ভাষার জন্য কারাভোগ করেছিলেন প্রফেসর লায়লা নূর

‘আন্দোলন করে জেল খেটে বাংলা ভাষার দাবি আদায় করেছি। আমার ছাত্র রফিকের হাত ধরে এসেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। ভাবতে ভালো লাগে। চাই না কিছুই; আদালতসহ সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হোক, তরুণ প্রজন্ম বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার না করুক-এটাই প্রত্যাশা’, কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক লায়লা নূর।
অধ্যাপক নূর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী অধ্যাপক। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বর্তমান তিতাসের গাজীপুরে। ১৯৪৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়তেন। ছাত্রীকালীন কিশোরী লায়লা নূর জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই কুমিল্লা শহর সক্রিয় ছিল। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দু গৃহীত হলে, কুমিল্লার কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) গণপরিষদের ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সমান মর্যাদা দেওয়ার প্রথম প্রস্তাব পেশ করেন। ধীরেন্দ্রনাথ ভূমিকা কুমিল্লার ভাষা আন্দোলনকর্মীদের অনুপ্রাণিত করেন। ধীরেন্দ্রনাথ নিজেও কুমিল্লায় ভাষার দাবির কর্মীদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার ঘোষণা দেন, এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের ছাত্রসমাজ। কুমিল্লার ছাত্র-শিক্ষকরাও আন্দোলন শুরু করে। তখন মুসলিম লীগ প্রভাবাধীন স্থানীয় গণ্যমান্য কিছু নারীর উদ্যোগে কুমিল্লায় টাউন হল ময়দানে একটি সভা হয়। সেখানে বক্তৃতায় তাঁরা বলেন, ‘বাংলা তো আমাদের ভাষা নয়। এটা হিন্দুদের ভাষা। আমরা কেন হিন্দুদের ভাষাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বানাব। আরবি ও উর্দুই হলো মুসলমানদের ভাষা। তাই বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে এত হৈ চৈ করার কিছু নেই।’
সভায় বেশির ভাগ মেয়েরাই বক্তা ও শ্রোতা ছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিশোরী লায়লা নূর। বক্তাদের অযৌক্তিক কথা শুনে তীব্র ক্ষোভ জমে তাঁর। কারণ লায়লা নূরের বাবার চাকরি সূত্রে তাঁদের বাসায় প্রচুর বই ছিল। সেখান থেকে সে জেনেছে যে, পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীর অবস্থান সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে লায়লা নূর বলেন, ‘তাদের এই মূর্খের মতো কথাকে ভুল প্রমাণিত করতে আমি কিছু বলতে চাই- বলে তাদের একজনের কাছে অনুরোধ করলাম। আমি তাদের পক্ষে কথা বলব ভেবে তারা আমাকে কথা বলার সুযোগ দেয়। বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলা যে অমূলক ও ধর্মীয় গোঁড়ামি সে কথা যুক্তিপ্রমাণসহ সবার সামনে তুলে ধরি। পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষাভাষীর অবস্থানও তুলে ধরি। বাবার চাকরি সূত্রে আমার শৈশব কেটেছে ভারতের বিহারে। এ জন্য ভাষার পরিসংখ্যান সম্পর্কে আমার ভালোই ধারণা ছিল। আমার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই অবাক হয়। বাংলা ভাষার দাবি যে যৌক্তিক, সেটা কিছুটা বুঝতে পারে। সভায় কিছুটা কানাঘুষা শুরু হয়। এক মহিলা উঠে গিয়ে আমাকে বলেন, তুমি এতক্ষণ যা বলেছ তা তো বলেছই। তুমি সবাইকে বলো যে, আমি এত কথা এমনিতেই বললাম। তবে আমি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকেই পছন্দ করি।
আমি ওই মহিলার ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হলাম। তারা আমার কথা বলা বন্ধ করে দিল। একজন এসে আমাকে বলল, এতক্ষণ তুমি যা বলেছ, এতে তোমার কপালে খারাপি আছে। দুটি ছেলে এসে আমাকে বলল, দেখ তুমি এখান থেকে দ্রুত চলে যাও। চারদিকে পুলিশের তৎপরতা। তোমাকে গ্রেপ্তারও করতে পারে।
আমি তখন কিছুটা নিরাপত্তাহীনতা উপলব্ধি করলাম। ছেলে দুটির সহয়োগিতায় সেখান থেকে নিরাপদেই বাসায় আসতে পেরেছিলাম সেদিন।’
মেট্রিকের পর লায়লা নূর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বাংলা ভাষার দাবিতে সরব থাকেন তিনি।
ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৫৫ সালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি পালনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল। পঞ্চান্নর ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান সরকারের ৯২ (ক) ধারা শাসনের চূড়ান্ত ফাটল ধরায়। সরকার বুঝতে পারে যে, ভাষার দাবির আন্দোলন আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। পঞ্চান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির আগের রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রীনিবাসগুলোর ছাদে কালো পতাকা উড়িয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। বেআইনিভাবে আর্মিরা ছাত্রাবাসে ঢুকে জোরপূর্বক পতাকাগুলো নামিয়ে ফেলে। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে অন্য ছাত্রীদের সঙ্গে শাড়ি পরে খালি পায়ে এসে আমতলায় হাজির হন লায়লা নূর। ভাষার দাবির স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে সভা পরবর্তী মিছিল বের হয়। তখন এক ট্রাক আর্মি দ্রুত এসে পড়ে। ছাত্রদের ওপর বেধড়ক লাঠিপেটা করে। প্রচণ্ড লাঠিপেটার মধ্যে সেখানে মেয়েদের অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হুসনে আরা, লায়লা নূরসহ ছাত্রীরা লাইব্রেরির বারান্দায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আর্মিরা লাইব্রেরির বারান্দায় এসে ২১ জন ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে। লায়লা নূর বলেন, ‘আর্মি আমার হাতে যখন হ্যান্ডকাপ লাগাতে আসে, আমি ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ধমক দিয়ে বলি- আমাকে ছোঁবে না বলছি। কোথায় যেতে হবে বলো। আর্মি ছেলেগুলো ধমক খেয়ে কিছুটা সময় নেয়। তারপর আমাদের ট্রাকে উঠতে বলে। বেলা ১১টা বা ১২টায় আমাদের বারান্দা থেকেই গ্রেপ্তার করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। জেলখানায় রাতে আমাদের একটা ফ্লোরে শুতে দেয়। ছাত্রীদের যারা গ্রেপ্তার থেকে বেঁচে যায়, তারা রাতে হোস্টেল থেকে আমাদের জন্য বিছানা পাঠিয়ে দেয়।’
সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রীদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার কোনো চেষ্টা করেনি। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. জেন কিন্স। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। এ প্রসঙ্গে লায়লা নূর বলেন, ‘ড. জেন কিন্স ছিলেন কড়া লোক। দেখতে খুব ফর্সা ও লম্বা। ব্রিটিশরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাই তিনি ছাত্রীদের দ্বারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা পছন্দ করেননি। এ কারণে তিনি ছাত্রীদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেননি। আমার বড় বোন উম্মে কুলসুম গুল নাহার নূর ওই সময় ফরিদপুর থাকত। সে ফরিদপুর স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে সেই ছিল আমার অভিভাবক। আমি ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে জেলে আছি- এই খবর জানিয়ে ভিসি আমার বোনকে চিঠি দেয়। ২১ দিন পর মার্চের ১২ বা ১৩ তারিখে আমাদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দেয়। জেল থেকে বেরিয়ে আমি চামেলী হাউসেই (বর্তমান সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) উঠি।’
লায়লা ১৯৫৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করে পরের বছর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগে। অবসরে যান ১৯৯২ সালে। লেখালেখি করেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন বিখ্যাত কবিদের লেখা কবিতা। আন্দোলন-সংগ্রাম, শিক্ষকতা আর লেখালেখিতে কেটে গেছে লায়লা নূরের জীবন। বিয়ে করা আর হয়ে ওঠেনি।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের জীবন্ত ইতিহাস হয়ে বেঁচে আছেন চিরকুমারী এ মহীয়সী নারী। এক পা প্যারালাইজড। থাকেন কুমিল্লা শহরের অশোকতলার প্রফেসরপাড়ায়। খুব কষ্টে কিছুটা নড়াচড়া করেন হুইল চেয়ারের সাহায্যে। পত্রিকা ও বই পড়ে সময় কাটান। তাঁর অনেক ছাত্রই এখন সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, এমপি এবং এমনকি মন্ত্রীও। লায়লা নূরের সরাসরি ছাত্র কানাডাপ্রবাসী প্রয়াত রফিকুল ইসলামের হাত ধরেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এসেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে গর্ববোধ করেন তিনি।
বর্তমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ে ব্যক্ত করেন তাঁর হতাশার কথা, ‘বর্তমান ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আমার অনেক আক্ষেপ আর দুঃখ রয়েছে। আমাদের সময়ে ছাত্রদের সব সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করত সাধারণ জনগণ। সাধারণ জনগণ বলত, ছাত্ররা যেহেতু বলেছে, তাহলে সঠিক বলেছে, দেশের ভালোর জন্যই বলেছে- ছাত্রদের প্রতি এমন বিশ্বাসই ছিল তাদের। দুঃখের বিষয়, ছাত্র আন্দোলনের সেই সুনাম এখন আর নেই। এখন তারা আউট সাইড ক্রিমিনাল। এখন ছাত্রদের কথা শুনলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়।’