কাজী আরেফের খুনি পাল্টেছিলেন পরিচয়পত্র, ফোন ব্যবহারেও সাবধানী

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদসহ দলটির পাঁচ নেতাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি রওশন আলী ওরফে উদয় মণ্ডল। দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। একটি সূত্র ধরে নিশ্চিত হয়ে ১৫ দিন আগে তাকে ধরতে চেষ্টা করতে থাকে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অবশেষে গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, রওশন আলী ওরফে উদয় মণ্ডল একজন ধূর্ত শ্রেণির লোক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তিনি ‘ছদ্মবেশ’ ধরেছিলেন। পাল্টে ফেলেছিলেন নিজের জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম-ঠিকানা। শুধু তাই নয়, তিনি মুঠোফোনেও কথা বলতেন না। র্যাব তার গত ছয় মাসের কললিস্ট ঘেঁটে দেখেছে, তিনি তরুণ নামের একজনের সঙ্গেই মূলত কথা বলেছেন।
অভিযানিক দলের নেতৃত্বে থাকা এক র্যাব কর্মকর্তার দাবি, শুধু তাই নয়, রওশন আলী সব সময় তার মুঠোফোনটি বন্ধ করে রাখতেন। দিয়ে রাখতেন মিসকল এলার্ট। যাতে তিনি বুঝতে পারেন, তরুণ তাকে কল দিয়েছিলেন। এবং পরে অন্যভাবে তরুণের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন। রওশন আলী জমি-জায়গা দখল করতেন। বিনিময়ে টাকা নিতেন। আর তরুণই মূলত এসব লেনদেন দেখভাল করতে।
অভিযানকারী দল র্যাব-৫-এর আওতাধীন সিপিসি-২-এর কোম্পানি কমান্ডার সানরিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, রওশন আলী ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের নাম-ঠিকানা পাল্টে ফেলেন। নিজের নাম রওশন আলী থেকে করে ফেলেন উদয় মণ্ডল। তবে বাবার নাম ঠিক রাখেন। বেশ আগে আমরা জানতে পারি, রওশন রাজশাহীর শাহ মখদুম থানা এলাকায় গোপনে অবস্থান করছেন। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছিলাম না। কারণ, তিনি আমাদের হাত থেকে বেঁচে থাকতে ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। এতটাই গোপনে থাকতেন যে, তার অবস্থান তিনি কাউকেই বলতেন না। সর্বশেষ গতকাল বুধবার দিবাগত রাতে তাকে শাহ মখদুম থানার ভাড়ালিপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা সানরিয়া বলেন, সর্বশেষ আমরা জানতে পারি, তিনি দুবার অনলাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছিলেন। জানতে পারি কারণ, তার একটি মোবাইল নম্বর আমাদের কাছে ছিল। ওই নম্বরটি আমরা ট্রাকিং করতাম মাঝেমধ্যে। পরে ওই বিদ্যুৎ বিলের সূত্র ধরে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করি। পরবর্তীকালে নানাবিধ ভয়ভীতি দেখালে তিনি সবকিছু স্বীকার করেন।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে রওশন আলীকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে একটি সভা চলাকালীন প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের অতর্কিত গুলিতে নিহত হন কাজী আরেফসহ পাঁচজন। ওই ঘটনায় দৌলতপুর থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলায় ২৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা দায়রা জজ আদালত ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এরপর আসামিরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট উচ্চ আদালত নয় আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। আর বাকি ১৩ জনকে খালাস দেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি তিনজন আসামির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া একজন আসামি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপর পাঁচ আসামি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক রয়েছেন। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় রওশনকে গ্রেপ্তার করে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, রওশন স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে রাজবাড়ীস্থ একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর ১৯৯২ সাল থেকে সীমান্তবর্তী চোরাচালান, হাট ইজারাসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ কাজে সম্পৃক্ত হন। এসব কাজে তিনি এলাকায় সন্ত্রাসীচক্র গড়ে তোলেন। তার সঙ্গে চরমপন্থি দলের সখ্যতাও তৈরি হয়। ১৯৯৮ সাল পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন তিনি। এ সময় মাঝে মধ্যে গা ঢাকা দিতে রাজশাহীতে অস্থায়ীভাবে অবস্থান শুরু করেন। রওশন রাজশাহীতে তার আদি নিবাস গাজীপুর বলে সবাইকে জানাতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি একটি গরুর খামার স্থাপন করেন। পরবর্তীতে জমি কেনা-বেচার ব্যবসায় যুক্ত হন।
কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে রওশনের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন বলেন, ওই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ছাড়াও সমন্বয় এবং পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এ ছাড়া চেয়ারম্যান বাকী ও স্থানীয় আমজাদ হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও পরিকল্পনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। তার নামে ২০০৫ সালে গাংনীতে একটি ডাকাতি মামলাও রয়েছে। এ ছাড়া রওশন আলী ২০০০ সালে ২১ জুন স্কুলশিক্ষক আমজাদ হত্যা মামলার এক নম্বর চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি।