‘সবাই নৌকায় সিল মেরে দেবেন প্রকাশ্যে’, ভিডিও ভাইরাল

প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বললেন কুষ্টিয়ার মিরপুর পৌরসভার আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী ও বর্তমান মেয়র এনামুল হক। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলা নির্বাচনি আচরণবিধি বহির্ভূত ব্যাপার।
এনামুল হকের সেই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তারপর থেকে সমালোচনার ঝড় বইছে নানা মহলে। বিষয়টির সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। শেষমেশ বিষয়টি গড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত।
গত ৯ জানুয়ারি মিরপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মোশারফপুরে একটি নির্বাচনি সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে এনামুল হক বলেছিলেন, ‘আপনি যদি ওপেন ভোট দেন তাহলে কেউ নিষেধ করতে পারবে না। আমি যদি ওপেন সিল মেরে দিই তা হলে কেউ দেখার নেই।’ তাঁর সেই বক্তব্যের ভিডিওটি সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এনামুল হককে নির্বাচন অফিসে ডাকা হয়েছিল। এ বিষয়ে মিরপুর পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিংকন বিশ্বাস এনটিভি অনলাইনের কাছে দাবি করে বলেছেন, ‘প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলা যে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন, তা এনামুল হককে জানিয়েছি।’ সে সময় এনামুল হক দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে দাবি লিংকন বিশ্বাসের।
রিটার্নিং কর্মকর্তার দাবি ও প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলার বিষয়ে এনামুল হকের মন্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজ বুধবার সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কেউ প্রকাশ্যে ভোট দিতে চাইলে সেখানে দোষের কিছু নেই। এটা নিয়ে কেন এত প্রশ্ন, তা আমি বুঝতে পারছি না।’
৯ জানুয়ারির নির্বাচনী সভায় এনামুল হক বলেছিলেন, ‘আগামী ১৬ তারিখের নির্বাচনে আপনারা যথারীতি সকাল সকাল গিয়ে আপনার ভোট আপনি দেবেন। আপনি যদি ওপেন ভোট দেন তাহলে তো কেউ নিষেধ করতে পারবে না। কারণ, আপনাদের মধ্যে যাতে দূরত্ব না বাড়ে। ভোট আপনিও দিতে চেয়েছেন, আরেকজনও দিতে চেয়েছে। এখন আরেকজন যখন ভেতরে ঢুকে ভোট দেবে তখন অন্যজনের সন্দেহ হবে। পরে একে অপরের বিরুদ্ধে গালাগালি করবেন। যে ওই শালা ভোট দেয়নি। ওই অমুক বংশ দেয়নি। তাই আপনারা সব ওপেন করে দেন। তা হলে আর একে অপরের প্রতি সন্দেহ থাকবে না। আপনারা কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরের ভোট ভেতরে গিয়ে দেবেন আর মেয়র ভোটটি সরাসরি দিয়ে দেবেন।’
ওই সভায় মেয়র পদপ্রার্থী এনামুল হককে আরো বলতে শোনা যায়, ‘ভোট ভয়ের কোনো ব্যাপার না, কে দিচ্ছে সেটা ব্যাপার না। আমি যদি ওপেন সিল মেরে দিই তা হলে কেউ দেখার নেই। সবাই নৌকায় সিল মেরে দেবেন প্রকাশ্যে, কোনো সমস্যা নাই, যেখানে সবাই একতরফা ভোট দিছে, সেখানে আমি কেন সন্দেহতীত হব? আমাকে কেউ কেন সন্দেহ করবে? কারো কোনো ভয় নাই, ভয়ের কোনো দরকারও নেই।’
এদিকে ওই ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে সেখানকার বিএনপি দলীয় ও স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপি মনোনীত মেয়র পদপ্রার্থী মোহা. রহমত আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নৌকার প্রার্থী যদি এভাবে ভোটারদের প্রকাশ্যে ভোট দিতে বলেন তাহলে বিষয়টি আচরণবিধিকে লঙ্ঘন করে। ফলে আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছি। এ বিষয়ে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), সচিবসহ রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। ইসি জানিয়েছে, ভোট সুষ্ঠু হওয়ার ব্যাপারে তারা আশাবাদী এবং আমাদেরও আশ্বস্ত করেছেন।’
রহমত আলী অভিযোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের মেয়র কাউকে তোয়াক্কা করছেন না। তিনি আমার ও আমার ভাইয়ের ওপর হামলা চালিয়েছেন। হামলার পর আদালতের নির্দেশ না দিলে থানার ওসি মামলা নেননি। পরে মামলা নিলেও কাউকে গ্রেপ্তার করেননি। সব মিলিয়ে আমি শঙ্কা প্রকাশ করছি ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে।’
একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পৌরসভার মোবাইল প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে থাকা স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বর্তমান মেয়র প্রার্থী তার অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। নৌকা ব্যবহার করে ভোট কেটে নিয়ে জেতার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’
এ বিষয়ে আরিফুল ইসলামও নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সরকারদলীয় মেয়র পদপ্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনি হুমকি, হামলা, পোস্টার ছেড়া, প্রচারণায় বাধা দেওয়ারও অভিযোগ করেন। এ ছাড়া আশঙ্কা প্রকাশ করে ভোট সুষ্ঠু করার দাবি তুলেছেন আরিফুল ইসলাম।
ভিডিও ভাইরালের বিষয়ে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী এনামুল হক বলেন, ‘হ্যা, আমি বলেছি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। কেউ যদি ওপেন ভোট দিতে চায়, তবে দেবেন। এতে তো দোষের কিছু নেই। কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই।’
তবে ইসিতে ডেকে আপনাকে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার কথা জানিয়েছে। এখন আপনার অবস্থান কী-এমন প্রশ্নে এনামুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাকে ডাকা হয়েছিল, আমি বলেছি এখন থেকে সতর্ক থাকব। আর আমি বললেই তো প্রকাশ্যে ভোট হবে না। ব্যালট বাইরে আনতে হলে তো নির্বাচন কমিশনের আনতে হবে। আমি কীভাবে কী করব?’
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিংকন বিশ্বাস বলেন, মেয়র পদপ্রার্থী এনামুল হককে ডেকে এনে সতর্ক করা হয়েছে। তাঁকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। না হলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি করবে। তিনি সরাসরি নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। যেটা তিনি করতে পারেন না।’