নতুন বই
অতীত একটা ভিনদেশ : ঘোর লাগা গল্প সংকলন

এই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে মোজাফ্ফর হোসেনের গল্পগ্রন্থ ‘অতীত একটা ভিনদেশ’। প্রকাশ করেছে বেহুলা বাংলা প্রকাশনী। বইটি মূলত একটি অতীত ভ্রমণের বই। প্রচ্ছদ, নামকরণ এবং বইয়ের উৎসর্গপত্রেই তার প্রমাণ মেলে। বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর পিতা, পিতামহ ও প্রপিতাকে।
মোজাফ্ফর বইয়ের ভূমিকা হিসেবে লিখিত ‘আমার গল্পভাবনা’অংশে পরিষ্কার করে বলেছেন গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি দুটো বিষয় মাথায় রাখি। এক. আমার বর্তমানের কাছে দায়বদ্ধতা। যে কারণে আমার গল্পে বর্তমান সময়ের ত্রিমুখী শক্তিÑ করপোরেট শক্তি, আমলাতান্ত্রিক শক্তি ও মিডিয়াশক্তিÑ এই তিন শক্তির কাছে একজন ব্যক্তির যে অবস্থান, সেটি নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দুই. আমার ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধতা। যে কারণে আমার গল্পের অনেক চরিত্র ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের জন্য হাহাকার করে। নগরজীবনের বিস্তার এবং প্রযুক্তিবিপ্লবের কারণে আমাদের গ্রামীণজীবন বদলে গেছে। অর্থাৎ আমরা যে আদর্শ গ্রাম দেখে এসেছি সেটি এখন একমাত্র আমাদের স্মৃতিতে আছে। অন্য কোথাও নেই। আমি বাবাকে দেখেছি, গ্রামে দাদার তৈরি পুরোনো বাড়িটা গুঁড়িয়ে নিজের হাতে গড়া পাকা বাড়িতে থাকতেন। স্থানচ্যূত তিনি হননি। তারপরও হোমসিকনেসে ভুগেছেন।’ পড়তে পড়তে আমরা সবাই হোমসিকনেস হয়ে পড়ি। নস্টালজিয়া আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে।
এভাবে গল্পকার একটা আবহ তৈরি করে আমাদের তার ঘোরলাগা গল্পের ভেতর নিক্ষেপ করেন। ‘বাঁশিওয়ালা মজ্জেল’ গল্পে দুজন মানুষ কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে আলাপ করছেন তাদের অতীত জীবন নিয়ে। দুজনই মৃত। তাদের কথার ভেতর দিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের চিত্র ফুটে ওঠে। ‘ঘুমপাড়ানো জল’ গল্পে দেশভাগের সময় ভারতে চলে যাওয়া এক ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে, ফেলে যাওয়া ভিটেমাটি দেখতে, রেখেও যাওয়া মানুষগুলোকেও। গিয়েছিল যখন তখন সে কিশোর ছিল, আর ফিরে এসেছে মৃত্যুর দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে। মাঝের এতটা কালে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। সে আর কিছুতেই তাঁর স্মৃতির অতীতের সঙ্গে বাস্তবতার মিল করাতে পারছে না। দেশভাগের আরেকটি গল্প ‘একটি নদীর গল্প’। এই গল্পে এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল মাস্টার নদী নদী করে পাগল হয়ে গেল। তার নিজের হাতে গড়া বাড়িকে সে অস্বীকার করে তার শৈশোবের নদীগ্রামকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, যেটি সে ফেলে এসেছে পশ্চিমবাংলায়। একসময় বাড়ির পিছনে নর্দমায় কোদাল দিয়ে খুঁড়তে খুঁড়তে মারা গেল। অতীত খনন করতে করতে অতীতেই ফিরে গেল হয়তো।
‘একবার যদি কথা হতো’ গল্পটি লেখকের বাল্যপ্রেমের। বাল্যপ্রেম ছাপিয়ে শেষপর্যন্ত লেখকের ক্ষয়ে যাওয়া অতীতটা মুখ্য হয়ে উঠেছে। ‘সুখ অসুখ’ গল্পে গল্পকথক স্মৃতিচারণার ভেতর দিয়ে একটি দীর্ঘ সময়কে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। বড় ক্যানভাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে এই গল্পে।
‘ছুঁয়ে দেখা জীবন’ গল্পটি এই গ্রন্থের সবচেয়ে ঘোরলাগা গল্প। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে রহমান। সে অতীত বর্তমান গুলিয়ে ফেলছে। ফলে এই গল্পে টাইম অ্যান্ড সেটিং ভেঙে গেছে। রহমান একবার ফিরে যাচ্ছে অতীতে, তার কিশোর বয়সে, আরেকবার ফিরে আসছে বর্তমানে। রহমান মায়ের হাত ধরে কিশোর বয়সে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কছেদের কারণে সে আর গ্রামে ফিরে যায়নি। শেষ বয়সে এসে তার মনে হচ্ছে, সেদিন সে মায়ের সঙ্গে না এলে অন্য একটা জীবন যাপনের সম্ভাবনা তার ছিল। সে কৌশলে তার কল্পজগতে তার মায়ের সঙ্গে আসার ঘটনাকে বদলে দিচ্ছে। সে আসল না। অর্থাৎ একটা রহমান গ্রামে থেকে গেল। মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করল রহমান।
এভাবেই এই গল্পগ্রন্থে মোজাফ্ফর আমাদের অতীত ভ্রমণে নিয়ে গেছেন। অতীতে একটি মুখ্য চরিত্র হয়ে দেখা দিয়েছে গাছপালা। তাই গল্পগুলোকে পরিবেশবাদ সমালোচনার ছাঁচে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। গল্পগ্রন্থ : অতীত একটা ভিনদেশ,
প্রচ্ছদ : আনিস মামুন।
প্রকাশক : বেহুলা বাংলা। মুল্য : ২২০টাকা।