হারপার লী
একটি পাখি ও নিজের গল্প

৮৯ বছর বয়সে চলে গেলেন (১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) মার্কিন কথাসাহিত্যিক হারপার লী। তিনি ১৯২৬ সালের ২৮ এপ্রিল আমেরিকার আলাবামার মফস্বল শহর মনরোভিলেতে জন্মেছিলেন। বাবা ফ্রান্সেস কানিংহাম ছিলেন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও আইনজীবী; মা আমাসা কোলম্যান ছিলেন গৃহিণী। চার ভাইবোনের মধ্যে লী ছিলেন সবার ছোট।
হারপার লীর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলে একটি বই নিয়েই আমাদের কথা বলতে হবে, সেটি হলো ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’ (১৯৬০)। আর ২০১৫ সালে বেরিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ উপন্যাস ‘গো সেট আ ওয়াচম্যান’। এ ছাড়া টুকটাক কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন আর একটি বইয়ে সহলেখকের ভূমিকা পালন করেছেন।
‘টু কিল এ মকিং বার্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে, ঠিক এর পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৬১ সালে পেয়ে গেলেন পুলিৎজার পুরস্কার। মাঝে আরো বেশ কিছু পুরস্কার ও সম্মাননা ডিগ্রি পেয়ে ২০০৭ সালে আমেরিকার সামগ্রিক সাহিত্যে অবদানের জন্য পেলেন the Presidential Medal of Freedom । এ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে বইটি বিক্রি হয়েছে চার কোটির বেশি কপি। অনূদিত হয়েছে ৪০টির বেশি ভাষায়। এর কাহিনী নিয়ে বানানো চলচ্চিত্র (টু কিল এ মকিং বার্ড, ১৯৬২) তিনটি অস্কার পুরস্কার জিতেছে, মনোনীত হয়েছিল আটটি পুরস্কারের জন্য। একটি উপন্যাস নিয়েই এত কাণ্ড! আর এই উপন্যাসের লেখক কি এক অজানা কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে সরে গেলেন। সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি আর বলার মতো কিছু লিখলেনও না, যেন এই একটিমাত্র উপন্যাস লেখার জন্য অক্সফোর্ড থেকে বড় মাপের আইনজীবী হওয়ার সম্ভাবনাকে মাটিচাপা দিয়ে নিউইয়র্ক চলে এসেছিলেন লেখক হবেন বলে। এই উপন্যাস লেখার জন্যে তাঁর জন্ম এবং বাকিটা জীবন কেবলই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে যাওয়া।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কী লিখলেন তার এই একমাত্র বইটিতে যে এরপরে আর তাঁর লেখার প্রয়োজন হলো না? প্রথম বইটিকেই আধুনিক সাহিত্যের ক্লাসিক বলে একবাক্যে মেনে নিলেন সাহিত্যবোদ্ধারা- শুনতেই কেমন অদ্ভুত লাগে! উপন্যাসটি নিয়ে কথা বলার আগে লীর আরো কয়েকটি প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা দরকার। চল্লিশের দশকে লী আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে এক বছরের জন্য বদলি ছাত্র হিসেবে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করার ছয় মাস আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিউইয়র্ক যাবেন; কারণ তিনি আইনজীবী নন, লেখক হতে চান। লী সেখানে জীবিকার জন্য এক ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে রিজারভেশনস ক্লার্কের কাজ করার পাশাপাশি লিখতে থাকলেন। ১৯৫৭ সালে একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে একটা প্রকাশনা সংস্থাকে দিলেন। পাণ্ডুলিপিতে উপন্যাস বলে উল্লেখ থাকলেও সেটি ছিল আসলে অনেকগুলো গল্পের সমন্বয়। প্রকাশক পুনর্লেখনের জন্য অনুরোধ করলেন। লী বসে গেলেন, আরো আড়াই বছর ধরে সেটি সম্পাদনা ও পুনর্লেখনের কাজটি করলেন। পরিশ্রম কাজে দিল, প্রকাশিত হলো তাঁর সেই বিখ্যাত এবং একমাত্র উপন্যাস ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’।
উপন্যাসটির সঙ্গে লেখকের আত্মযৈবনিক অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। হারপার লীর জন্মশহর মনরোভিলের সঙ্গে উপন্যাসের কল্পিত শহর মেকমের সঙ্গে মিলে যায়। লীর বাবার মতো উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের বাবাও আইনজীবী। উপন্যাসের ডিল চরিত্রটি লেখকের শৈশবকালের লেখক বন্ধু ট্রুম্যান কাপোটের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত। লীর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাঁর নিকটতম শহরে একটি ঘটনা ঘটে- নয়জন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ দুজন শেতাঙ্গ নারীকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনা হৈচৈ ফেলে দেয়, নয়জনের ভেতর পাঁচজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হলে দেশটির অনেক বিখ্যাত আইনজীবী ও তৎকালীন সুধীসমাজের একটা অংশ এই রায়কে জাতিগত বিদ্বেষপূর্ণ বলে মনে করেন। এমনকি সন্দেহ করা হয়, যে দুই নারী এই ধর্ষণের অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরা আসলে মিথ্যে বলছেন। লী উপন্যাসটি প্রকাশ করেন ১৯৬০ সালে, আমেরিকান সিভিল রাইটস মুভমেন্ট যখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে ঠিক তার প্রাক্কালে। ধারণা করা হয়, লীর উপন্যাসের মূল গল্প সেই ঘটনা দ্বারা উৎসারিত। তবে লী শক্তভাবে বলেছেন, তাঁর উদ্দেশ্য নিজের অতীত জীবন তুলে ধরা নয়, তিনি আসলে অনির্দিষ্ট করে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর সৃষ্টি করেছেন। ‘আপনি চাইলে চরিত্রগুলোতে দক্ষিণের যে কোনো স্থানে বসিয়ে কল্পনা করতে পারেন’-১৯৬১ সালে এক সাক্ষাৎকারে লী বলেছিলেন।
উপন্যাসটির পরিপ্রেক্ষিত ১৯৩০-এর দশকের নিথর আলাবামা শহর। গল্পের ন্যারেটর স্কট ফিঞ্চ নামের এক মেয়েশিশু। তার বাবা আইনজীবী অ্যাটিকাস ফিঞ্চ নৈতিকভাবে খাঁটি ও সত্যনিষ্ঠ ভদ্রজন। স্কট ভাই জেমের সঙ্গে থাকে। পরে প্রতিবেশী হিসেবে যুক্ত হয় প্রায় সমবয়সী ডিল নামের এক বালক। স্থানীয়ভাবে গুজব ছিল- তাদের নিকটতম প্রতিবেশী বু রেডলি কখনোই তার ঘরের ভেতর থেকে বের হয় না। তাকে নিশাচর দৈত্য বলে ভাবা হয়। শিশুরা তাকে নিয়ে নানা রকম ভীতিকর গল্প তৈরি করে; নিজেদের তৈরি গল্পে নিজেরাই ভয়ে শিউরে ওঠে! অতি উৎসাহ বশত একদিন সন্ধ্যা রাতে স্কট, জেম ও ডিল বু-কে দেখার জন্য তারকাটার ছিদ্র দিয়ে ওদের বাড়িতে যায়। বু-এর ভাই শব্দ শুনে ফাঁকা গুলি ছোড়ে, ওরা পালিয়ে আসে। আসার সময় তারে আটকে যাওয়ায় জেম তার প্যান্ট খুলে রেখে আসে। খানিক পরে সে প্যান্টটি আনতে গেলে দেখে সেটি সুন্দর করে ভাজ করা ও ছেঁড়াটা যত্রতত্র সেলাই দেওয়া। আরো একটি রহস্যজনক ঘটনা ওদের জীবনে ঘটে। ওদের বাড়ির পাশেই একটি গাছের গর্তে প্রায়ই ওদের জন্য কে যেন এটা সেটা উপহার রেখে যায়। একদিন তারা দেখে যে, বু-এর ভাই সেই গর্তটি সিমেন্ট দিয়ে আটকে দিচ্ছে।
এরই মধ্যে বাবা অ্যাটিকাস ফিঞ্চ টম রবিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গের পক্ষ হয়ে কেস লড়াইয়ের জন্য রাজি হয়ে যান। টমের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও শারীরিক নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন শ্বেতাঙ্গ নারী ইউয়েল। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের হয়ে কেস লড়ার জন্য পথেঘাটে ফিঞ্চ পরিবারকে স্থানীয় লোকজন অপমান করে। কথিত ভুক্তভোগী ইউয়েলের বাবা তো সরাসরি হুমকি দেয়। তবুও নিজের অবস্থান থেকে একপাও নড়েন না অ্যাটিকাট। তিনি জানেন টম নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। তিনি এও জানেন, যত নির্দোষই হোক না কেন, টম এ কেসে পরাজিত হবে; কেন না অভিযোগ উঠেছে শ্বেতাঙ্গদের পক্ষ থেকে, ফয়সালা করবে শ্বেতাঙ্গরাই। তবু তিনি শেষ চেষ্টা করে দেখেন। কোর্টে সাক্ষী ও বাদীর উল্টোপাল্টা বয়ানেই পরিষ্কার হয়ে যায় তারা মিথ্যে বলছে। টমের কথায় জানা যায়, অপরাধটা আসলে ইউয়েলের। সেই তাকে বাড়িতে ‘একটু উপকার করবেন’ বলে ডেকে ‘সেক্সুয়ালি মোটিভেটেড’ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে টম পালাতে চাইলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইউয়েল। এমন সময় ইউয়েলের বাবা বব ইউয়েল চলে আসেন। তিনি মেয়েকে যাচ্ছেতাইভাবে মারধর করেন, যেটি পরে অভিযুক্ত টম করেছে বলে চালানো হয়। অ্যাটিকাট কোর্টে সবার উদ্দেশে বলেন, অপরাধী টম নয়। দোষ যদি কারো হয়ে থাকে সে হলো ইউয়েলের। তবে সেও ওই ঘটনার জন্য অপরাধী না। সে একজন নিঃসঙ্গ নারী হিসেবে পুরুষসঙ্গ চেয়েছিল। এই চাওয়া তার অপরাধ না। তার বাবা বিষয়টি ধরে ফেলায় সে বিব্রত হয়েছে। তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, এটি আমাদের সমাজের চোখে গর্হিত কাজ। ফলে নিজেকে এই ঘটনা থেকে বাঁচাতে তাকে ধর্ষণের নাটক সাজাতে হয়েছে। এটা সে করেছে বাবার প্ররোচনায়। তবে এখন মিথ্যে মামলায় একজন নিরপরাধীর জীবন ও পরিবার নষ্ট করে দিলে নিশ্চয় অপরাধী হবে সে। আমরা সবাই ঈশ্বরের কাছে অপরাধী বলে গণ্য হব। একথা বলার পরও টমের শেষরক্ষা হয় না। তার বিরুদ্ধে রায় দেন আদালত। অ্যাটিকেট আপিলের কথা ভাবছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত টম জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় পালাতে চাইলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বব ইউয়েল তার মানহানির জন্য অ্যাটিকেট পরিবারকে প্রতিশোধের হুমকি দেয়। সত্যি সত্যি সে একদিন চাকু হাতে জেম ও স্কটের ওপর হামলা করে বসে। এক অজ্ঞাত ব্যক্তি তাদের বাঁচায়। ঘটনাস্থলে মারা পড়ে বব। এই অজ্ঞাত ব্যক্তি শিশুদের কল্পচরিত্র হয়ে ওঠা সেই বু রাডলি। ইউয়েলকে খুনের ঘটনায় বু-কে অভিযুক্ত করেন না শেরিফ। তিনি ঘোষণা করেন, ইউয়েল রাতের অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে নিজের চাকুতে আহত হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছে। সৎ মানুষ হিসেবে অ্যাটিকাট চেয়েছিলেন, লোকে সত্যটা জানুক, কিংবা ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে ছেলে জেমের হাতে নিহত হয়েছে- এমনটি বলা হোক। কিন্তু শেরিফ তাতে রাজি হননি। বলেন, মন্দ লোকের শাস্তি প্রকৃতি দিয়েছে। এর জন্য কেউ দায়ী না। ন্যারেটর স্কট বু-কে মকিং বার্ডের সঙ্গে তুলনা করে- যে কেবল গান গায়, কারো ক্ষতি করে না কখনো। মকিং বার্ডকে শিকার করা ক্ষমার অযোগ্য পাপ- একদিন বাবাই বলেছিল তাকে। এখানে বলা প্রয়োজন, নির্দোষ টমকে আমরা যদি মকিংবার্ডের সঙ্গে তুলনা করি তবে তার মৃত্যুর পেছনে যারা দায়ী, তারা মকিংবার্ড হত্যার দায়ে দুষ্ট। উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে আমাদের ভাবনাটা এখানেই এসে উত্তর খুঁজে পাই।
স্কট বু-কে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায়। ভাবতে থাকে এই বাড়ির ভেতর থেকে এতদিন বু তাদের দেখে আসছে, উপহার দিয়ে আসছে। বু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে দেয়। তাকে আর কখনোই দেখেনি গল্পকথক স্কট।
উপন্যাসটির অবশ্যই প্রধানতম বিষয় হলো বর্ণবৈষম্য; যেটি লেখক শিশুকাল থেকেই তাঁর চারপাশে দেখেছেন এবং তা কখনই মানতে পারেননি। পাশাপাশি একটা শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার বিষয়টিও এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। অন্ধবিশ্বাস, জাতিগত বিদ্বেষ, সাহসিকতা ও সততার প্রকৃত স্বরূপ, নারীসুলভ বনাম পুরুষসুলভ বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ, বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক- এসবও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে।