হয় বুদ্ধদেবের সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা। সঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সিনেমার প্রসঙ্গ তো আছেই। আজ বুধবার (১৮ নভেম্বর) তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতদিনব্যাপী ‘দুই বাংলার চলচ্চিত্র উৎসব-২০১৫’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
প্রশ্ন : আপনি তো একজন কবি। আপনি পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতিতে, শিক্ষকতাও করেছেন সেখানে। তো কোন জিনিসটা আপনাকে চলচ্চিত্রে টানল, চলচ্চিত্রের পথে হাঁটতে শেখাল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : প্রথমেই বলি, আমার আদিবাস কিন্তু এখানেই। এখানেই আমার মা পিয়ানো শিখেছেন। পিয়ানো বাজাতেন আর আমরা শুনতাম। কবিরা পড়তেন, আমরা শুনতাম। মা বলতেন যে, চোখ বন্ধ করে শোনো। চোখ বন্ধ করে সুর শুনতে শুনতে, কবিতা শুনতে শুনতে এক ধরনের ইমেজ মাথায় এলো। তারপর যখন বড় হলাম, পেইন্টিং দেখতে যেতাম। দেখলাম যে একটা পেইন্টিং, শুধু একটা পেইন্টিং না। এটার পেছনে, সামনে আরো অনেক ইমেজ আছে। এভাবেই ইমেজের প্রেমে আমি পড়লাম। তাহলে বোঝা যায় যে, পরোক্ষভাবে মা-ই আমাকে সিনেমায় নিয়ে আসছে।
তারপর কবিতা লিখতে গিয়ে দেখলাম, কবিতাও কিন্তু প্রচুর ইমেজের জন্ম দেয়। আরেকটা জিনিস কবিতায় যায়, সেটা হচ্ছে ইঙ্গিত। ‘ইন বিটুইন লাইনস’ বলে একটা কথা আছে। দুই লাইনের মাঝখানে আরো অনেক শব্দ থাকে কবিতায়। যেগুলো কবি লেখেন না। যেগুলো পাঠক ধরতে পারে। সিনেমাও তাই। এভাবেই সিনেমার প্রেমে আমি পড়লাম।
প্রশ্ন : তার মানে, সিনেমা-কবিতা সবকিছুই ইমেজের খেলা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কিছু পরিমাণে তো বটেই। ইমেজের খেলা বলছি না। আমি যেটা বলতে চাইছি, কবিতার মধ্যেও ইমেজ লুকিয়ে আছে। সুরের মধ্যেও ইমেজ লুকিয়ে আছে। এবং পেইন্টিং, পেইন্টিংয়ের মধ্যে ইমেজ তো আছেই। শুধু যে আঁকা হচ্ছে তা নয়। স্ট্যাটিক যে জিনিসটা আমরা দিচ্ছি তা নয়। অনেক ইমেজ এর পেছনে আছে, বা সামনে আছে।
যখন তুমি কোনো বিখ্যাত মানুষের একটা পেইন্টিং দেখছো, তখন তোমার মনে হবে এর আগে কী হচ্ছিল, পরে কী হচ্ছিল। সেগুলো ইমেজের মধ্য দিয়ে ভাবতে পারবে। এভাবেই আমি শিখেছি। আমি পড়েছি ইকোনমিকস, ম্যাথমেটিকস। কিন্তু সিনেমা আমার রক্তের ভেতরে। যেটা আমি আমার নিজের ধারায়, যেটা বলছিলেন এঁরা (প্রেমেন্দ্র মজুমদার ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু)। নিজের পদ্ধতিতে, নিজের স্টাইলে ছবি করি। যেখানে কবিতা মিশে যায় সুরের সঙ্গে। সুর মিশে যায় পেইন্টিংয়ের সঙ্গে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার সিনেমাতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেখানে আপনি একধরনের কবিতাই বলার চেষ্টা করেন। যেমন ‘চরাচর’-এর কথা বলি। সেখানে একজায়গায় লেখা বলছে, ‘সমুদ্র দেখেছে, এমন একজনকে আমি দেখেছি’। আবার আরেক জায়গায় বলছে, ‘শাড়ি থাকলে পাখি থাকে না, পাখি থাকলে শাড়ি থাকে না’। আরেক জায়গায় বলছে, ‘আমরা শিকার করি পাখি, শাষমল বাবুরা শিকার আমাদের।’ সহজভাবে আপনি কত গভীর জিনিস বলার চেষ্টা করছেন। যেটা আপনি কিছুক্ষণ আগেই বললেন। তো আপনি কি চলচ্চিত্রকে বড় আকারের কবিতা মনে করেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তা নয়। আমি সিনেমা যখন করি, সিনেমাই করি। কবিতা যখন লেখি, কবিতাই লেখি। কিন্তু আমার মতো করে সিনেমা করতে গিয়ে, এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো কবিতার মধ্যেও আছে, সেগুলো ঢুকে যায়। যেমন তোমাকে একটা কথা বললাম, দুই লাইনের মধ্যে অনেক শব্দ কবি ঢুকিয়ে দেন। আমারও মনে হয়, ইন বিটুইন শটস, প্যাশনিং শটস, যে শটটা পরিচালক তুলেন নাই। দুটো শট দিয়ে তুলে দিবে। এই যে ব্যাপারটা, এই যে স্টাইলটা, এই যে ভঙ্গিটা- এটা সারা পৃথিবী জুড়ে আলোচিত হচ্ছে আজকে। বলছেন ওরা যে, পয়েটিক সিনেমা। কিন্তু ব্যাপারটা আরেকটু অন্যরকম। যেটাকে বলা যায় যে, ম্যাজিক্যাল রিয়েলিটি। এই রিয়েলিটিকে যদি এক্সটেন্ড করা যায়। তাহলে যে এক্সটেন্ড রিয়েলিটি পাব সেটার মধ্যে ম্যাজিক আছে। সেইটাই কিন্তু আমার ছবি। আমার ছবির সেইটাই যখন লোকে দেখেন, অনেকে সেটাকে কবিতার মতো করে বলেন।
প্রশ্ন : আমি ইয়াসিন ও মধুবালা, কালপুরুষ আর চরাচর-এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রধান চরিত্রের মধ্যে কোথাও এক জায়গায় মিল আছে। আপনি এই ধরনের চরিত্রকে কেন বেছে নেন বারবার?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : (হেসে) আমি বেছে নেই না। এরাই আমার কাছে চলে আসে। বলে যে, আমাদের কথা বলুন। আমার মনে হয়, এমন মানুষ আমি সব সময় বাছতে চাই। এবং শেষ যে ছবি আমি করলাম- টোপ। এই করেই আমি এসেছি। সেখানেও একজন ব্যতিক্রম মানুষ। এই ব্যতিক্রম মানুষ কিন্তু ডাক্তার না, ইঞ্জিনিয়ার না। রাজনৈতিক না, মন্ত্রী না, কিছুই না। সাধারণ একজন মানুষ। তোমার-আমার মতন অত্যন্ত সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু ব্যতিক্রম একটা মনে হয়। কোথায় যেনো সে আলাদা। এই পৃথিবীতে। এদের আমার খুব ভালো লাগে। এদের আমি খুঁজে বেড়াই। যেমন ধরো লখা। তুমি যদি দেখ, লখা কিন্তু খুব ব্যতিক্রমী একজন মানুষ। তাই না? ও পাখি ধরে- কিন্তু এতো ভালোবাসে পাখিগুলোকে- উড়িয়েও দেয়। এই পাখি উড়িয়ে দিতে গিয়ে ও কিন্তু জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে। এই লখাকে তুমি কোথায় পাবে। তাই না? একটা-দুটো লখা হয়তো আছে। এই লখাদের আমি খুঁজে বের করতে চাই। এরাই আমার মনে হয় যে, পৃথিবীকে একটু অন্যরকম স্বাদ দেয়।
প্রশ্ন : আপনি কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হয়ে নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, এই মূল্যায়নগুলো এভাবে হয় না। কবি হিসেবে যেমন নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলতেই থাকে, ফিল্মমেকার হিসেবেও নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চলতেই থাকে। এই যুদ্ধের মধ্যে হতাশা আছে, ব্যর্থতা আছে, সমালোচনা আছে। নিঃসঙ্গতা, সবই আছে। যেহেতু সত্তাটা একই, সেটা বিভাজিত হয়ে একটা আরেকটাকে সমালোচনা করতে পারে না। যেটা হয়, নিজের কাজ সম্পর্কে নিজের একটা ধারণা থাকা উচিত। আরো কত দূর এগোতে হবে, এগুলোর ঠিকঠাক আবির্ভাব চলতেই থাকে, চলতেই থাকে।
প্রশ্ন : আপনার সিনেমা যে কয়েকটা দেখেছি তাতে যেটা বুঝতে, অনুধাবন করতে পেরেছি, সিনেমাগুলো মুক্তির কথা বলতে চায়, স্বাধীনতার কথা বলতে চায়। পৃথিবীর সব দেশেই বিভিন্ন নিমার্তারা, যারা স্বাধীনতার কথা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে জাফর পানাহি বলি, উসমান সেমবেন বলি কিংবা ঋত্বিক ঘটক বলি। দেখা গেছে যে, তারা নানাভাবে, তারা রাষ্ট্রের দমনপীড়নের শিকার হয়েছে। তো আপনাকে এ ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, আমি এমন একটা দেশে থাকি যে দেশে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় না। যতক্ষণ না তুমি এ দেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করছো, ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সে পর্যায়ে পৌঁছায় না। কিন্তু আমি যে কথা বলতে চাই, তা নিশ্চয়ই মুক্তির কথা, ভালোবাসার কথা, বেঁচে থাকার কথা। এর বিরোধিতা করার কারণ তারা নিজেরাও খুঁজে পান না। আর অন্যভাবে যে প্রতিবন্ধকতা সেটা, ভাগ্যিস বিদেশে আমার একটা বাজার আছে। আমার ছবিগুলো বিদেশে বিক্রি হয়। অর্থ রোজগার করে। তা নাহলে কিন্তু আমার পক্ষে টিকে থাকাই মুশকিল হতো। খুব মুশকিল হতো। কেননা পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে যে অসম্ভব অপসংস্কৃতির চর্চা চলছে, বিশেষ করে শিল্প সংস্কৃতির জগতে।
প্রশ্ন : এখন ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেই যৌথ প্রযোজনার সিনেমা হচ্ছে। এই বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খুবই ভালো। কিন্তু বিষয় নির্বাচন ঠিকঠাক হওয়া চাই। আমার মনে হয়, যে যৌথ প্রযোজনাগুলো হচ্ছে সেখানে বিষয় আরো গুরুত্বপূর্ণ হওয়া দরকার ছিল। আরো বেশি মানবিক হওয়া উচিত ছিল। আরো বেশি রাজনৈতিক-সামাজিক তাৎপর্যপূর্ণ হওয়া উচিত ছিল।
প্রশ্ন : আমাদের দেশে চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকদের মধ্যে কিছু তাত্ত্বিক মনে করছেন, যৌথ প্রযোজনার নামে আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের যে চলচ্চিত্র-বাজার আছে সেই বাজারটা ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আপনি কী মনে করেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটা ঠিক কথা নয়। কারণ এই দেশের ছবির বাজার এখনো এই দেশেই তৈরি হয় নাই। আমি যতবারই আসি প্রত্যেকবারই আমার প্রিয় ফিল্মমেকার বন্ধুরা এখানকার, তারা বলেন, যেমন ধরুন কালকে সকালেই আমাকে বিপ্লব বলছিল, এই দেশে ছবি করে রিলিজ করার জায়গা নাই তো। হল পাওয়া যায় না। তাঁরা ভাবছেন, ছোটখাটো কোনো জায়গায়, টাউন হল জাতীয় যেসব সাংস্কৃতিক মঞ্চ আছে সেখানে দেখানো যায় কি না। প্রজেক্টর ভাড়া করে। এমনকি আমি এটাও শুনলাম যে, যারা যৌথ প্রযোজনা করছেন এই মুহূর্তে, সেসব প্রযোজকরাও ভাবছেন। ফলে এখানকার বাজার নিয়ে নেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না এ কারণে, বাজারই তো নাই। যদি বাজার থাকত, হলিউড আসত। হলিউডের একদম ইন্টারেস্ট নাই এ কারণে যে, বাজারই নাই। বাজারটা যদি থাকত তাহলে কিন্তু খুব ভালো হতো। যদি এখানকার ছবির জন্যও বাজারটা থাকত। এখানে অনেক ভালো ছবি তৈরি হয়, প্রচেষ্টাটা তো আছে।
সারা পশ্চিমবঙ্গে বিশাল বড় বাজার সিনেমার। কলকাতায় ছবি চলা না চলা নির্ভর করছে ছবির গুণগতমানের মানের ওপর। কিন্তু ছবি রিলিজ তুমি করতে পারবে। সেটা এক সপ্তাহ চলবে না একশ সপ্তাহ চলবে সেটা নির্ভর করে ছবির গুণগতমানের ওপর। দর্শকের গ্রহণের ওপর। এখানে মুশকিল হচ্ছে, রিলিজ করাই মুশকিল। যদি রিলিজ না করা হয়, দর্শক ছবি যদি না দেখে টাকাটা আসবে কোথা থেকে। আমি যা শুনলাম, ৭০-৮০ লাখ বা এক কোটি টাকা দিয়ে ছবি তৈরি করেও মেক্সিমাম ২০-২৫ লাখ টাকা জোগাড় করা যায় এখানে। তাহলে বাজারটাই যেখানে লোকসানের, সেই বাজারে কেন বিনিয়োগ হবে?
প্রশ্ন : এ রকম কথা শোনা যাচ্ছে, এখানে নাকি অনেক সিনেমা হল নির্মাণ করা হবে। যদি হয় সেক্ষেত্রে বাধাটা তৈরি হওয়ার একটা সম্ভাবনা তাহলে আছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : নিশ্চয়ই আছে। বাজার, সেটা হোক আগে। কলকাতা থেকে মাল্টিপ্লেক্সগুলো এখন ছড়িয়ে পড়েছে মফস্বল শহরে। আমি কিছুদিন আগে একটি মফস্বল শহরে ছিলাম। শুটিং করছিলাম ছবির। সেখানেও মালটিপ্লেক্স তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে তোমার ছবি তৈরি করে পশ্চিমবঙ্গে রিলিজ করতে পারছো। কেননা ওই মালটিপ্লেক্সগুলোর ছবি দরকার। দর্শক নেবে কি নেবে না সেটা পরের বিষয়। ঢাকা এত বড় একটা শহর, আমি জানি না মালটিপ্লেক্স কয়টা হয়েছে।
প্রশ্ন : এখানে হাতেগোনা কয়েকটা রয়েছে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সেটা আরো অনেক বাড়া দরকার। শুধু ঢাকায় হলেই হবে না। এই জেলা শহর, যেমন রাজশাহী। যেমন চট্টগ্রাম, নোয়াখালী। এখানে একটা বড় অভিযোগ শুনতে পাই পরিচালকদের মুখে- হলের পরিবেশ খুব খারাপ। হলের পরিবেশ এত খারাপ যে সেখানে অনেকেই যেতে চান না। ইচ্ছা থাকলেও যেতে চান না। এই পরিবেশটাকে ঠিকঠাক করতে হবে। যদি মালটিপ্লেক্স আসে, অনেক স্ক্রিন বাড়বে। ডিমান্ড থাকবে। তখন হয়তো অন্যরকম ভাবতে পারেন।
প্রশ্ন : আরেকটা জিনিস এখানে আলাপ করি, কিছুদিন আগেই আমাদের এখানে দুই বাংলার নাট্যোৎসব হয়েছে। আবার আপনি দুই বাংলার চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদান করবেন। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, ভারতীয় সংস্কৃতি বাংলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করছে কি না?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, রাজনীতি আধিপত্য বিস্তার করে, শক্তি আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। রাজনীতি, দুর্বল রাজনীতির ওপর আধিপত্য করে। শক্তি, দুর্বলের ওপর আধিপত্য করে। কিন্তু সংস্কৃতি কখনো আধিপত্য করে না। কোনো দিনই করে না। বরং সংস্কৃতি, আধিপত্য যারা করে তাদের বিরোধিতা করে। পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতিই কিন্তু এ কথা বলে এসেছে। গানে, কবিতায়, শিল্পকলার অন্যান্য দিকগুলোতে কিন্তু এটাই এসেছে। ফলে আরেকটা দিক হলো, সংস্কৃতির দিক থেকে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির মধ্যে অনেক মিল। বিশেষ করে দুই বাংলার সংস্কৃতির মধ্যে অসম্ভব মিল। সংস্কৃতি যদি খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে লেখালেখি বল, যেমন আজকেই আমি বলছিলাম হাসান আজিজুল হক, ওখানকার তরুণ ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো পড়ছে, শামসুর রাহমান ভীষণ পপুলার, আমি বলছি যে, এই কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা কিন্তু একটা অসুস্থ আবহাওয়া তৈরি করার চেষ্টা করছেন। কথাটা একদমই ঠিক নয়। কেননা সংস্কৃতি কখনো আধিপত্য বিস্তার করে না, এটা ওদের জানতে হবে।
প্রশ্ন : এ ক্ষেত্রে আরেকটা কথা। সংস্কৃতিকে যখন কেউ ব্যবহার করে সে ক্ষেত্রেও কি সেটা আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সংস্কৃতিকে ব্যবহার করা যায় না। সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে গেলে, যদি আধিপত্যের জন্য সংস্কৃতিকে ব্যবহার করতে হয়, তাহলে অন্য শক্তির দরকার হয়। তাহলে সৎ শক্তির সঙ্গে অস্ত্রের যোগাযোগ করতে হয়। তা না হলে হয় না। সংস্কৃতি একা কখনো আধিপত্য বিস্তার করতে পারে না।
প্রশ্ন : আপনি বললেন, সংস্কৃতির সঙ্গে যদি অন্য কিছু যুক্ত হয় তাহলে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে। তারা হয়তো ওই দিকটাকেই ইঙ্গিত করছেন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সংস্কৃতির সঙ্গে বন্দুকের নল যোগ হওয়া দরকার। তাহলে সেটা হতে পারে, তা না হলে সেটা হয় না। কিন্তু সেটা করতে গেলে বিপদ আছে। যারা সংস্কৃতি করেন, তারাই সবার আগে প্রতিবাদ করবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ড. জন ডাব্লিউ হুড, উনি বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। এই প্রথম একটি বই বেরুল, যেটা ইন্টারন্যাশনালি অ্যাক্লেইমড হওয়ার সুযোগ আছে। কীভাবে, যে লোকে জানতে পারবে। মুশকিল হচ্ছে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে আন্তর্জাতিক যে আগ্রহ সেটা তৈরি হয়নি এখনো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। এখানকার অনেক পরিচালকের ছবি আমি ইন্ট্রোডিউস করে দিয়েছি। দেখানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় সেটা আরো বেশি হওয়া দরকার।
আরেকটা জিনিস বুঝতে হবে, সিনেমার আন্তর্জাতিক মানটা কোথায়? কোথায় পৌঁছে গেছে? সেখানে দাঁড়িয়ে কিন্তু ভাবতে হবে যে আমি বাংলাদেশ বলি বা কলকাতা বলি যে, ছবিটি আমি কীভাবে তৈরি করব। আমি বারবার বলছি, মধ্যমানের যে ছবি, সেটা আর বেড়ে উঠে অন্য জায়গায় যেতে পারে না। তাই ভালো ছবি করার সুযোগ আছে। অনেকেই এখানে অন্যভাবে ভাবছেন। সৎ মানুষ তারা, ভালো ছবি করতে চাইছেন। কিন্তু আরো অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্র নিয়ে কি আপনার কোনো হতাশার জায়গা আছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, না, না। দেখ, যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ কখনো কখনো তাঁর নিজের কাজ নিয়ে হতাশায় ভোগেন। তাঁর বারবারই মনে হয়, যা তিনি করতে চেয়েছিলেন, যা তিনি করতে চান, তাঁর সবটা বোধহয় ঠিক মতন করতে পারছেন না। যাঁরা বোকা তাঁরা ভাবেন অনেকটা করে ফেলেছি। সবটাই করে ফেলেছি। যাঁরা বোক নন, যাঁরা সজাগ, তাঁরা হতাশায় ভুগবেনই। কেউ তাঁদের রক্ষা করতে পারবে না। হতাশায় ভুগী আমিও মাঝে মাঝে। কিন্তু এই হতাশা কাটিয়েও উঠি। আমি আবার নিজের কাজ করি।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : স্বপ্ন তো আমি এখন দেখছি না। স্বপ্ন দেখছি আমি বহুকাল ধরে। দুই ধরনের কাজ হয়। যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজের দুটো ধরন আছে। একটা ধরন হচ্ছে সে সময়ের জন্য বেঁচে থাকবে। তারপর যখন সে সময় এগিয়ে যায়, সেই সৃষ্টিকে ফেলে দিয়ে যায়। এমন সৃষ্টি হওয়া দরকার যেটা সেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাবে। এবং পঞ্চাশ বছর পর, একশ বছর পর, দুশ বছর পরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরবে।
তুমি ভাব, জীবনানন্দ দাশ মারা গেছেন কত বছর হয়ে গেলো। ঋত্বিক ঘটক কবে চলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো কত আগে উনি লিখেছিলেন। কিন্তু এখনো কিছু পুরনো হয়েছে? হয়নি। ভালো জিনিস, ভালো কাজ কখনো পুরনো হয় না। সমসাময়িক হয়। এইটাই হচ্ছে স্বপ্ন। যেন তোমার কাজ প্রতিটি সময়েই সমসাময়িক থাকে। তা যদি না হয়, তাহলে খুব মুশকিল।
প্রশ্ন : আপনি সিনেমার সর্বশেষ যে কাজটা করে এলেন সেটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ছবির নাম হচ্ছে ‘টোপ’। এই টোপ নিয়ে আমি ভেবেছি পুরো ১৬ বছর ধরে। কিন্তু করিনি। করিনি এ কারণে, মাথায় ঠিকমতো জমে বসেনি। সে জন্য এত বছর লেগে গেল। এখন এই টোপ ছবিটা করলাম। শুটিং শেষ করেছি। এখন পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ চলছে। খুবই আমি এক্সাইটেড এই ছবিটি নিয়ে। এত দিন পর করতে পারছি।
প্রশ্ন : কতদিন পর এলেন বাংলাদেশে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেড় বছর হবে।
প্রশ্ন : কেমন লাগছে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, বাংলাদেশে আসতে আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে এ কারণেও ছোটবেলায়, একদম ছোটবেলায় এখানে থেকেছি। আমাদের আদি বাড়ি বিক্রমপুর, বিদগাঁওয়ে। ফলে শিকড়ের কাছে ফিরে এলে তো ভালো লাগবেই। তবে এখন আমি বাংলাদেশে যাব বললেই আমার বন্ধু-বান্ধবরা বলে, কী দরকার! সাম্প্রতিক সময়, বাংলাদেশে যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে সেটা খুবই হতাশার। এটা যদি এভাবেই চলতে থাকে, যদি এর প্রতিরোধ না করা যায়, তাহলে আবার এ দেশটা টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে। সেটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার হবে।
এখানে এলে আমার তো ভালো লাগেই। ভালোবাসি এই দেশকে। এখানে আমার প্রচুর ভালো বন্ধুবান্ধব আছে। এঁদের জন্যও আমার চিন্তা হয়, ভয় হয়। যে বিরুদ্ধ শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, সে শক্তি ভয়ংকর। সে শক্তি যদি একবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে আমার প্রিয় এই দেশটার কী হবে আমি জানি না। হাসান আজিজুল হকের ঘটনাটা কলকাতাতেও বেরিয়েছে। আমাকে টেক্সট করেছেন আমার এক তরুণ বন্ধু। আমার বন্ধুরা সবাই খুব অল্প বয়সী। তোমার বয়সী। তাঁরাই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলছেন, আপনি রাজশাহীতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবেন। আপনি যদি রাস্তায় নামেন, দেখবেন সবাই রাস্তায় নেমে পড়েছে। আপনি এটুকু করুন।
প্রশ্ন : কাউকে না কাউকে তো এই দায়িত্বটা পালন করতেই হবে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : প্রতিবাদ তো আমি আমার মতো করে করছি। আজকেও আমি মঞ্চে বললাম ...। কলকাতায় সহজ ছিল এ কারণে, কলকাতায় দাঁড়িয়ে এটা সম্ভব। কলকাতায় দাঁড়িয়ে যেকোনো সময় তুমি প্রতিবাদ করতে পারো। শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে লোক প্রতিবাদ করে। একটাই আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, দুঃখ হয়, এখানের বুদ্ধিজীবী মানুষ কিন্তু বুঝতে পারে চূড়ান্ত অন্যায় হচ্ছে, মানুষের প্রতি মানুষের অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদ আমি সেভাবে দেখি না। কেননা প্রতিবাদ করতে তারা ভয় পান। বিরুদ্ধ শক্তি এতই ভয়ংকর, তার সামনে প্রতিবাদ করার ভরসাটা তারা ঠিক বোধহয় পান না। তাই আমার বন্ধুকে লিখে দিয়েছি, এটা রাজশাহী, এটা কলকাতা নয়।
প্রশ্ন : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তোমাকেও।