গল্প
সারথি

লোকটি দাঁত বের করে হাসছে। বাঁকা বেগুনের মতো কালো ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে নিখাঁদ স্বাভাবিক হাসি। তার হাসি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো ফুঁটে উঠছে। যেন মুক্তাকেও হারমানায় ঝকঝকে দুপাটি দাঁত। মনে হয় বিজলির স্ফুলিঙ্গ। পাঠের সার্থে লোকটির একটি নাম দেওয়া যেতে পারে। ধরে নিই তার নাম সিকদার নাড়ু। নাড়ু তার নাম। সিকদার নাড়ুর চোখের চাহনিও ধারালো। নক্ষত্রের মতো উজ্জ্বল। মার্বেলের মতো গোল চোখে যেন শিকারীর অপলক দৃষ্টি তার। মুঠিবদ্ধ হাত দুটো বুকের ওপর জংধরা যেন লোহার অলংকারে সাজানো। দ্রুত হাঁটছেন সিকদার নাড়ু। তার গলাজুড়েও অমসৃণ অলংকার শোভা পাচ্ছে! গলায় চার মিলি লোহার রডের গোলাকার রিং।
না! গলায় অলংকার না! এমন দ্বিমত প্রকাশ করে কেউ বলে; না, এটা কোনো অলংকার হতে পারে না। ধাতব পদার্থে তৈরি গলার বেড়ি। এটা তেমন শৈল্পিক বা শিল্পীত মনে হয় না। সৌন্দর্য বলতে যা বুঝায়, তা নয়। বরং নাড়ুর গলায় ফাঁস মনে হয়। দুই পায়ের পাতার ওপরেও ধাতব মল। যে মল বা পায়েল শুধু নারীদেরই মানায়। প্রশ্ন দেখা দিতে পারত, তাকে এতসব অলংকারে সাজানো হয়েছে কেন? কিন্তু কেন যেন তেমন প্রশ্ন কেউ করল না।
দুটি লোহার রড খাড়া করে গলার রিঙের সাথে টানা সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। হাঁটার সময় ঝনাৎ! ঝনাৎ! আওয়াজ। ওই ধ্বনিতে যেন মানুষের বুকে ধাক্কা লাগে।
তবে কি সিকদার নাড়ুকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে? কিন্তু কেন? এমন শাস্তির ভেতরও চাঁদ বাঁকা ঠোঁটে হাসি। অনেকেই তার অপ্রাসঙ্গিক হাসির রহস্য খোঁজার চেষ্টা করে।
হাস্যোজ্জ্বল সিকদার নাড়ুর চারপাশে পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকে পুলিশ। কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে তাকে প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে। সিকদার নাড়ুর মাথায় হেলমেট। বুকের ওপর বুলেট প্রুফ জ্যাকেট।
প্যান্টের পকেটগুলোও ভারি দেখা যাচ্ছে। পকেটে মনে হচ্ছে মোবাইল, সিগারেটের প্যাকট। পেছন থেকে দেখা গেল ব্যাক পকেটে মানিব্যাগ।
পুলিশের নিরাপত্তা ভেদ করে হঠাৎ এক সুন্দরী দৌড়ে গিয়ে সিকদার নাড়ুকে ঝাপটে ধরে। তাকে জড়িয়ে বুকে বুক চেপে চুমুতে থাকে। সুন্দরীর চোখ কালো সানগ্লাসে ঢাকা। সিকদার নাড়ুর দুই পাশের গাল থেকে হেলমেট সরিয়ে নিয়ে চুম্বন একে দিচ্ছে। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের ওপরও চুমুতে দেখা যায়। পাগলের মতো চুম্বনের পর চুম্বন দিতে থাকে। দেখে বিস্মিত হয় দর্শকরা। থমকে যায় রক্ত মাংসে গড়া পুলিশও। এগিয়ে আসে কয়েকজন নারী পুলিশ।
চুম্বনরত তরুণীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তারপর চেংদোলা করে সরিয়ে নেয় রোমান্টিক ওই অনিন্দ সুন্দরীকে।
কে এই সুন্দরী? কী তার পরিচয়?
লোকচক্ষুর সামনে উগ্ররোমান্টিকতা! এমন রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখাবার সাহস পেল কোথায়? শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করায় সবার চোখে-মুখে একই প্রশ্ন!
কে যেন একজন ফিসফিস করে; পরকীয়ার এত টান?
যিনি ফিসফাস করলেন তার কাছ থেকেই জানা যায়, সুন্দরীর নাম আয়াতুন। মিসেস আয়াতুন্নেছা। রাজনীতিঘেঁষা অনিন্দ সুন্দরী এই তরুণী নাড়ুর সাথে কয়েক বছর আগে থেকেই সম্পর্ক গড়ে তোলে। দুজনে দুজনার খুব আপন হয়ে যায়। সুখের বিছানা পাতে! সিকদার নাড়ুও তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকত। আয়াতুন্নেছাকে ব্যবহার করে বড় ছোট অনেক স্বার্থই হাসিল হয়েছে নাড়ুর। সেই সিঁড়ি টপকিয়ে সিকদার অনেক উপরে উঠেছে।
সিকদার নাড়ু সরকারের এক মুরব্বিকে ব্যবহারযোগ্য কিছু মূল্যবান সমগ্রী উপহার দিয়েছিলেন। সেই উপহারের একটি অংশ ছিল আয়াতুন্নেছা! অবশ্য দুদিন পর আয়াতুনকে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। তবে ওই মুরব্বীর সাথে আয়াতুনের একটা গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়। তার সাথে এখন সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
অনিন্দ সুন্দরী অয়াতুনকে নিয়ে এমন আরো কিছু গল্প আছে। হয়তো চমকপ্রদ হতে পারে সেসব কাহিনী। যে গল্পগুলোর প্রণেতা সিকদার নাড়ু নিজেই।
তাদের সমুদ্রসৈকতে রোমাঞ্চকর উঞ্চ আবেদনের ভিডিও-ছবি অনেকেই ইন্টারনেটে দেখেছে। তখন সমালোচনার ঝর উঠেছিল। সেটি ছিল টক অব দ্য টাউন।
সিকদার নাড়ুর সাথে বন্ধুত্ব পাকা-পোক্ত হওয়ার পর আয়াতুনের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হয়েছে। তিনি এখন কালো কাঁচের ফ্রেমবন্দি প্রাইভেটে চড়ে বেড়ান। আর রক্তচোখে রাখেন স্বামী বেচারাকে।
অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানা স্বামী গোবেচারা এখন সবসময়ই স্ত্রী আয়াতুনের পিছু হাঁটে। স্ত্রীর ইচ্ছের প্রতি সমর্থন না থাকলেও বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস তার নেই। তাই নীরব থাকে। নিজের সন্তানের মাকেও এখন বড়ই দূরের মানুষ মনে হয়।
আয়াতুন কিছু দিন আগেও হেজাব পরত ইদানীং সে সেই সাম্প্রদায়িক পোশাক ব্যবহার করে না। হেজাব পরা না পরা নিয়েও স্বামী বেচারার কোনো উচ্চারণ নেই। নাড়ুকে সম্মানের সাথে কঠোর নিরাপত্তার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পুলিশের এমন আয়োজনে কারো কারো মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তাদের কেউ কেউ খেদ প্রকাশ করে বলে; সারথিকে নিয়ে যাচ্ছে জামাই আদরে! নিজেদের কাছেই নিজেরা প্রশ্ন রাখে; ভিলেন না খলনায়ক?
সিকদার নাড়ুকে লক্ষ করে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের ক্যামেরার ফোকাস চলছে। এই খলনায়ককে মিস করতে চায় না তারা। ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমের অভিধানে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভেরি ইমপোর্টেন্ট পার্সন! কারণ, দুর্ধর্ষ হিসেবে তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ও বিদেশে। তাকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় শত শত মানুষ আজ ভিড় করছে। শুধু দেখার জন্য নয়। অনেকেই ভিড় করছে তাকে তিরস্কার করতে। অসংখ্য মানুষ সিকদার নাড়ুকে খুনি বলে ধিক্কার জানাচ্ছে। একাধিক হত্যার সারথি সে।
এমন তিরস্কার শুনেও সিকদার নাড়ু হাসছেন! কুণ্ঠাহীন। মনে হচ্ছে বোধহীন। মানসিক বিকারগ্রস্ত কি না কে জানে?
হাস্যোজ্জ্বল অবয়ব বেচারার। কি ভেবে সে হাসছে, কে জানে! হয়তো এমনও হতে পারে সিকদার নাড়ুর হাত ঝেড়ে-ঝুড়ে উচ্ছিষ্টটুকু যাদের পকেটে যেত, সেই উচ্ছিষ্টে যাদের দানা-পানির ব্যবস্থা হতো, হয়েছে গাড়ি-বাড়ি (সিকদার নাড়ু এমনটাই মনে করে)তারাই আজ নাড়ুর সামনে তীর-ধনুক নিয়ে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে! সৎ, নিষ্ঠাবান পেশাদারত্ব দেখাচ্ছে! বেগদারি ওই পেশাদারদের চেহারা মোবারক দেখে নাড়ু বিস্মিত না হয়ে পারছে না। তাই মনে হয় হাসির ফোয়ারা ফুটিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে!
তীর-ধনুক তাক করা একটি দৈনিকের সম্পাদকের চোখে দৃষ্টি রেখে সিকদার নাড়ু চোখ মটকাল! কী যেন বলতে চাইল। বিষয়টি আর কেউ না বুঝলেও সম্পাদক ঠিকই বুঝে ফেলল। কপালে ঘাম জমে। সম্পাদকের মেঘবর্ণ মুখ অন্তত তেমনই আবাস দেয়।
মেঘবর্ণ মুখোশের এই লোক খ্যাতিমান সাংবাদিক না হলেও দুই-তিনটি জেলায় তার যৎ সামান্য পরিচিতি আছে। এই সাংবাদিক সাহেব সিকদার নাড়ুর গুণ-গানে মত্ত ছিল। নানা রকম গাল-গল্প সাজিয়ে সিকদার নাড়ুর গুণ-গান গেয়ে নিজের কাগজে লিখে এলেও এখন সেটা চলছে বিপরীত স্রোতে। তার এমন মহৎ কর্মকাণ্ড কারাবন্দি থেকেও সিকদার নাড়ু জেনে গেছে। সে শব্দহীন হাসির ভেতর সেটাই প্রকাশ করতে চাইল। দাঁতে দাঁত চেপে ভেতরের স্ফুলিঙ্গ প্রকাশ করে; শালা! পাঁচ শ কেজির প্রাইভেটটি হজম শেষ!
হয়তো শক্ত হয়ে সামনে দাঁড়ানো অখ্যাত সম্পাদকও বুঝে ফেলল সিকদার নাড়ুর খেদোক্তি! তার মুখাবয়ব আড়ষ্ট হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবার সামলে নেয় সাংবাদিক সাহেব। সহজ হয়ে দাঁড়ায় সে।
সিকদার নাড়ুর দৈহিক ভাষা দেখে কেউ কেউ বলছে; ওর প্রাণে একটুও ভয় নেই। যেন পাথর আত্মা! লোকটি ইয়াজিদের বংশধর। সীমার! একসঙ্গে এতগুলো মার্ডারের মূল নায়ক! ফাঁসি হবে নিশ্চত জেনেও দাঁত বের করে হাসছে। লজ্জা-শরমও নাই!
সেভ না হওয়া কদম ফুলের মতো সাদা-কালো দাড়িওয়ালা মধ্যবয়সী একজন বলল; ও তো মানুষ না! মানবাত্মা নেই ওর ভেতর। মানুষ হলে চোখে লজ্জা-শরম দেখা যেত।
সবাই যে তার মতো ভাবছে তা নয়। আবার দ্বিমতও আছে কারো কারো মধ্যে। পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় মানুষ। দু-চারজন খানিক দূরে জটলা পাকিয়ে বলাবলি করছে; না, নাড়ুটার ফাঁসি হবে না। অর্থের জোর বলে কথা! কোমরে অর্থের শক্তি টাইট করে বাঁধা আছে।
সিকদার নাড়ুর মেধা আছে বলতে হবে।
এরশাদ সিকদারের নাম অনেকেই শুনেছে। খুলনার কুখ্যাত এরশাদ সিকদার। মানুষ হত্যা করে টুকরো টুকরো করে মাছের খাবার দিত নদীতে। দুর্ধর্ষ সেই এরশাদ সিকদারের ফাঁসি হয়েছিল! সিকদার নাড়ুকে দেখে অনেকের মনে এরশাদ সিকদারের ছবি ভেসে উঠে।
তবে মনে হচ্ছে সব রাস্তা-ঘাট ঠিক করেই সিকদার নাড়ু ধরা দিয়েছে। তার পরিণতি এরশাদ সিকদারের মতো হবে কি না তা বলা বাহুল্য।
কপাল কুঁচকে কালো কোট পরা এক যুবক বলল; হ্যায় কি ইচ্ছা কইরা ধরা দিছে? পলাইয়্যা গেছিল। ইন্ডিয়া গিয়া পুলিশের আতে ধরা পড়ে। হেই দেশের জেলে আছিল এক বছর। অহন সরকারঅই তারে আনছে।
সিকদার নাড়ু একজন জনপ্রতিনিধি। নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়(?)তা তার নিজ এলাকার মানুষই ভালো জানে। তবে তার বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ নগরবাসীর মুখে মুখে।
তাকে প্রিজন ভ্যান থেকে নামানোর পর পরই হৈ হুল্লোড় রব উঠে। ক্ষিপ্ত লোকেরা চেঁচামেচি করতে থাকে। ক্ষেপাটেদের কেউ কেউ তার দিকে জুতা উঁচিয়ে ধরে। সমস্বরে আওয়াজ তোলে ওই খুনির ফাঁশি চাই! ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই!
তবে কি তারা নিশ্চিত হয়েছে লোকটি খুনি?
মানুষ হত্যা করে সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল?
ক্ষেপা লোকদের উচ্চারণে এমন প্রশ্ন দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক।
পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বারণ করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় না। শুরু হয় জুতাবৃষ্টি। কয়েকটি জুতা উড়ে গিয়ে লোকটির হেলমেটে আঘাতের ধ্বনি তোলে। এমন সময় কারো কারো মন খারাপ হয় বৈকি!
লোকটিকে ভালোবাসুক বা না বাসুক! তার তো কিছু অনুগত মানুষ আছে। তাদের মুখ ম্লান হয়ে যায়!