কবরস্থানে কেউ কোরআন পড়ছে, কেউ এসেছে ঈদ-বিনোদনে
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/22/k-1.jpg)
ঈদুল আজহার দিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৬৭ বছর বয়সী রেহেনা বেগম। রাতেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয় রায়েরবাজার কবরস্থানে। করোনায় মৃতদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানের আট নম্বর ব্লকে তাঁকে দাফন করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে মরহুমের মেয়ে তাসলিমা আক্তার কবরের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। আর মাকে রোদ থেকে ছায়া দেওয়ার জন্য ছেলে নজরুল ইসলাম মাথায় ছাতা ধরেছিলেন।
এই কবরস্থানটি ‘রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ’-এর পাশেই। জাতীয় দিবসসহ অন্যান্য ছুটির দিনে নগরবাসী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন। আজ বিকেলেও সেখানে ভিড় ছিল। এর মধ্যেই শত শত মানুষ নিরিবিলি পরিবেশ দেখে বিনোদন ও ঘোরাঘুরির জন্য সেই কবরস্থানেও চলে আসে। তাদেরকে কবরস্থানের রাস্তায় ঈদের আনন্দ করতে দেখা গেছে। কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে গল্প করছে। বন্ধুরা বসে আড্ডা দিচ্ছে।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/22/k-2.jpg)
ভেতরে থাকা অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে; তারা ঈদের ছুটিতে ঘুরতে এসেছেন সেখানে। কবরস্থানের ভেতরে মোটরসাইকেলও চালাতে দেখা গেছে। সেখানে অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্কও ছিল না।
এই অবস্থার মধ্যেই কবরস্থানের মূল রাস্তাটির ঠিক পাশের একটি কবরের সামনে বসেই মৃত মায়ের জন্য দোয়া করছিলেন তাসলিমা আক্তার।
দীর্ঘক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়া করার পর ওঠে আসেন তাসলিমা। তিনি বলছিলেন, ‘আমার মা ঈদের দিনই মারা গেলেন। আল্লাহ মাকে ভালো রাখুক। কিন্তু ভয় হল, মানুষ একেবারেই সচেতন না। দেখছেন, করোনার রোগী দাফন করা হয় এখানে। আর সেখানেই শতশত মানুষ ঘুরতে এসেছে। আড্ডা দিচ্ছে। অথচ, আমরা কত সচেতন ছিলাম। তারপরও....।’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/22/k-3.jpg)
তাসলিমা আক্তার (ছদ্মনাম; অনুরোধে কারো আসল নাম দেওয়া হয়নি) রাজধানীর একটি টিসার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষিকা। তিনি বলছিলেন, ‘এই যে শত শত মানুষ এখানে ঘুরতে এসেছে, এটা মেনে নেওয়া যেত আরও ১০ বছর বা তার বেশি সময় পরে হলে। তখন মানুষ এই ভেবে আসতেন যে, একসময় করোনায় মানুষ মারা যেত, দেখে আসি। দেখেন, মানুষের মুখে মাস্কও নেই।’
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি করোনায় মারা যান শামীম আহমেদ। তাঁকে দাফন করা কবরস্থনের শেষ মাথায় রামচন্দ্র খালের পাশে। তাঁর পরিবারেরও তিনজন নারী এসেছিলেন কবরস্থানে। তিনজনের হাতে তিনটি কোরআন শরিফ। তিনজনই তেলাওয়াত করছিলেন। যখন মানুষজন অতিরিক্ত শব্দ করে গল্প করছিলেন পাশে, তখন ওই তিনজনের একজন বারবার তাকাচ্ছিলেন আড্ডারত মানুষের দিকে। তবে তাঁরা কেউ গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি।
তার কিছু দূরেই ফাতিমা নামের আরেক নারী দোয়া পড়ছিলেন বাবার কবরের পাশে। তিনি বলছিলেন, ‘আমি খুবই অবাক হচ্ছি। এখানে মানুষের আসার কথা দোয়া-মোনাজাত করতে। আর মানুষজন এসেছে আড্ডা দিতে।’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/22/k-4.jpg)
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে থাকেন খালেক মিয়া। তিনি পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে। তবে তিনি পরিবার নিয়ে ঢুকেছেন কবরস্থানের ভেতরে। খালেক মিয়া বলছিলেন, ‘স্মৃতিসৌধে অনেক লোকজন। সেজন্য এর ভেতরে এসেছি একটু বসে কথা বলার জন্য। কিন্তু এখানেও দেখি অনেক মানুষ। কাল থেকে তো আর বের হতে পারব না। তাই আজকে পরিবার নিয়ে বের হয়েছি।’
মতিয়ার হোসেন ও তাঁর বন্ধু সেলিম কবরস্থানের ভেতরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলে মতিয়ার বলেন, ‘ঈদের পরের দিন একটু ঘুরতে এলাম। ঈদে গ্রামের বাড়ি যাইনি। সেজন্য ঘুরতে বের হয়েছি।’
খালেক মিয়া ও সেলিমের মতো এমন শত শত মানুষ কবরস্থানের মধ্যে ঘুরছিলেন। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের সময় অফিস বন্ধ। ঢাকাতে আছেন। ফলে ঘুরতে বের হয়েছেন। আগামীকাল সকাল ৬টার পর কঠোর লকডাউন। সেজন্য পরে আর বের হতে পারবেন না বলে তাদের মত।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/07/22/k-5.jpg)
রায়েরবাজার কবরস্থানে মোট ৩২ জন গোরখোদক রয়েছে। ইনচার্জ গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘দেখেন, কবরস্থানে যদি কেউ প্রবেশ করে আপনি তাকে মানা করবেন কীভাবে? আর কে কবর জিয়ারত করতে আসছে, কে ঘুরতে আসছে বুঝবেন কীভাবে? কবরস্থানে মাত্র ১৮ জন সিকিউরিটি আছে। তাদের পক্ষে সবাইকে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব না। কারণ, প্রতিদিন অন্তত ১৪ হাজার লোক এখানে আসে। আজ অনেক লোক। যাদের মধ্যে অনেকেই ঘুরতে এসেছেন। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ যদি কঠোর হন, তাহলে এসব বন্ধ হবে।’