হলি আর্টিজান রায় : অস্ত্র আসে আমের ঝুড়িতে
আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় জঙ্গিরা যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকা থেকে আমের ঝুড়িতে করে অনেক হাত ঘুরে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অবস্থান করা জঙ্গিদের হাতে এসে পৌঁছায় বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া এই মামলায় গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। সেগুলো বসুন্ধরা এলাকায় যায় মিরপুরের শেওড়াপাড়া ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে। আর এই হামলার ঘটনায় হলি আর্টিজানের ভেতরে মূল দায়িত্ব পালন করা জঙ্গিরা গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ফুলছড়ি এলাকার যমুনা নদীর দুর্গম চরে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁতে হামলা চালান বন্দুকধারী জঙ্গিরা। রাতেই ২০ জনকে হত্যা করেন। উদ্ধার অভিযানের সময় বন্দুকধারীদের বোমার আঘাতে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গি। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়। জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেন। এ ঘটনায় গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ।
আগামীকাল বুধবার আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করবেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘিরে আদালত চত্বর কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। কাল দুপুরে রায় ঘোষণা করা হবে। তার আগে কারাগারে থাকা ছয় আসামিকে হাজির করা হবে। বাকি দুই আসামি পলাতক আছেন।
অস্ত্রের দায়িত্বে ছিলেন র্যাশ ও সাগর
পুলিশের দায়ের করা অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, হলি আর্টিজানে হামলার জন্য অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করতে নব্য জেএমবির পক্ষ থেকে আসলাম হোসেন র্যাশ ও হাদিসুর রহমান সাগরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আসলাম হোসেন র্যাশ ২০১৬ সালের মে মাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চারটি নাইন এমএম পিস্তল, আটটি ম্যাগাজিন ও ৩৫টি নাইন এমএম পিস্তলের গুলি ঢাকার কল্যাণপুরে নিয়ে এসে বাশারুজ্জামান চকলেটকে দেন। বাশারুজ্জামান চকলেট সেই অস্ত্র ও গুলি মারজানের মাধ্যমে বসুন্ধারার বাসায় তামিম চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেন।
একইভাবে সাগর ও ছোট মিজান পাঁচটি একে-২২ রাইফেল ও গুলি ভারত থেকে আগেই সংগ্রহ করেন। যা সাঘাটা থানার যমুনা নদীর ফুলছড়ি চরে প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হয়েছিল। হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত বোমা-গ্রেনেডও হাদিসুর রহমান সাগর নিয়ে এসেছিলেন। এসব অস্ত্রশস্ত্র মারজানের মাধ্যমে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় পৌঁছানো হয়।
প্রশিক্ষণ হয় যমুনার চরে
অভিযোগপত্রে বলা হয়, হামলার আগে ফুলছড়ি চরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম ছোট মিজান ভারতে অবস্থানরত সংগঠনের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে বড় মিজানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে মারজানকে দেন। ছোট মিজান নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন। ছোট মিজান ও মারজান মিলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে একে-২২ রাইফেল, ৭.৬২ এবং ৭.৬৫ পিস্তল গুলি ও বোমা বানানোর সরঞ্জাম নিয়ে আসেন।
হামলার একমাস আগে তিনটি একে-২২ রাইফেল মামুনুর রশিদ রিপনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। মারজান তাঁর ভগ্নিপতি হাদিসুর রহমানের সাগরের মাধ্যমে গুলশান হামলার ব্যবহৃত অস্ত্র ও বিস্ফোরক আমের ঝুড়িতে করে ঢাকার বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে আসেন।
এ ছাড়া আব্দুস সুবর খান ওরফে সোহলে মাহফুজ মিরপুর শেওড়াপাড়ার বাশারুজ্জামানের বাসায় এবং যাত্রাবাড়ির একটি বাসায় গ্রেনেড তৈরি করেন। ওইসব গ্রেনেড মারজান ও বাশারুজ্জামান বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে আসেন।
যে পথে জঙ্গিদের হাতে অস্ত্র পৌঁছায়
২০১৬ সালের রমজান মাসের ১৮ রোজার দিকে তামিম চৌধুরী, আসলাম হোসেন র্যাশকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালের সামনে আসতে বলেন। দুপুরে আসলাম চৌধুরী র্যাশ সেখানে যান। তামিম চৌধুরী পরের দিন তাঁকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অস্ত্র আনার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৪ জুন দুপুরে ইবনে সিনা হাসপাতালে গেলে মারজান বিকেল ৩টার দিকে ইবনে সিনা হাসপাতালের প্রবেশ গেট দিয়ে ভিতরে গিয়ে ছোট মিজানকে ব্যাগে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অস্ত্র আনার কথা বলেন।
ছোট মিজান শুধু ব্যাগে করে অস্ত্র আনা ঝুঁকি আছে বলে জানালে মারজান তখন র্যাশকে ডাকেন। মারজান জানান, র্যাশ ইশতিহাদি (সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য) সদস্য বিধায় তিনি পারবেন। এরপর ২৫ জুন র্যাশ এবং ছোট মিজান সন্ধ্যা ৬টায় কল্যাণপুরে হানিফ কাউন্টারে গিয়ে সুমন (ছদ্ম) ও আরিফ (ছদ্ম) নাম ব্যবহার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার বাসের দুটি টিকিট কাটেন।
২৬ জুন রাত একটা থেকে দেড়টার দিকে তাঁরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছান। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ভটভটিতে চড়েন তাঁরা শিবগঞ্জের কানসাট বাজারে যান। সেখান থেকে একটু দূরে আম বাগানের একটি ছোট ঘরে বিশ্রাম নেন।
পরের দিন সকালে সবুর খান ও ছোট মিজান ওই ঘরের মধ্যে এসে চারটি ৯ এমএম পিস্তল, আটটি ম্যাগাজিন ও ৩৫ রাউন্ড ৯ এমএম পিস্তলের গুলি আসলাম হোসেন র্যাশকে বুঝিয়ে দেন। র্যাশ একটি ম্যাগাজিনে গুলি লোড করে একটি অস্ত্রটি কোমরে গুজে নিয়ে বের হন। যাতে পুলিশ চেক করলে তিনি প্রতিরোধ করতে পারেন। বাকি তিনটি অস্ত্র, গুলি ও ম্যাগাজিন কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। পরে র্যাশ ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশায় করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাসস্ট্যাণ্ডের হানিফ কাউন্টারে আসেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হানিফ বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন। সেইদিন ইফতারের ১০ মিনিট আগেই ঢাকা পৌঁছে তিনি তাঁর কল্যাণপুরের ভাড়া বাসায় ওঠেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বাশারুজ্জামান ওই অস্ত্র, গুলি, ম্যাগাজিন কল্যাণপুরের র্যাশের বাসা থেকে সংগ্রহ করে মারজানকে বুঝিয়ে দেন। মারজান এগুলো বসুন্ধরার বাসায় তামিম চৌধুরীকে বুঝিয়ে দেন। তামিম চৌধুরী অস্ত্রগুলো হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখেন বলে অভিযোগগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
হলি আর্টিজানের পথে জঙ্গিরা
ঘটনার দিন ২০১৬ সালের ১ জুলাই, ইশতিহাদি (আত্মঘাতী/ইসাবার) পাঁচ সদস্য দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসুন্ধরার বাসা থেকে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার উদ্দেশে রওনা হন। বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে অস্ত্র, গুলি, গ্রেনেড, চাকু নিয়ে বের হন তাঁরা। রাত ৮টা ৪২ মিনিটে প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ মোবাশ্বের, এরপর রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম পায়েল, শফিকুল ইসলাম বাঁধন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ৭৯ নম্বর রোড ধরে হলি আর্টিজানের মেইন গেটে যান।
মূল গেটের নিরাপত্তারক্ষী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় ও কোথায় যাবেন জিজ্ঞাসা করলে নিবরাস নূর ইসলামের ডান চোখের নিচে ঘুষি মেরে হলি আর্টিজানের ভেতরে ঢুকে যান। সেখানে ঢুকেই গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক তৈরি করেন জঙ্গিরা।
এর পরই ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম এই জঙ্গি হামলার ঘটনা। এই ঘটনার দায়ের করা মামলা গত বছরের ২৬ নভেম্বর বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে গত বছরের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবীর অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়। পরে অবশ্য হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস।
এ মামলায় অভিযোগপত্রে ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটজন আসামি বিভিন্ন অভিযানে ও পাঁচজন হলি আর্টিজানে অভিযানের সময় নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া জীবিত আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক। পলাতক দুই আসামি হলেন শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
অভিযানে নিহত পাঁচ জঙ্গি হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
এ ছাড়া বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত আটজন হলেন- তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।