কালীগঞ্জে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের উৎসব

‘ধন্য তুমি, পুণ্য তুমি আন্তনি, মহাজ্ঞানী, মহাত্যাগী সাধু আন্তনি’—এ বন্দনার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার ভক্তের উপস্থিতিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম সাধু আন্তনির তীর্থোৎসব হয়ে গেল।
আজ শুক্রবার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার পানজোরা গ্রামে এ উৎসব হয়ে গেল। দেশ-বিদেশের বিপুলসংখ্যক ভক্ত তীর্থোৎসবে যোগ দেন। প্রথমবারের মতো এবারই ইতালি থেকে সাধু আন্তনির দেহাংশ এখানে আনা হয়।
উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের প্রাচীন গ্রাম পানজোরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকা। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও পানজোরার রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ গ্রামটি প্রায় অর্ধ লাখ বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ ও শিশুদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক সাধু আন্তনির পার্বণ উপলক্ষে এদিনের এ তীর্থোৎসবে ভক্তদের বিশাল সমাবেশ হয়। বিশেষ করে প্রথমবারের মতো এবার ইতালি থেকে স্বর্ণের মূর্তির ভেতরে সাধু আন্তনির দেহাংশ সংরক্ষণ করে তীর্থোৎসবে এনে চ্যাপেলে রাখা হয়। তা একনজর দেখার জন্য কয়েকদিন ধরে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা ছাড়াও বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষ ভিড় জমিয়েছিল। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ৫০ হাজারেরও বেশি তীর্থযাত্রী এবারের সমাবেশে যোগ দেন। স্থানীয় প্রশাসন তীর্থোৎসব উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও টহল পুলিশ ছাড়াও অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশপথে পুলিশ পাহারা ছাড়া আন্তনি পার্বন কমিটির নিজেদের দেড় শতাধিক নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করছিল।
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে বার্ষিক এ সমাবেশের গুরুত্ব অনেক। সাধু আন্তনিকে ঘিরে এলাকায় নানা কিংবদন্তির কথা শোনা যায়। ভক্তদের অনেকের মতে সাধু আন্তনি ছিলেন মঙ্গলবিধায়ক। তিনি ছিলেন অলৌকিক কর্মসাধক, দাতা ও ত্যাগী। তিনি মানুষের অসাধ্য আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। তাঁর কাছে মানুষ যা চায় ঈশ্বরের কৃপায় তাই তিনি দান করেন।
সাধু আন্তনির স্মরণে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয়দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় নভেনা অর্থাৎ আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির খ্রিস্টযাগ। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে এ খ্রিস্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। দশম দিন অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি শেষদিনে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় আন্তনির পার্বন। এ দিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত দুবার খ্রিস্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ভক্তরা পার্বণের তিনদিন আগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে পরদিন বুধবার বেলা ১২টা পর্যন্ত উপবাস করেন। উপবাস শেষে তারা এদিন নিরামিষ ও শাক-সব্জি ভোজনের মাধ্যমে নিজেদের ভক্তি প্রদর্শন করেন।
সুসজ্জিত মঞ্চের সামনে ছেলেমেয়েরা ‘জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানের সঙ্গে নৃত্য করে। এর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা হয়।
পানজোরা ধর্মপল্লীর ফাদার (পাল পুরোহিত) জয়ন্ত এস গমেজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আজ সকাল ৭টায় প্রথম প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন সহকারী বিশপ শরৎ ফ্রান্সিস গমেজ। প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ খ্রিস্টযাগ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ও শেষ খ্রিস্টযাগ। তারপর প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন প্রথম বাঙালি কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। প্রার্থনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণ কামনা করা হয়। হিংসা, হানাহানি ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়। ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রার্থনায় উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অংশ নেন। প্রার্থনা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। ১০ দিনের অনুষ্ঠান শেষে দেশে শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে কবুতর ওড়ানো হয়।
তীর্থোৎসবের দুই পর্বের প্রার্থনা সভার দ্বিতীয় পর্বে এদিন অংশ নেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী স্থানীয় সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকি এবং ভ্যাটিকান, ফ্রান্স ও ইতালির রাষ্ট্রদূতরা। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের সাফল্য কামনা করেন। এ ছাড়া ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন।