নতুন বই
অস্ট্রিয়ার কবি গেওরগ ট্রাকলের কবিতার বই

গেওরগ ট্রাক্লের কবিতার শরীরজুড়ে চমৎকার এক নীরবতার বসবাস। ট্রাক্লের কবিতাগুলো ইমেজসমৃদ্ধ। ছদ্মবেশে হাজির হওয়া অসংখ্য রূপক সমৃদ্ধ শব্দরা একের পর এক ছবি এঁকে যায় পাঠকের মনে। এটা খুব বিরল যে কবি নিজে কিছু ব্যক্ত করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবি পটভূমিকে বৃহৎ কিছু প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অধিকাংশ পটভূমিই আসলে নীরবতার সাক্ষী।
ট্রাক্লের কবিতায় রয়েছে শীত, গ্রীষ্ম ও শরৎকালীন আবহ। গভীর রাত আর সন্ধ্যার শৈশব স্মৃতি। কবি বলেছেন, ‘যাকে ভোলা যায় না’। এসব কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শযোগ্য স্বাদ। লিখেছেন, ‘আজ রাতে নিঃস্ব হয়েছে আমার চোখের নীলাভতা,/ আমার হৃদয়ের লাল রক্ত/ওহ্! কীভাবে তোমার স্মৃতি এখনো পোড়ায়!... তোমার লালরঙা ঠোঁট আমাকে হতাশ করে!’ আমরা দেখতে পাই, গেওরগ ট্রাক্লের কবিতায় একটি মৃত্যুমুখী বাদামগাছ পরিত্যাজ্য কিছু নয়। কবির চেতনায় ধরা পড়ে, ইন্দ্রিয়ের স্পর্শে আসে, তার অস্তিত্বের রহস্য ও চিরকালীন বিস্ময়। লিখেছেন, ‘মৃত্যুমুখী বাদামগাছ/ আর কখনোই বাতাসে দুলবে না/ কিন্তু বাতাসের সিঁড়িতে/ তোমার ওড়না উড়বে কাঁপা পাতার মতো।’
এভাবেই ট্রাক্লের কবিতার পটভূমিগুলো দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো রয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে আন্তরিক-রহস্যময় একটি যোগাযোগ। কবিতার ছন্দগুলো স্বপ্নাতুর ব্যক্তির মেজাজের মতো ধীর ও গম্ভীর। সেখানে রয়েছে গয়াল পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, ব্যাঙের ঘ্যাঙ-ঘ্যাঙ, পাতার সড়সড়, হেলমেট, যুদ্ধ-রক্ত, সর্বশেষ কবরস্থানের সমাধিফলক। কবিতায় এসব উপকরণ ভাব প্রকাশে আশ্চর্যজনকভাবে দীপ্তিময় হয়ে নানান রঙের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে তার কবিতার পটভূমিতে। আর অর্থ প্রকাশের আনন্দে ও তার গভীরতায় উচ্ছল হয়ে উঠেছে কবিতার সারা শরীর। কোনো কোনো সময় কবিতার এই পটভূমিগুলোই আবার পথহীন অন্ধকারে ডুবে থাকে। আর সেই অন্ধকার পথের সর্বত্র থেকে যায় নীরবতার সব মন্ত্রণা। এই নীরবতা হচ্ছে সেসব বস্তুর প্রকৃতপক্ষে যাদের অনেক কিছু বলার ভাষা আছে, তারা বলতে পারে কিন্তু কিছুই বলতে চায় না। এভাবে ইচ্ছেপূর্বক নীরবতা বজায় রাখার জন্য জার্মান ভাষায় একটি শব্দ আছে যা ইংরেজিতে নেই। ‘শোভিগেইন’ নামক শব্দটি ট্রাক্ল প্রায়ই তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। কবি যখন বলেন ‘হলুদ ফুলগুলো/শব্দ ছড়ায়/নীল পুকুরে নুয়ে পড়ে’ তখন আমরা বুঝতে পারি যে ফুলেরও একটি ভাষা আছে এবং ট্রাক্ল সেটা শুনতে পান কিন্তু কবিতায় তারা ঠিকই নীরবতা বজায় রাখে।
জেনেশুনে কবি মিথ্যে বুলি এঁকে দেননি বৃক্ষরাজির ভাষ্যে। তাই তো প্রকৃতি নিঃসংকোচে ধরা দিয়েছে তার কবিতার মধ্যে। কবিতার কলেবর বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমশ সেখানে সন্নিবেশ ঘটেছে আরো বেশি প্রাণের। প্রথমে ছিল কেবল কিছু বুনোহাঁস আর ইঁদুর। তারপর একে একে সেখানে জড়ো হলো ওক গাছ, হরিণ, মেষপালকের গান, পুরুষ হরিণের হেঁটে যাওয়া, ছিঁড়ে যাওয়া দেয়াল পত্রিকা, জলদস্যুর জাহাজ, পরিত্যক্ত ছায়া, কালো ঈগল, পুকুর, ভেড়ার পাল, শরতের মেঘ, তারাশোভিত আকাশ, রুপালি মুখোশ, সন্ধ্যার নীল ঘুঘু, ভেঁপু এবং সব শেষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিরুদ্ধে গান, স্টিল হেলমেট, সেনাদল, যুদ্ধাহত ব্যক্তি, রণাঙ্গনের সেবিকা এবং ক্ষতস্থান থেকে সদ্য ছিটকে পড়া রক্ত। এত কিছুর মধ্যেও কবি অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করেন, ঝরেপড়া রক্তের একটি নিজস্ব ঠিকানা আছে। সেখানে আঁধার-ঘেঁষা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে আছে চির-চেনা মানবিক সম্পর্ক।
১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন হু হু করে বেড়েই চলছিল, তখন গেওরগ ট্রাক্ল বাধ্য হয়েছিলেন রিজার্ভ সৈন্য হিসেবে গ্রোডেক যুদ্ধে অংশ নিতে। গ্রোডেকের যুদ্ধ ছিল বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যাওয়া তরুণ এই সৈন্যদলের কাছে সম্পূর্ণ নতুন, অচেনা অভিজ্ঞতা। কবি যথাযোগ্য যুক্তিতে, আবেগ-অনুভবে, অভিমানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত ও সংকটকালে রচনা করেন ‘গ্রোডেক’ কবিতাটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হতভম্ব, বিস্মিত কবি লিখেছেন, ‘তবু একটা লাল মেঘ, যার মধ্যে বিকারগ্রস্ত ঈশ্বর,/ ছলকে ওঠা রক্ত/ নিজেই নিজের শরীরে নীরবে সমবেত হয়েছে,/ চাঁদের আলোর মতো শীতলতা উইলো গাছের নিচে;/ সমস্ত পথ ছড়িয়ে গেছে অন্ধকারে।
কবিতার প্রতিচ্ছবিতে ট্রাক্ল নিয়ে এসেছেন উষ্ণ আর শীতল এক হৃদয়। যাকে মনে হয় জনশূন্য স্থানে একজন ধর্মযাজক। যেন সে সাদা আর নীলের সমন্বয়ে মিলেছে পলায়নপর রহস্যের আলোছায়ায়। মৃত্যুর পথ ধ্যানমগ্ন সাধুর মতো ধূসর মনে করে মৃত্যুর আগেই ঘনিয়ে আসা মৃত্যুকে কবি স্থান করে দিয়েছিলেন তার ‘শোক’ নামক কবিতায়। অন্তর্দৃষ্টির ভেতর দ্বিধা এবং সন্দেহকে যুক্তির যাতাকলে পিষ্ট করে কবি লিখেছেন মৃত্যুর বোধগম্য মর্মানুবাদ। কিছু উদ্ধৃতি :
বইটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন : কবি অনন্ত উজ্জ্বল । প্রকাশক : গুডলাইফ পাবলিকেশন ।পরিবেশক : বাতিঘর, চট্টগ্রাম [বইটি পা্ওয়া যাচ্ছে বইমেলায় বাতিঘর প্রকাশনীর স্টল নম্বর ১৬৯-এ (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে)। প্রচ্ছদ : আবিদ এ আজাদ । মূল্য : ১৩০ টাকা।