তিলোত্তমা ঢাকা গড়ার স্বপ্ন দেখাতেন নগরপিতারা

মহান মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। এরই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরের গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। নয় মাসব্যাপী মুক্তিসংগ্রামের কারণেই বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করে ঢাকা। স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পান, এমন অনেক নগরপিতাই চলে গেছেন আড়ালে।
ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ নগরীকে ৫০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা পৌরসভা গঠন করা হয়।
১৯৭৮ সালে ঢাকা পৌরসভাকে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। আর তখন থেকেই পৌরসভার চেয়ারম্যানকে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নামে অভিহিত হয়। ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৩ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের আয়তন, জনসংখ্যা ও দায়িত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ওয়ার্ডের সংখ্যা ৭৫টিতে উন্নীত হয়। ১৯৯০ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঢাকা সিটি করপোরেশন।
প্রথম প্রত্যক্ষ ভোট
১৯৯৪ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৭৫টি ওয়ার্ডকে ৯০টিতে উন্নীত করে প্রথম জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এ নির্বাচনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ। মেয়রের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের ৯০ জন ওয়ার্ড কমিশনারও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন।
২০০২ সালে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে ৯০ জন ওয়ার্ড কমিশনারের পাশাপাশি ৩০টি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদেও সরাসরি নির্বাচন হয়। প্রতি তিনটি ওয়ার্ডের জন্য একজন মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
ঢাকার নগরপিতারা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকার প্রথম প্রশাসক মনোনীত হন খালেদ শামস। তিনি ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। মনজুরুল করিম প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে একই বছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত।
এইচ এন আশিকুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ১৯৭৪ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর অব্যাহতির পরদিন প্রশাসকের দায়িত্ব দেন লে. ক. (অব.) হেশাম উদ্দিন আহাম্মদ। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত।
১৯৭৭ সালের ৩১ অক্টোবর ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ভোটে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। তিনি ১৯৮২ সালের ৯ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ১৫ মে থেকে ১৯৮৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহামুদুল হাসান। তাঁর অব্যাহতির পর থেকে ১৯৮৯ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল (অব.) এম এ মালেক।
১৯৮৯ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯০ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়র হিসেবে দাযিত্ব পালন করেন মো. নাজিউর রহমান মঞ্জু। ১৯৯০ সালের ৩ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৯ দিন পুনরায় মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। ১৯৯০ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৫ মে পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন ওয়ালিউল ইসলাম।
১৯৯১ সালের ১৯ মে থেকে ১৯৯৪ সালের ১০ মার্চ পর্যন্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন মির্জা আব্বাস। তিনি বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
১৯৯৪ সালের ১২ মার্চ থেকে ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ হানিফ।
২০০২ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাদেক হোসেন খোকা।
২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন মো. খলিলুর রহমান। ২০১২ সালের ৩ জুন থেকে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন মো. জিল্লার রহমান।
বিভক্ত ঢাকা
২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইনের মাধ্যমে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করা হয়। একটির নাম হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, অন্যটির নাম হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল উভয় সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে জয়ী হন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এবং উত্তরে জয়ী হন আনিসুল হক। দুজনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন।
আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম জয়ী হন।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল মাত্র দুই লাখ ৯৫ হাজার। ১৯৫১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৩৫ হাজার ৯২৮ জনে। ১৯৬১ সালে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ১৪৩ জন, ১৯৭৪ সালে ১৬ লাখ ৪৯৫ জন, ১৯৮১ সালে ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ১৪৭ জন, ১৯৯১ সালে ৬৮ লাখ ৪৪ হাজার ১৩১ জন এবং ২০০১ সালে তা উন্নীত হয় এক কোটি সাত লাখ ১২ হাজার ২০৬ জন।
বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভেতরে বসবাসকারী নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও সেবা সংস্থাগুলোর ধারণা, এ সংখ্যা দুই কোটির ওপরে। তবে দুই সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ৫৪ লাখ তিন হাজার ১০৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের ভোটার ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৬২১ জন। দক্ষিণে ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৮ জন।