‘অপারেশন হিটব্যাক’ নিয়ে যা বললেন মনিরুল

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ফতেপুরে (এলাকাটি নাসিরপুর নামেও পরিচিত) ‘জঙ্গি আস্তানা’য় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অপারেশন হিটব্যাক’ শেষ হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে শেষ হওয়া এই অভিযানে সাত থেকে আটজন নিহত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।
বিকেলে সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল অভিযানের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। তাঁর পুরো বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো :
“মূলত গতকাল সন্ধ্যার আগে অভিযানটি শুরু হয়। এর আগে যখন আস্তানাটি ঘেরাও করা হয় তখন ১২টির মতো বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সবশেষে সোয়াট যখন বিকেল থেকে অভিযান শুরু করে- এ অভিযান শুরুর আগে মূলত মাইকের সাহায্যে বাড়ির ভেতরের সবাইকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বারবার অনুরোধ জানায়। যেটি আশপাশের মানুষজনও শুনেছেন, আপনারাও শুনেছেন। কিন্তু দেখা যায় তারা ওই সময়ে প্রচণ্ড রকমের বিস্ফোরণ ঘটায়। সেটিতে আসলে ঘরের মূল যে বিল্ডিংয়ের সেটা দরজাসহ জানালার কিছু গ্লাস ভেঙে যায়।
পরবর্তীতে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর পরে অন্ধকার ও রাত হওয়ার পর একটা পর্যায়ে অভিযান অসমাপ্ত রেখে সেটিকে ঘেরাও অভিযান স্থগিত রাখা হয়। আজ বৈরী আবহাওয়ার কারণে অভিযান একটু দেরিতে শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে সেটির ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়। কিন্তু প্রবেশপথসহ বিভিন্ন জায়গা তারা বেশ কিছু শক্তিশালী বোমা-গ্রেনেড ছড়িয়ে রাখে। সেগুলো অপসারণ করে এবং একের পর এক বোমাগুলো বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং নিষ্ক্রিয় করে সেখানে ঢোকা যায়। ঢোকার পর আমরা যে বীভৎস চিত্র দেখতে পাই মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়ানো। সেটি খুব বীভৎস। আপনারা সেটি চিত্রধারণ করলে প্রচার করতে পারবেন না। এতটাই বীভৎস অর্থাৎ তারা এতটাই শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে আমাদের ধারণা, কারণ সেখান থেকে গন্ধ বের হয়েছে। আমরা ধারণা করছি, কাল যখন সোয়াট অভিযান শুরু করে তখন তারা পালানোর পথ নাই, তখনই তারা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্বপরিবারে আত্মহনন করেছে। ডেডবডির বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে। আর কোনো ডেডবডি আসলে অক্ষত নেই। সেগুলো দুটি রুমে ছড়িয়ে পড়ে আছে। সেগুলোর মাথা ও পা একেকটা একেক জায়গায়। সেগুলা মিলেই আমাদের কাছে মনে হয়, সাত-আটটি ডেড বডির অংশ হতে পারে।”
মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমাদের ক্রাইম সিম ইউনিট কাজ করছে। তারা হাতের সাথে মাথা পা মিলিয়ে সঠিক সংখ্যা দিতে পারবে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সাত থেকে আটটি ডেডবডি সেখানে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন বয়সী। সেখানে পুরুষ আছে, মহিলা আছে, দু-একজন অপরিণত বয়স্ক থাকতে পারে। কোনো হাত পা থেকে আমাদের তাই মনে হয়েছে।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মূলত আমরা দেখেছি এই কৌশল তাদের নতুন নয়। তারা পালানোর পথ না পেলে আত্মসমর্পণ না করে অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা না দিয়ে নিজেদের উড়িয়ে দেয়। এ ধরনের প্রবণতা আমরা দেখেছি।’
কখন ‘আত্মহননের’ ঘটনা ঘটল জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে গন্ধ বের হচ্ছে। আর ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। ডেডবডির গন্ধের কারণে আমাদের মনে হচ্ছে যে গতকাল বিকেলের দিকে যখন অভিযানটি শুরু হয়, অভিযান শুরুর পর যে বিস্ফোরণটি সেই সময় বিল্ডিংয়ের বেশ কিছু ক্ষতি হয় সেটার কারণে তাদের মৃত্যু হয়। এই বিষয়ে ক্রাইম সিম ইউনিট কাজ করছে। এটা ফরেনসিক রিপোর্টে নিশ্চিত হব মৃত্যু কীভাবে হয়েছে।’
‘আপনারা জানেন আরেকটি জায়গা যেটি মৌলভীবাজারে শহরে, যেটা প্রথম আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটি এখন পর্যন্ত সেভাবে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। যেহেতু এই কাজটি প্রাথমিকভাবে শেষ হয়েছে, আমরা সে অভিযানটি পরিচালনার করব। সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনাকারী দল সোয়াট কীভাবে করবে সেটার প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করবে।’
এরা কারা জানতে পেরেছেন? জবাবে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান বলেন, ‘আমরা যেহেতু একটা সূত্র ধরে এদের অনুসন্ধান করেছিলাম, সে ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চিত যে নব্য জেএমবির সদস্যরা এখানে আত্মগোপন করেছিল। আজকে যে আইইডিগুলো (বিস্ফোরক) খুঁজে পাওয়া গেছে, সম্ভব হয়েছিল, সেটা আমরা ঢাকা থেকে ড্রোন এনেছিলাম। তারা ভবনের বিভিন্ন জায়গায় আইইডি/বোমা রেখে দিয়েছিল সেটি ড্রোনের মাধ্যমে ছবি তুলে সংগ্রহ করে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে।’
‘আমরা সর্বশেষ অভিযান পরিচালনা করেছিলাম সীতাকুণ্ডে। সীতাকুণ্ডে যে ধরনের আইইডি পাওয়া গেছে সেখানের সাথে এখানে আইইডির মিল রয়েছে। আর এয়ারপোর্টে যে যুবক বোমা বিস্ফোরিত হয়ে মারা গেছে, সেখানে অবিস্ফোরিত পাওয়া বোমার সাথে মিল রয়েছে।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আতিয়া মহলের জঙ্গিদের সাথে এদের মিল রয়েছে। এটি থাকতে পারে। কারণ ডেডবডির অংশবিশেষ মহিলার রয়েছে। ডেডবডির অংশবিশেষ না মেলানো গেলে কয়জন পুরুষ, কয়জন মহিলা এটি প্রাথমিক পর্যায়ে বলা মুশকিল। আসলে একেকটি ডেডবডির অনেকগুলো অংশ হয়ে গেছে। আর কেয়ারটেকারের মাধ্যমে জানতে পারি, শ্বশুর-জামাই, তাদের পরিবারের সদস্য রয়েছে প্রাথমিকভাবে সেটি আমরা নিশ্চিত।’
‘আতিয়া মহলের জঙ্গিরা আর এই জঙ্গিরা একই গ্রুপের অর্থাৎ নব্য জেএমবি। একই সংগঠনের সদস্য। তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এক। তবে তাদের মধ্যে আত্মীয়তার কোনো যোগসূত্র আছে কি না এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।’
গ্রাম-বাংলায় জঙ্গি আস্তানার মধ্যে এটিই প্রথম কি না জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এটি প্রথম না। আমরা এর আগে গাজীপুরের শহর ছেড়ে একবারে শেষ মাথায় আবার নারায়ণগঞ্জের যে পাইকপাড়ার অভিযানে তামিম চৌধুরী নিহত হয় সেটিও একবারে ভেতরে। এটি তাদের হাইডআউট হিসেবে আমাদের কাছে মনে হয়। এখানে যতটুকু জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, আমরা আগে বলেছি, আমার বক্তব্য থেকে আপনার বুঝতে পেরেছেন এই ঘাঁটিটা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। এটি ধরে আমরা কাজ করিনি। যেটা ধরে আমরা কাজ করেছি সেটিতে এখনো অভিযান হয়নি। সেটি ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি অর্থাৎ ভাড়া নেওয়ার সময় কী বলেছিল? সবকিছু মিলে যে ধরনের তথ্য ছিল তাতে মনে হচ্ছে এটা তারা হাইডআউট হিসেবে ব্যবহার করেছে।’