বরগুনার সেই শিশুদের ঠাঁই হলো সাংবাদিকের ঘরে

পারিবারিক কলহের জেরে সহিংসতা, এরপর দাদির করা মামলায় মা কারাগারে। চাকরিজীবী বাবার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এমন অবস্থায় অবুঝ দুই শিশুর ঠাঁই হয় রাস্তায়। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দিনভর অবস্থান নেয় বরগুনা শহরের দুটি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। কিন্তু কে নেবে এই শিশুদের দায়িত্ব? কে দেবে ওদের আশ্রয়? অবশেষে তাদের ঠাঁই হয় সাংবাদিক সোহেল হাফিজের ঘরে।
মায়ের মুক্তির দাবিতে বরগুনা শহরের টাউনহল এলাকার অগ্নিঝরা একাত্তরের পাদদেশে আজ শনিবার অসহায় দুটি শিশু অবস্থান নেয়। বিকেলের দিকে তারা অবস্থান নেয় বরগুনার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। অসহায় দুই শিশুর এ করুণ পরিণতি দেখতে সেখানে ভিড় জমান শত শত উৎসুক জনতা। সন্ধ্যা পর্যন্ত অসহায় দুই শিশুর কেউ কোনো দায়িত্ব না নেওয়ায় অবশেষে তাদের ঠাঁই হয় বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও এনটিভি বরগুনার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোহেল হাফিজের ঘরে। পরম মমতায় নিজের সন্তানের মতোই তাদের বুকে আগলে নেয় সোহেল হাফিজের স্ত্রী জাফরিণ নিতু। মা জেলে থাকলেও বর্তমানে শিশু আলিফ ও গালিফ রয়েছে মায়ের স্নেহ নিয়ে নিতুর কোলেই।

বরগুনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু জানান, পারিবারিক সহিংসতায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। ক্ষতিগ্রস্তও হয় শিশুরা। বরগুনার অসহায় দুই শিশু আলিফ এবং গালিব তার প্রমাণ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ দুই শিশুর কেউ দায়িত্ব না নেওয়ায় মানবিক কারণে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাফিজ ও তাঁর স্ত্রী জাফরিণ নিতু সন্ধ্যার দিকে তাদের বাসায় শিশু দুটিকে আশ্রয় দেন।
হাসানুর রহমান ঝন্টু আরও বলেন, ‘দোষ-ত্রুটি যাই থাকুক তার সবই পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কদের। এ ঘটনায় শিশুরা কেন ভুক্তভোগী হবে? এসব বিষয় নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের ভাবতে হবে।’
এ বিষয়ে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাফিজ জানান, ভুক্তভোগী শিশু আলিফের সঙ্গে কথা বলে তিনি জেনেছেন বাবার চাকরির সুবাদে তাঁরা গাজীপুরে বসবাস করে আসছিল। সে সেখানকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সম্প্রতি সে ইংল্যান্ডের একটি স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে বলে জানায়। তার ভিসাও প্রস্তুত। করোনার কারণে তার ইংল্যান্ড যেতে দেরি হচ্ছিল। অথচ এমন একটি সময়ে তার দাদির করা মামলায় কারাগারে রয়েছেন তাদের মা আনিতা জামান।
শিশু আলিফ আরও জানায়, তার বয়স এখন ১২ বছর। অথচ মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলায় তার বয়স ১৮ বছর দেখিয়ে তাকেও আসামি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালীন গত দুই তিনমাস ধরে শিশু আালিফ ও গালিফকে নিয়ে মা আনিতা জামান বরগুনায় তাদের গ্রামের বাড়ি আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নের খেজুরতলা গ্রামে থাকছেন। জমি সংক্রান্ত বিষয়ে পারিবারিকভাবে আলিফ ও গালিফের বাবা মনিরুজ্জামান জুয়েল ও তার মা-বোনদের মধ্যে কলহ চলছে। এসব কলহের জের ধরে আলিফের দাদি আলেয়া বেগম তাঁর ছেলে মো. মনিরুজ্জামান ও পুত্রবধূ আনিতা জামানের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় মারধরের অভিযোগে একটি মামলা করেন। সে মামলায় গত ১৫ জুলাই বৃহস্পতিবার আলিফের মা আনিতা জামানকে জেলহাজতে পাঠায় আদালত।
আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শিশু আলিফ ও গালিফের নানার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। বরগুনায় তার দাদার বাড়ির স্বজন ছাড়া আর কোনো স্বজন নেই। একপক্ষে আলিফের দাদি ও ফফুরা, অন্যদিকে আলিফ ও গালিফের বাবা-মা। জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণে পারিবারিকভাবে এ দুপক্ষের বিরোধ চরমে পৌঁছালে উভয়পক্ষই মারমুখী হয়ে পড়েন। পরে দাদি আলেয়া বেগমের করা মামলায় মা অনিতা জামান কারাগারে যান।’
চেয়ারম্যান মোশাররফ আরও বলেন, ‘যে শিশুটির বয়স ১২ বছর তাকে মামলায় ১৮ বছর দেখানো হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। এ বিষয়ে শিশু আলিফ আমাকে জানায় তার ফুফুরাই তার মাকে মারধর করেছেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলিফ ও গালিফের বাবা মো. মনিরুজ্জামান জুয়েল গাজীপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মামলায় ঘটনার যে সময় দেখানো হয়েছে, সে সময় আলিফের বাবা মো. মনিরুজ্জামান জুয়েল তাঁর কর্মস্থলে ছিলেন। সেখানে ডিজিটাল হাজিরায় তাঁর হাজিরা রয়েছে। অথচ মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেই মামলায় তার বাবা মনিরুজ্জামান জুয়েলকে আসামি করা হয়েছে। তাঁর নামে ওয়ারেন্ট রয়েছে। এ অবস্থায় দুই বছরের দুগ্ধপোষ্য শিশু ছোট ভাই গালিফকে নিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তাদের। তাই এ মামলা থেকে মায়ের মুক্তির দাবি জানিয়েছে অসহায় দুই শিশু।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম সিকদার জানান, ভুক্তভোগী দুই শিশুর চাচা ও ফুফুদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে এ মামলা করা হয়েছে। এতে অসহায় হয়ে পড়েছে এই শিশুরা। দুগ্ধপোষ্য শিশু ও এবং করোনাকালীন একজন নারীর অসহায়ত্ব তুলে ধরে আদালতে জামিনের আবেদন করেছিলাম। আদালত জামিন নামঞ্জুর করেছেন। আগামীকাল আবারও আসামিপক্ষে জামিন আবেদন করা হবে।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিসকাত সাজ্জাদ জানান, ‘করোনাকালীন দুই থেকে তিন মাস ধরে এ দুই শিশুর বাবা-মা বরগুনায় থাকছেন। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পারিবারিকভাবে আলিফ ও গালিফের বাবা মনিরুজ্জামান জুয়েল ও তাঁর মা-বোনদের মধ্যে কলহ চলছে। আলিফের বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ দাদিকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, ‘সন্ধ্যার দিকে অসহায় শিশুদের অসহায়ত্বের কথা ভেবে মানবিক কারণে বরগুনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাফিজ ও তাঁর স্ত্রী জাফরিণ নিতু তাদের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই দুই শিশুর জন্য সব রকমের সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।’