আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
চিলেকোঠার সেপাইয়ের সেনাপতি

সাহিত্যকে এমন আত্মস্থ করে জীবনযাপন করতে আমি খুব কম মানুষকেই দেখেছি। তাঁর চোখের দিকে তাকালে যে স্বপ্ন ভাসতে দেখেছি অথবা যে রঙের খেলা তাঁর পুরোটাই সাহিত্যকে নিয়ে। এভাবে ভাবার বা বলার কারণ, তাঁর সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা এবং তাঁর নিজের রচনা। আমি তাঁকে চিনি যখন তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি আজকের মতো ছড়িয়ে পড়েনি, তখন থেকে। একটা সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক হিসেবেই আমাদের কাছে তাঁর পরিচয়। সে কলেজ তখন আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়নি। আমি সেই জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। আর তিনি আমার শিক্ষক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার শিক্ষক—এ কথা খুব জাঁক করে বলার মতো নয়। কারণ, খুবই ক্ষুদ্র একটা সময় তাঁর কাছে পড়েছি।
আমার জীবনে তিনি কতখানি প্রভাব ফেলেছেন, তা মেপে দেখিনি। পরিচয়ই বা কত দিনের! আমি তখন এইচএসসির ছাত্র। বিজ্ঞান বিভাগ হলেও দুই পেপার বাংলা সাহিত্য এবং দুই পেপার ইংরেজি সাহিত্য আমাদের পাঠ্য ছিল। তবে সরকারি বড় কলেজের নিয়মকানুন ছিল আলাদা। এক বাংলাই পড়াতেন পাঁচজন শিক্ষক। প্রথম পত্রে ছিল গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ আর উপন্যাস। সবগুলোরই একটা করে ক্লাস, কোনো দুটো বিষয়ে ছিল হয়তো দুটো করে ক্লাস। কিন্তু সেটা কোনটা মনে নেই। এটুকু মনে আছে কবিতার ক্লাস ছিল সপ্তাহে একটা। প্রথম যে কবিতাটা পড়ানো হয়েছিল, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোদ্দশ সাল। আমাদের কবিতা পড়াতেন যিনি, তাঁকে তখনও স্বনামে চিনি না। মানে ক্লাসের শিক্ষক হিসেবে তাঁর নামটা শুনেছি, কিন্তু মনে রাখিনি। কারণ তিনি যে অত বড় সাহিত্যিক, আমাদের জানা ছিল না।
আমরা তাঁকে চোদ্দশ সাল বলেই ডাকতাম, অবশ্য আড়ালে। সপ্তাহে একটা ক্লাস এবং অনেক সপ্তাহে কোনো না কোনো কারণে ক্লাস হতো না। সে জন্য একটা কবিতা শেষ করতে লেগে গেল প্রায় দুই মাস। এত লম্বা সময় ধরে একটা কবিতা পড়ানো হলো; কিন্তু কেউ কোনোদিন টুঁ শব্দ না করে ক্লাস করে গেল। কবিতাটার লাইন লাইন ধরে এমন ব্যাখ্যা তিনি করেছেন যে, কারো কোনোদিন বিরক্ত লাগেনি। এর পরের কবিতাগুলো অন্য শিক্ষকরা নিয়েছেন। সেগুলো সাধারণ মানের ক্লাস হয়েছে বলেই তাঁর কথা মনে করতে পারি না। আমার সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ওখানেই শেষ। তার পর আমি পাস করে বের হয়ে গেছি। ভর্তি হয়েছি পদার্থবিজ্ঞানে।
সাহিত্যের সঙ্গে একরকম আড়িই বলা যায়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় সাহিত্য। আমি সব সময়ই বই পড়েছি বা পরে কিছু লেখারও চেষ্টা করেছি। আর তারই সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে আবার পরিচয়। বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদ বলে একটা সংগঠন তখন সাহিত্য নিয়ে বেশ কাজ করছে। ১৯৮৭ সালের দিকের ঘটনা। অনেক কাজের মধ্যে তারা একটা করে গল্প পাঠের আসর করত। এক মাস বা দুই মাস পর পর সেটা অনুষ্ঠিত হতো। বেশির ভাগ অনুষ্ঠানই হতো জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অডিটরিয়ামে। কিছু কিছু অনুষ্ঠান হতো অন্য জায়গায়। উদ্যোক্তারা নামকরা লেখক। আমরা যাঁরা নবীন, তাঁদের জন্যই এই প্রতিযোগিতা। এখনকার অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক তখন সেখানে গল্প পড়েছেন। আমারও হাতেখড়ি ওখানে।
গল্প পড়া ছাড়া উপরি পাওনা ছিল পুরস্কার। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার দেওয়া হতো গল্পকারদের, নগদ টাকা। সেই কারণে বিচারক থাকার নিয়ম। বড় বড় লেখক সেখানে বিচারক হিসেবে আসতেন। আমি বেশ কিছুদিন কথাশিল্পী সংসদের সঙ্গে থাকার ফলে পরিচিত হয়ে গেছি। নগদ প্রাপ্তিটা তো আছেই, তা ছাড়া আছে ভালো লাগার একটা বিষয় নিয়ে কাজ করা। তাই সংগঠনের হয়ে কিছু কাজও করি। নিয়মিত লেখা পাঠ করত যারা, তারা সবাই কিছু না কিছু করত সংগঠনের জন্য। তবে সংগঠনের কাজ আমাদের স্বেচ্ছাশ্রমেই করতে হতো। একবার আমাকে পাঠানো হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাসায়। গল্প পাঠের অনুষ্ঠানে বিচারক হতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়ে। তিনি তখন থাকেন ইত্তেফাক পত্রিকা পার হয়ে কেএম দাস লেনে। আমি ততদিনে তাঁর লেখক খ্যাতি জেনে গেছি। শুধু তাই নয়, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বের হয়েছে। অসাধারণ সেই উপন্যাস পড়ে একেবারে যাকে বলে আবেগে আপ্লুত। তাঁর তৈরি চরিত্র ‘হাড্ডি খিজির’কে কল্পনায় যেন দেখতে পেতাম। বিশেষ করে যখন পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের দিকে যাওয়া পড়ত, তখন। তাঁর খিস্তি ওড়ানো মুখের একটা কল্পিত অবয়ব ভেসে উঠত।
মনে হতো এসব অলিগলি ধরে হাড্ডি খিজির হেঁটেছে মুক্তির মিছিলে, জীবনের মিছিলে। হাঁটতে হাঁটতে মনে হতো আমিও চলেছি খিজিরের সঙ্গে কোনো মিছিলে। ঝুরঝুরে চুন-সুড়কি গায়ে মেখে পুরান ঢাকার নোংরা নর্দমার পাশ দিয়ে অন্ধকার গলি পার হয়ে আলোর দিকে। মনে হতো হাড্ডি খিজির আমাকে বলছে, ‘আহো মিয়া, আহো, খাড়ায়া থাকলে কাম অইবো!’
উপন্যাসের একটা চরিত্রকে এমন বাস্তবের আলোকচিত্র করে তোলা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পক্ষেই সম্ভব। আজ যখন তাঁর বাসায় যাওয়ার কথা উঠল, আমি তো রীতিমতো উত্তেজিত। বাস থেকে নেমে কেএম দাস লেন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। উনি থাকেন একেবারে শেষ মাথায়। বিকেলের তেরচা রোদ আমার বাঁদিকে পড়ে তাতিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি তখন এতই উত্তেজিত যে গরমটা টেরই পাচ্ছি না। দরজার কড়া নাড়তেই কে যেন দরজা খুলে দিল। বসার ঘরে উনি বসেছিলেন। আমি তো আগেই চিনি। তাঁর সঙ্গে আরো দু-তিনজন, সম্ভবত অন্য কোনো তরুণ লেখকই হবেন। সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকি। মুখে কিছু না বলে চিঠিটা ওনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। তিনি খুলে পড়লেন। তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তো এসব অনুষ্ঠানে যাই না, জাফর তো জানে।’
জাফর মানে জাফর তালুকদার, তখন তিনি গল্পকার হিসেবে নাম করাই। জাফর ভাই বাংলাদেশ কথাশিল্পী সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনিই চিঠিটা পাঠিয়েছেন। আমি কোনো কথা খুঁজে পাই না। ইলিয়াস স্যারই আবার বললেন, ‘জাফরকে বলবে আমাকে যেন এসব অনুষ্ঠানে না ডাকে।’ কথাগুলো জাফর ভাইকে বলা হলেও আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। কারো সঙ্গে আর তেমন কোনো কথা হলো না। আসলে সংকোচে আর কারো দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। তখন মনে হচ্ছিল, সেখান থেকে পালাতে পারলেই বেঁচে যাই। আমি তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। মনের ভেতর একটা কথা খচখচ করে বিঁধতে লাগে। অনেকেই বলেছেন উনি একটু অন্য রকম।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখাতেই জানা যায় ওনার দাদার অহং বোধ বেশ টনটনে। তিনি দাদার কথা লিখেছেন এভাবে, ‘...হিউমার খুব একটা করতেন না, তবে হিউমার এপ্রিশিয়েট করতে পারতেন চমৎকার। এমন তরল-আবেগ-বর্জিত ঋজু স্বভাবের মানুষ আমি আর দেখিনি বললে চলে।’ অনেকেই বলেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজেও একই ধরনের মানুষ। তবে কখনো কখনো তিনি যে এর থেকে একটু আলাদা, সেটা বুঝতে হলে নিশ্চয়ই বিশেষ সময়ের প্রয়োজনা হয়। আমার সৌভাগ্য সে রকম একটা সময়ে আমি তাঁকে পেয়েছিলাম। এর পর আরেকবার ওনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেবারও সেই কথাশিল্পী সংসদের কাজ নিয়ে।
কথাশিল্পী সংসদ বছরে একটা গল্প সংকলন বের করত। তাতে বড় লেখকদের সঙ্গে নতুনদেরও ঠাঁই হতো। তবে নতুনদের বেলায় শর্ত ছিল, যাঁদের লেখা সারা বছরের গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম হবে, তাঁদেরটাই যাবে। সেই সংকলন নিয়ে গেলাম ওনার বাসায় সন্ধ্যার দিকে। সেদিনও তিনি কয়েকজনকে নিয়ে বসে গল্প করছিলেন। আমি বইটা হাতে দিতে তিনি উল্টেপাল্টে দেখলেন। আমি সাহস করে বোধ হয় বলেছিলাম, আমার একটা লেখা আছে এতে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যেহেতু লেখালিখি করো তখন এখানে চলে আসবে মাঝে মাঝে।’ সামনের তরুণদের দেখিয়ে বললেন, ‘এদের চেন, এরা তরুণ হলেও ভালো লেখে।’ এরপর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সবার সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার যে আর কোনোদিন সেখানে যাওয়া হয়নি।
এরপর দীর্ঘদিন স্যারকে দেখিনি। হঠাৎ করে বেড়াতে গেছি বগুড়ায় একটা বিয়ের দাওয়াত পেয়ে। আমার সঙ্গে কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, ওনার স্ত্রী রিতা ভাবি এবং আরো কয়েকজন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আমরা দু-একদিন বগুড়ায় থেকে গেছি। উদ্দেশ্য, আশপাশে দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যাওয়া। সেই অনুযায়ী গেছি বগুড়ার মহাস্থানগড়ে।
সালটা হবে বোধ হয় ১৯৮৯। গড়ের খনন করে তোলা নানা পুরাকীর্তি দেখছি ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ করেই দেখি একটা উঁচু স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। বাতাসে পতপত করে উড়ছে তাঁর পাঞ্জাবি। তিনি মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন দূরে কোথাও। উনি বগুড়ার মানুষ। আর সময় পেলেই চলে যেতেন সেখানে। ওনার এই অভ্যাস অনেক দিনের। শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া, বাস্তবের অনুসন্ধান করা, সত্যকে নিজে অনুধাবন করা। আর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তা সবাইকে জানানো। যারা ভান করে, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। একবার ভেবেছিলাম সামনে যাই, দেখা করি। কিন্তু আমার আজীবনের অর্ন্তমুখী স্বভাব তা আর হতে দিল না।
অজানা সংকোচের কারণে আর দেখা করা হলো না তাঁর সঙ্গে। এর পর কেটে গেছে আরো কয়েকটা বছর। আমি তখন একটা স্যাটায়ার পত্রিকায় কাজ করি। হঠাৎ করেই দেখা স্যারের সঙ্গে। তখন হাসান আজিজুল হক রাজশাহী থেকে ঢাকায় এলেই উঠতেন ওনার বোনের বাসায়, আজিমপুর সরকারি কলোনিতে। তিনি এলে সেখানে প্রতিদিনই জমে উঠত আড্ডার আসর। এসে হাজির হতেন হায়াৎ মামুদ, আবু বকর সিদ্দিকী এ রকম আরো অনেকে। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আসতেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও। জমজমাট আড্ডা হতো সেখানে।
আমার সৌভাগ্য, আমি সেখানে মাঝেমধ্যেই জায়গা পেতাম। তবে কেবলই শ্রোতা হিসেবে। বলতে নিশ্চয়ই বাধা ছিল না, কিন্তু আমিই সাহস করে তেমন কিছু বলে উঠতে পারতাম না। সেখানে স্যারের সঙ্গে আমার আবার পরিচয় হলো। এবারে বেশ অন্তরঙ্গ পরিবেশ। আমি বলেই ফেলি, স্যার আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। তিনি জানতে চান কোন সময়। আমি তাঁর চোদ্দশ সাল পড়ানোর ঘটনা বললে তাঁর মনে পড়ে সেই সব দিনের কথা। তবে অবশ্যই আমাকে মনে পড়ার কোনো কারণ নেই। আড্ডা মাঝেমধ্যেই শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যেত। আমার অবশ্য বাসায় আড্ডাবাজ হিসেবে সব সময়ই বদনাম আছে। রাত করে বাসায় ফেরা আমার পুরোনো অভ্যাস। তাই সেটা নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা ছিল না। আর থাকলেও আমি তা মানতাম না। কারণ এমন সমৃদ্ধ আড্ডা ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কেবল একটা কথা মনে করে আফসোস হয়, কেন তখন সেগুলোর কোনো নোট রাখিনি। রাখলে অনেকগুলো লেখার উপাদান পেয়ে যেতাম।
এ রকম একদিন আড্ডায় আড্ডায় রাত ১২টা বেজে গেছে। সবাই নিচে নেমে যে যার গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টায়। আমি থাকি তখন মতিঝিলের কাছে আরামবাগে। আর আখতারুজ্জামান স্যার থাকেন মতিঝিল ছাড়িয়ে টিকাটুলীর মোড় পার হয়ে কেএম দাস লেনে। সবারই যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়, কিন্তু ইলিয়াস স্যারের ওদিকে যাওয়ার একটু সমস্যা। এখন বাস বন্ধ হয়ে গেছে। এত রাতে এত দূর কোনো রিকশাও যেতে চাইবে না। আমি সাহস করে বলে ফেলি, ‘স্যার আমার সঙ্গে মোটরসাইকেল আছে।’ ‘তাই নাকি?’ অন্যরা এক সাথে বলে উঠলেন, ‘ইলিয়াস উঠে পড়ুন, কোনো সমস্যা হবে না।’ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হে পারবে তো?’ আমি কিছু না বলে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিই। তারপর স্যারের সামনে নিয়ে গিয়ে বলি ওঠেন স্যার। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। তবে যখনই সিগন্যালে পড়ছিলাম তখন স্যার কিছু না কিছু জিজ্ঞেস করছিলেন। সবই ছিল লেখালিখির বিষয়ে। একসময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে তুমি কি কিছু শুনেছ?’ আমি বুঝতে পারলাম কেন বিষয়টা তিনি তুললেন। আমার স্যাটায়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক কার্টুনিস্ট আহ্সান হাবীব হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই।
আমি বললাম, ‘কোন বিষয়ে বলছেন স্যার?’ ‘এই যে অনেকে বলে আমরা হুমায়ূনের নামে বদনাম করি।’ বিষয়টা আমি এড়াতে চাই, কারণ আমার জন্য এটা উভয় সংকটের। তিনিই আবার বলেন, ‘হুমায়ূন কিন্তু আমাদের খুব ভালো বন্ধু। একসময় আমরা একসঙ্গে অনেক আড্ডা মেরেছি। লেখা নিয়ে আমাদের পথটা দুদিকে চলে গেছে। আমরা যেভাবে সাহিত্যকে নিয়েছি, তিনি নিয়েছেন অন্যভাবে। বিরোধ শুধু এইটুকুই। মানুষ শুধু এগুলোকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে আমাদের সম্পর্কটা আরও জটিল করার চেষ্টায় থাকে।’ বিরোধটা বোঝা গেলেও মানুষের কথা বাড়ানোর প্রসঙ্গটা কী। একবার মনে হয় জিজ্ঞেস করি। কিন্তু সেটা আমার জানা। যে মানুষ সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে সমাজের, মানুষের জীবনের ভেতরের অন্তর্লীন সত্যকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন, তিনি সাহিত্যের অন্য কোনো ফর্ম ভালো চোখে দেখবেন না। আর এই কথা কোথাও বলতেও দ্বিধা করবেন না।
সিগন্যাল ছেড়ে দিল, আমিও মোটরসাইকেল চালু করলাম। আমার মাথা থেকে অনেক দিনের একটা দ্বিধা চলে গেল। লেখক হিসেবে একেকজন একেক রকমের হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা নিয়ে সুষ্ঠু মন্তব্য করা ছাড়া একজন ভালো লেখক বা মানুষের অন্য কিছুই করা শোভা পায় না। যারা অকারণ এসব নিয়ে কেচ্ছা বানায়, তাদের প্রতি মনটা বিষিয়ে গেল। আরো একটা পুরোনো বিষয় মাথায় খেলে যায়। কে বলে তিনি আবেগে তরল হন না!
আজ কোন স্মৃতি তাকে এমন নস্টালজিক করে তুলেছে, আমি তা বলতে পারব না। এর পর আমার সঙ্গে ওনার দেখা হয়েছে আর দুই-একবার। তার পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া পর্যন্ত জানতাম না কোন ঘাতক ব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত। এরপর তিনি ফিরে এসেছেন। আজ যাই, কাল যাই করে ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হয়নি আর। তিনিও বেশি দিন আমাকে সে সুযোগ দিলেন না। তাঁর সকল কৃতী আমাদের পাথেয় হিসেবে দিয়ে চলে গেলেন বহুদূর। সরাসরি সেভাবে তাঁর কাছ থেকে আমার হয়তো শেখা হয়েছে খুব কম। কিন্তু তাঁর লেখা, তাঁর নিষ্ঠা আর তাঁর সত্যান্বেষী স্বভাব আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে, শুধু তাই নয়, বন্ধুর পথ অতিক্রমের সাহস জুগিয়ে চলেছে আজও। আজও আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই মহাস্থানগড়ের সেই দৃশ্য। বাতাসে পতপত করে তাঁর পাঞ্জাবী উড়ছে, যেন বিজয় নিশান।