‘বাইরে এসেছিলাম বলে বেঁচে গেছি, কিন্তু মাকে বাঁচাতে পারিনি’
‘আমি বেঁচে গেছি বাইরে এসেছিলাম বলে কিন্তু মাকে বাঁচাতে পারিনি।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের পাশে এ কথা বলে আহাজারি করছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া চম্পা আক্তার।
আজ শুক্রবার বিকেলে চম্পা আক্তার এনটিভি অনলাইনকে জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে মা মিনা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ গ্রুপের কারখানায় যান। মা কাজ করতেন ভবনের চতুর্থতলায় আর মেয়ে দ্বিতীয়তলায়।
‘কারখানায় আগুন লাগার ঠিক আগ মুহূর্তে একটি কাজে আমি দ্বিতীয়তলা থেকে নিচতলায় যাই। তারপরই আগুন লেগে যায় কারখানায়’, যোগ করেন চম্পা আক্তার। তিনি আরও বলেন, ‘এরপর আমি আর কারখানায় ঢুকতে পারেননি। মা ছিলেন ভেতরে। আগুন লাগার পর আর মাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। কোথাও না পেয়ে শেষ পর্যন্ত শুক্রবার বিকেলে ঢামেক মর্গে চলে এসেছি। আমি আমার মাকে দেখতে চাই, পোড়া লাশ হলেও চাই।’
চম্পার সঙ্গে তাঁর খালাত ভাইও এসেছেন। চম্পা বারবার কেঁদে উঠে মায়ের খোঁজ করছেন। কাঁদতে কাঁদতে চম্পা এনটিভি অনলাইনকে বলছিলেন, ‘একসঙ্গে রান্না করে বাসা থেকে বের হয়ে কারখানায় যাই। তারপর আর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। মায়ের জন্য কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। কখন মায়ের লাশ দেখতে পাব জানি না। আমিও লাশ হতে পারতাম। আমি বেঁচে গেছি কাজের প্রয়োজনে ভবনের বাইরে এসেছিলাম বলে। কিন্তু মাকে বাঁচাতে পারিনি।’
চম্পা আক্তার ওই কারখানায় হাজিরা লেখার কাজ করতেন। চম্পা বলেন, ‘অন্য একজন কর্মীর কার্ডের (পরিচয়পত্র) সমস্যা ছিল বলে আমি নিচে এসেছিলাম। আর কিছুক্ষণ সেখানে থাকলে আমিও মারা যেতাম। ওই কারখানার পাশেই ভাড়া বাসায় আমি আর মা থাকতাম।’
এদিকে মো. রাকিব নামের একজনের লাশের সন্ধানে এসেছেন বাবা রফিকুল ইসলাম। তিনি গাজীপুর থেকে সন্তানের খোঁজ করতে ঢামেক মর্গে এসেছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি গতকাল থেকে ছেলের খোঁজ পাচ্ছি না। ফোন দিচ্ছি। ফোন যাচ্ছে না। কোথাও ছেলেকে পাচ্ছি না। এখানে আসার পর পুলিশ বলল, ডিএনএ দিতে হবে। তারপর পরীক্ষা করে লাশ পাওয়া গেলে আমাকে দেবে।’
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ গ্রুপের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তিনজন এবং আজ শুক্রবার দুপুরের পর আরও ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও অর্ধশত।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) জিল্লুর রহমান ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকে জানান, মরদেহগুলো একতলা থেকে চারতলায় ছিল। এখন ভবনটির পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় উদ্ধারকাজ চলছে। এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
গতকাল বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার ভুলতা কর্ণগোপ এলাকায় হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ গ্রুপের এই কারখানায় আগুন লাগে। রাতে দুইজনের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
আগুন লাগার পরপরই মিনা আক্তার (৪০) ও স্বপ্না রানী নামে দুই শ্রমিকের লাশ কারখানা থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে মুরসালিন (২২) নামে এক কর্মী রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি আগুন লাগার পর তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার পর পরই গোটা ভবনে আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আহতদের মধ্যে ১০ জনকে ঢামেক হাসপাতালে এবং ১৬ জনকে রূপগঞ্জ ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।