আমার জীবনানন্দ

রবীন্দ্রনাথের কাছে সে চিত্ররূপময়। বুদ্ধদেব বসুর কাছে নির্জনতম কবি। আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছে শুদ্ধতম কবি। অম্বুজ বসুর কাছে নক্ষত্রপ্রতিম। আমার জীবনানন্দ সকল সংজ্ঞাতিক্রমি।
চিত্র নির্মাণ করে পরক্ষণেই চিত্রের ঘেরাটোপ ভেঙে এক সারিতে দাঁড় করায় যে রূপসনাতন আর অরূপরতনকে, তাকে কি কেবল ‘চিত্ররূপময়’ অভিধাভুক্ত করে রাখা যায়? আমি তো তাঁর কবিতায় শুনি ইতিহাস-ভূগোলের আবহমান কাকলি। তবে তাঁকে ‘নির্জনতম’ বলি কেমনে? আমি তো তাঁর কবিতায় শুদ্ধ কল্পনা আর চূড়ান্ত বাস্তবের ভেদ লুপ্ত হতে দেখি। তাই তাঁকে ‘শুদ্ধতম’ সম্বোধনে খণ্ডিত মনে হয়। আমি তো তাঁর কবিতায় জ্যোতির পাশাপাশি দেখি তমসের দীপ্তি। তাই তাঁকে নক্ষত্রের সীমানায় বাঁধতে পারি না।
এমনই আমার জীবনানন্দ। কলকাতায় বা বরিশালে বসে চৈতন্যে ধারণক্ষম ব্যাবিলন, লিবিয়া কিংবা সিংহল। মাটিতে বসে অনুভব করে যে নক্ষত্রের আয়ুক্ষয়। যাঁর কবিতায় তারার পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকে তিমির। বেলার পিছে দাঁড়িয়ে থাকে কালবেলা।
জ্যোৎস্নার ভেতর সবাই ভূত দেখে না। যে দেখে সে-ই জীবনানন্দ। পৃথিবীতে যার কোনো বিশুদ্ধ চাকরি নেই সে-ই জীবনানন্দ। যখন সবাই স্বর্গের স্বপ্নে বিভোর, তখন নরকের নবজাতে মেঘের দিকে প্রব্রজ্যা যার সে-ই জীবনানন্দ। জীবনের রাত্রিভোর কারুবাসনা যার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দেয় সে-ই জীবনানন্দ। ট্রামনিয়তি গ্রহণ করে যে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মরে যায়, সে-ই জীবনানন্দ। পৃথিবীতে ঢের শালিকের ভিড়ে যে জনমভর অজ্ঞাত তিনটি শালিক খুঁজে ফেরে, সে-ই জীবনানন্দ।
চারদিকে কত মাছের কাঁটার সফলতা, কত সোনাদানা! এর কোথাও আমার জীবনানন্দকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ নিদ্রার ভেতর সংঘারাম জেগে থাকলে যে যুগপৎ বর্তমান ও আট বছর আগের কোনো একদিনে বিচরণ করে একমাত্র সে-ই জীবনানন্দ। অর্থ, কীর্তি কিংবা সচ্ছলতা নয়; বিপন্ন বিস্ময়ের সূত্র জানা যার সে-ই জীবনানন্দ।
আমার জীবনানন্দ জগতের যাবতীয় সুতীর্থে খাপ না খাওয়া এক করুণ মাল্যবান মাত্র।