কমেছে ফার্নেস অয়েল-এলপিজি গ্যাসের দাম, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর দাবি

বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে যাওয়ায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) গ্যাস সিলিন্ডারের (বোতল) বিক্রয়মূল্য ১০০ টাকা কমিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। এর আগেই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের দাবির মুখে ফার্নেস অয়েল লিটার প্রতি আট টাকা কমানো হয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ট্যাঙ্ক-লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম কাবুল ডিজেল, কেরোসিন ও পেট্রোলের দাম কমানোর দাবি করেন। তিনি বলেছেন, ‘ফার্নেস অয়েলের দাম কমানোতে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মালিকরা লাভবান হবেন, সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না।’
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিম গত ৩০ জুন এক বিজ্ঞপ্তিতে ফার্নেস অয়েলের বিক্রয়মূল্য লিটারপ্রতি ৩৪ দশমিক শূন্য ৩ টাকা পুনর্নির্ধারণ করেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মহোদয়ের সভাপতিত্বে গত ২৪ জুন অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভার সিদ্ধান্তের আলোকে গঠিত কমিটির সুপারিশ এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিপিসি প্রান্তে মজুদ দুই লাখ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েলের মূল্য নির্ধারণ করা হলো। করপূর্ব মূল্য ২৭ দশমিক ৬৬, মূসক ৪ দশমিক ১৫, কর উত্তর মূল্য ৩১ দশমিক ৮১ এবং ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য ৩৪ দশমিক শূন্য ৪ টাকা, যা এর আগে লিটারপ্রতি ৪২ টাকায় বিক্রি হতো।
এ ছাড়া গত ২০ জুলাই অপর এক বিজ্ঞপ্তিতে এলপিজি গ্যাস (সাড়ে ১২ কেজি) সিলিন্ডারপ্রতি ৬০০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়, যা এর আগে সিলিন্ডারপ্রতি ৭০০ টাকা ছিল। এলপিজি গ্যাস হলো জ্বালানি তেলের বাই প্রোডাক্ট। জ্বালানি তেল রিফাইন করার সময় এ এলপিজি গ্যাস বের হয়।
বাংলাদেশ ট্যাঙ্ক-লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতির মহাসচিব সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম কাবুল বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১ থেকে ৩ শতাংশেরও কমে নেমে আসা সত্ত্বেও, এ দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক পয়সাও কমানো হয়নি। অথচ জ্বালানি তেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যের কারণে পরিবহন ব্যয়, জিনিসপত্রের ব্যয় এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে দেশের সাধারণ মানুষ অসহনীয় জীবনযাপন করছে।’
সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম কাবুল বলেন, ‘বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে ব্যবহার করা ফার্নেস অয়েলের দাম ৪২ টাকা থেকে কমিয়ে ৩৪ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আগের অবস্থা থেকে পরিবর্তিত হয়নি। অথচ যে জ্বালানি তেল, ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও কেরোসিনের মূল্যের সঙ্গে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের জীবনযাপনের সম্পৃক্ততা, সে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়নি। বর্তমানে পেট্রোল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় না, যা দেশে উৎপাদন হয় এবং দেশের যেকোনো জায়গায় যেকোনো মূল্যে পেট্রোল বিক্রয় করলেও সরকারের লোকসান হবে না। বলা হয়ে থাকে, বড়লোকরা পেট্রোল ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে এটা ভ্রান্ত ধারণা। এখন গ্রাম কিংবা শহরে সর্বত্র ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। ফলে এখন বড়লোকরা পেট্রোল ব্যবহার করে, কথাটি সত্য নয়।’
সাজ্জাদুল করিম বলেন, ‘যখন বারবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, তখন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে মূল্যে সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ বিশ্ববাজারে দাম কমলে এ দেশে কমানো হয় না।’ তিনি বিষয়টির দিকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ ছাড়া এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার প্রতি ১০০ টাকা কমানোর জন্য সাধুবাদ জানান তিনি।
মেঘনার পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর সাইফুল্লাহ আল খালিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বিপিসির ফার্নেস অয়েলের ৯৯ দশমিক ১০ শতাংশ ক্রেতাই বেসরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট। বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ প্লান্টে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলে ২০ শতাংশ বিপিসি থেকে গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বেসরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ বিপিসির ফার্নেস অয়েল গ্রহণ করছিল না। তাদের দাবি, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় বিদেশ থেকে কম মূল্যে ফার্নেস অয়েল আনতে পারছে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট। তারা বেশি দামে বিপিসির ফার্নেস অয়েল নেবে কেন? ফলে বিপিসির মজুদ বেড়ে দুই লাখ টনে উন্নীত হয়। এজন্য এ ফার্নেস অয়েলের মূল্য কমানো হয়েছে।
এদিকে সম্মিলিত সচেতন নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) খুলনার প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট কুদরাতে খোদা এ বিষয়ে বলেন, ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ফার্নেস অয়েলের দাম কমিয়ে নিয়েছে। কিন্তু জনগণের চাপের বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল ভোট ব্যবস্থা। কিন্তু এখন ভোটে জনগণের প্রয়োজন হয় না, তাই জনগণের কথা কেউ ভাবে না। ফলে সরকারের কাছ থেকে বিত্তবানরা প্রণোদনা, ব্যাংক ঋণ মওকুফসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু জনগণ কিছু পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমলেও জনগণ সুবিধা পাচ্ছে না, পাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতি।’
তবে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য কমানোর জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানান অ্যাডভোকেট কুদরাতে খোদা। তিনি বলেন, ‘দেশের খুলনা বিভাগেই গ্যাস সরবরাহ নেই। সে হিসেবে এখানেই সিলিন্ডার গ্যাস বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই এ এলাকার গ্রাহকরা উপকৃত হবে। করোনা মহামারির এ সময় কিছুটা হলেও আর্থিক সাশ্রয় হবে।’

