রায়হান হত্যায় প্রথম গ্রেপ্তার কনস্টেবল টিটু রিমান্ডে

পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিন আহমদ (৩৩) নিহতের ঘটনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর বাজার ফাঁড়ির সাময়িক বরখাস্ত কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাসকে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ মঙ্গলবার বেলা ৩টার দিকে টিটু চন্দ্রকে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়াদুর রহমানের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তা মুহিদুল ইসলাম সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পরে গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী কৌঁসুলি (এপিপি) খোকন কুমার দত্ত। তিনি আরো বলেন, ‘আজ বেলা আড়াইটার দিকে পিবিআই পুলিশ লাইনস থেকে টিটুকে গ্রেপ্তার করে। রায়হান হত্যা মামলায় এই প্রথম কাউকে গ্রপ্তার দেখানো হলো।’
সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান উদ্দিন আহমদকে (৩৩) গত ১০ অক্টোবর রাতে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে। পরের দিন ১১ অক্টোবর সকালে তাঁর লাশ পায় পরিবার। পরে ওই দিন রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। স্বজনদের অভিযোগ, ১০ হাজার টাকা না পেয়ে রায়হানকে পুলিশ হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এ ঘটনার পর ১২ অক্টোবর ওই ফাঁড়ির দায়িত্বরত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রত্যাহার করা হয় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে। এসআই আকবর এখন পলাতক রয়েছে।
রায়হানের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন
গত ১৭ অক্টেবর সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শামছুল ইসলাম বলেন, রায়হানের শরীরে অতিরিক্ত আঘাত করা হয়েছে। এতে ভোতা অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ১১১টি আঘাতের চিহ্ন তিনি পেয়েছেন। এসবের মধ্যে ৯৭টি লীলাফোল আঘাত ও ১৪টি ছিল জখমের চিহ্ন। চিকিৎসক আরো জানান, শরীরে অতিরিক্ত আঘাতের কারণে দেহের ভেতর রগ ফেটে গিয়ে রক্তক্ষরণে রায়হানের মৃত্যু হয়। আঘাতে দেহের মাংস থেতলে যায়। রগ ফেটে গিয়ে আন্তঃদেহে রক্তক্ষরণ (ইন্টারনাল ব্লিডিং) হয়। আর অতিরিক্ত আঘাতে মূর্ছা যান রায়হান। আঘাত করার সময় রায়হানের স্টমাক (পাকস্থলি) ছিল খালি, স্টমাকে ছিল কেবল এসিডিটি লিকুইড।
অতিরিক্ত আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু
গত ১৫ অক্টোবর রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম বলেন, ‘তিন সদস্যের একটি দল রায়হানের মরদেহের পুনরায় ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছে। প্রাথমিকভাবে আমরা বলেছি, আসলে অতিরিক্ত আঘাতের কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।’
‘এর আগে গত ১১ অক্টোবর প্রথম ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করি। এবং প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন শুক্রবার আমরা কোতোয়ালি থানায় দাখিল করেছি’, যোগ করেন চিকিৎসক।
পলাতক এসআই আকবর
এদিকে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া হঠাৎ করেই পুলিশের নজরদারির বাইরে চলে গেছেন। তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসআই আকবর যাতে পালিয়ে ভারতে চলে যেতে না পারেন- এজন্য সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী সব থানা এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, গত ১২ অক্টোবর রাত ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত এসআই আকবর পুলিশের নজরদারিতে ছিলেন। তখন তিনি নগরীর জিন্দা বাজার এলাকায় অবস্থান করছিলেন। এরপর থেকে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভ দেখাচ্ছে। তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
‘ফাঁড়িতে টাকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন রায়হান’
আলোচিত এই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিনের মতো গত ১০ অক্টোবর বিকেল ৩টায় রায়হান উদ্দিন আহমদ কর্মস্থল নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রানীর চেম্বারে যান। রাত ১০টার পর রায়হান বাসায় না ফেরায় তাঁর মোবাইলে ফোন দেওয়া হয়। তখন তাঁর ফোন বন্ধ পায় পরিবার। (১১ অক্টোবর) ভোর সোয়া ৪টার দিকে অন্য একটি নম্বর থেকে রায়হান তাঁর মায়ের কাছে ফোন দেন। তখন রায়হান জানান, তিনি বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাঁকে বাঁচাতে দ্রুত টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে বলেন তিনি।
রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। তখন একজন পুলিশ সদস্য বলেন, রায়হান ঘুমিয়ে গেছে। আর যে পুলিশ সদস্য রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন, তিনিও বাসায় চলে গেছেন। ওই পুলিশ সদস্য রায়হানের চাচাকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে (১১ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসার কথা বলেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, ‘পুলিশের কথামতো হাবিবুল্লাহ আবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে ফাঁড়িতে যান। তখন দায়িত্বরত পুলিশ তাঁকে জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ওসমানী মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। এ সময় হাবিবুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে খবর দিলে তাঁরা গিয়ে ওসমানী মেডিকেলের মর্গে রায়হানের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আমার স্বামীকে কে বা কারা বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে আমার স্বামী মারা গেছেন।’