আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনীতিতে নজরুল-সাহিত্যের প্রভাব

বাংলাসাহিত্যের অন্যতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একাধারে তার বিচরণ সাংবাদিকতা ও রাজনীতিতে। ব্রিটিশ ভারতের সেনা হিসেবেও কাটিয়েছেন দিন। যার প্রভাব রয়েছে তার লেখায়। শব্দরা জীবন্ত প্রতিধ্বনিত ছড়িয়েছে সেখানে। তাঁর কলম বন্দুকের ট্রিগার ছিল, তাঁর গান ছিল মিছিলের ধ্বনি। সেই সুর আজও প্রতিধ্বনিত হয় রাজপথে, হৃদপটে। কবির রাজনৈতিক আদর্শ শুধু অতীতের চিহ্ন নয়, আজকেরও পথনির্দেশক। নজরুল তাই কেবল কবি নন, তিনি যুগ-জাগরণের রাজনৈতিক চেতনাস্বরূপ।
বারংবার নানা আন্দোলন সংগ্রামে কবির লেখা পঙক্তি উচ্চারিত হয়েছে বিক্ষুব্ধ-নিষ্পেশিতদের কণ্ঠ হয়ে। তার রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকাণ্ড গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি থেকে বর্তমান পর্যন্ত। এই ভুখণ্ডের বিভিন্ন আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে সুর ছড়িয়েছে। গেল ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেও যখন কিশোর থেকে যুবারা রাজপথে নেমে এলো তখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলে যে সব স্লোগান, গান; তার মধ্যে নজরুলের লেখা নবীনদের আগমনী বার্তাও বেজেছে সবখানে— ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।’
একাল থেকে সেকাল, সেকাল থেকে একালের ভূরাজনীতিকে যতো জুলুম অত্যাচার হয়েছে, পীড়িত, অত্যাচারিতরা সমস্বরে গেয়েছেন, ‘‘কারার ঐ লৌহ–কবাট/ ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/ রক্ত-জমাট শিকল–পূজার পাষাণ-বেদী’। ৬৯ থেকে একাত্তর, রক্তাক্ত প্রান্তর থেকে মাঠ-ময়দান; সবখানে যেন রক্ত গরম রেখেছে এই গান। ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘বাঙ্গলার কথা’ পত্রিকার ‘২০ জানুয়ারি ১৯২২’ সংখ্যায় প্রকাশিত গানটি নজরুল ১৯২১ সালে লিখেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জেলযাত্রার পর তার স্ত্রী বাসন্তীদেবীর অনুরোধে নজরুল এর কাব্যরূপ তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। ১০০ বছরেও তা অম্লান আন্দোলন সংগ্রামে মুক্তিকামীদের স্লোগানে, যা ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধেও গেয়েছিলেন কারাবন্দি রাজনীতিকেরা।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত হলেও, তিনি ছিলেন রাজনৈতিক চিন্তার এক অতলস্পর্শ বেদনার্ত দ্রষ্টা। ‘বল বীর—/ বল উন্নত মম শির!’ বলে উত্থিত তার কলম বজ্রকণ্ঠ হয়ে ধরা দেয় তাই ৯০-এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেরও। সেখানে মিছিলে মিছিলে কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যাম/মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,/মোরা বিধাতার মত নির্ভয়/মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।/মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন/মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,/বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন/চিত্তমুক্ত শতদল।’
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথিতযশা কবি নন, বরং এক অনন্য রাজনৈতিক চেতনার ধারক ও বাহক। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ ও সাংবাদিকতা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সরব মাধ্যম। বিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের নিগড়ে বন্দী, তখন নজরুলের কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছিল বিদ্রোহের ভাষায়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতীয় সমাজে যে অস্থিরতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের আবির্ভাব ঘটে, নজরুল তা গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন। সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা, নিম্নবর্গের মানুষের জীবন দেখার সুযোগ এবং ইসলাম ও হিন্দুধর্মের সাম্যের বাণী তাকে এক সার্বজনীন সাম্যবাদী ভাবনার দিকে নিয়ে যায়। এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর রাজনৈতিক কবিতা ও প্রবন্ধ। ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া কবি মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯২১ সালে ‘ভাঙার গান’ লিখে ক্ষান্ত হননি, লিখেছিলেন তার কালজয়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। যে লেখায় ইংরেজদের ভিত কেঁপে উঠেছিল।
বিদ্রোহী, ভাঙার গান-এর পাশাপাশি ‘সাম্যবাদী’সহ নানা কবিতার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিকে সাহস ও সুর জুগিয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে লিখেছেন ‘চল্ চল্ চল্’। প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রেরণাদায়ী স্লোগান হয়ে আছে এই গান। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে চরণ-চিহ্ন,/আমি বিশ্বপীড়িতের ধ্বংস-দূত, বেদনায় বেদনায় গঠিত আমার জীবন।’ এই ধরনের উচ্চারণ শাসক শ্রেণিকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং তাঁর বিরুদ্ধে একাধিকবার ব্রিটিশ সরকার মামলা করে।
নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকা ধূমকেতু ছিল তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশভূমি। এই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। তাতে তিনি দমে যাননি, বরং রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে লিখেছেন, ‘কারা তোমার ভয় দেখায়?’
কবি বুদ্ধদেব বসু, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হিরণ্ময় ভট্টাচার্য নজরুলকে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশ্লেষকেরা নজরুলের রাজনৈতিক চিন্তাকে একটি স্বতন্ত্র বিপ্লবী দর্শন হিসেবে দেখেছেন। তাঁরা মনে করেন, নজরুল শুধুই সাহিত্যিক নন, এক রাজনৈতিক দার্শনিক। তাঁর সাম্যবাদ কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শে আবদ্ধ ছিল না, বরং মানবিকতার শাশ্বত আদর্শে নির্মিত। সম্প্রদায়িক ভেদে রাজনৈতিক দূরদর্শীতা ছিলো তার কবিতায়, যা এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিকরা তাদের বক্তৃতায় উল্লেখ করে থাকেন। সামব্যবাদী কবিতায় তিনি ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, বর্ণভেদের বিরুদ্ধে লড়েছেন ও লড়তে শিখিয়েছেন। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান—/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা, সব ভেদাভেদ।’ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় ধর্ম ইস্যু যখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখনও এই পঙক্তিগুলো অমীয় বাণী হয়ে ধরা দেয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের প্রভাব পরোক্ষ হলেও গভীর ছিল। তাঁর গান ও কবিতা বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গান ছিল প্রেরণার উৎস। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষিত হন তিনি, কারণ তাঁর রাজনীতিক চেতনা এবং সাংস্কৃতিক অবদান বাংলা জাতিসত্তাকে গঠনে সহায়তা করে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক