গোগলের জীবন ও গল্পের গল্প

নিকোলাই গোগল। পুরো নাম নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগল। জন্ম ১৮০৯ সালের ৩১ মার্চ, রুশ সাম্রাজ্যের পোলতাভা গভর্নরেটের সরোচিনৎসিতে (বর্তমানে ইউক্রেন)। ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত এই রুশ লেখকের অনেক লেখাতেই প্রভাব পড়েছে তাঁর ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির।
তবে রুশ ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। গোগলের সবচেয়ে খ্যাত রচনা হলো ‘মৃত আত্মা’ (ডেড সোলস), যাকে গণ্য করা হয় আধুনিক রুশ উপন্যাসের পথিকৃৎ হিসেবে। এই উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডটিও লেখা হয়েছিল, যা নিজ হাতে পুড়িয়ে ফেলেন গোগল।
লেখালেখিই ছিল তাঁর একমাত্র জীবিকা। মাত্র ৪৩ বছরের জীবনকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনেক সাহিত্যকর্ম। নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছেন বিশ্বমানের। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে : ইভেনিংস অন এ ফার্ম নিয়ার ডিকাঙ্কা (১৮৩১-১৮৩২), মিরগোরোদ (১৮৩৫), দি ওভারকোট (১৮৪২), দি ইন্সপেক্টর জেনারেল (১৮৩৬), ডেড সোলস (১৮৪২)।
অকালপ্রয়াত এই লেখকের মৃত্যু হয় ১৮৫২ সালের ৪ মার্চ রাশিয়ার মস্কোতে। দেশটির নভোদেভিচি সেমেট্রিতে আছে তাঁর সমাধিস্থল, যা দেখার জন্য এখনো প্রতিনিয়ত ভিড় জমায় অগণিত পাঠক-ভক্ত।
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার জাতীয় সাহিত্যের উৎপত্তিতে গোগলের নাম আসে বরাবরই। গোগল ছিলেন বিষণ্ণ প্রকৃতির একজন মানুষ। ৪৩ বছরের ছোট জীবনে তিনি যত লেখা উপহার দিয়েছেন, তাতে এই বিষণ্ণতার আভাস মেলে।
গোগল ভালোবাসতেন তীক্ষ্ণ মজার গল্প লিখতে এবং ‘ওভারকোট’ তাঁর তেমনি একটি শ্রেষ্ঠ গল্প। গল্পটি অনেকটা এমন : আকাকি আকাকিভিচ নামের এক ব্যক্তি সরকারি অফিসের গরিব কেরানি। এই গরিব কেরানির স্বপ্ন কিন্তু উচ্চাভিলাষী নয়। তার স্বপ্ন, একদিন একটি নতুন ওভারকোট তৈরি করাবে। সারা জীবন ধরে সে এ জন্য কিছু কিছু সঞ্চয় করে। আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবহীন এই মানুষটির দুর্ভাগ্য, যেদিন কোটটি তৈরি হলো, সেই রাতেই সেটি চুরি হয়ে গেল। এ যেন বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাস!
ওভারকোট উদ্ধারের জন্য যখন এই মুখচোরা মানুষটিই সাহস করে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের কাছে গিয়ে উপহাসের পাত্র হলেন, বুঝলেন বৃথাই প্রয়াস।
এর পর হাজির হলেন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিটির কাছে। কিন্তু গরিবের পোড়া কপাল! গণ্যমান্য ব্যক্তিটি কথার বাণে ধরাশায়ী করলেন তাকে। অতঃপর আকাকিভিচের বিদায়; শুধু সেখান থেকেই নয়, বরং পুরো দুনিয়া থেকেই। এটিই ছিল ‘ওভারকোট’ গল্পটির প্লট। এই গল্প সম্পর্কে রুশ সাহিত্যিক ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির একটি চমৎকার উক্তি আছে, ‘আমরা সবাই গোগলের ওভারকোট থেকেই বের হয়ে এসেছি।’
খেয়ে না-খেয়ে পুরো জীবন ধরে জমানো সঞ্চয় দিয়ে শুধু শীত নিবারণের জন্য বানানো ওভারকোটটি ছিল যে হতদরিদ্র মানুষটির একমাত্র সম্বল, তার নিঃস্বতা বোঝার সুযোগ তো ওপরওয়ালাদের নেই। এভাবেই নিরুপদ্রব এবং হতদরিদ্র মানুষগুলো দুনিয়া থেকে হারিয়ে যায়। এমনভাবে যেন একটি সংখ্যা কমে গেল, মানুষ নয়! এ গল্পটিতে গোগলের বাস্তব জীবনকে সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস চোখে পড়ে।
এতে মনে হয়, যেন গোগল যেন ঈশ্বরকে বলছেন, ‘তোমার দুনিয়া কত শূন্য এবং ভয়াবহ!’