প্রতিবছর অক্টোবর মাস থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে ভিড় জমান জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। এরপর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস মাছ আহরণ করে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন তাঁরা। ৩০ হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীর খেয়ে-পরে বাঁচা-মরা নির্ভর করে এর মাধ্যমে।

কিন্তু চলতি বছর দুবলার চরে জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের জমায়েত নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, দুবলার চরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পেশিশক্তি ও ক্ষমতার দাপটের লড়াই শুরু হয়েছে। আর এতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীদের মধ্যে।

মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমদ মারা যাওয়ার পর এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গত ২৮ জুলাই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। 

দুবলার চরের মৎস্যজীবীরা জানান, মেজর জিয়াউদ্দিন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে ৩৪-৩৫ বছর দুবলার চরসহ সুন্দরবন উপকূলে শীতকালে শুঁটকি মাছ আহরণসহ বছরব্যাপী বঙ্গোপসাগরে সুন্দরবন উপকূলের মাছ ব্যবসার প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী ছিলেন। এ ব্যবসায় জিয়াউদ্দিনের সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন, ভাগ্নে শাহনুর রহমান শামীম প্রমুখ। এ ছাড়া কক্সবাজার এলাকার জগন্নাথ বহরদার, সাবের বহরদার, অনীল বহরদার, খুলনার মাসুম চৌধুরী, মোংলার বুলবুল ইজারাদারসহ আরো কয়েকজন ব্যবসা করতেন।

দুবলার চরের কয়েকজন প্রবীণ মৎস্যজীবী জানান, ১৯৮২ সালের দিকে মেজর জিয়াউদ্দিনের পাশাপাশি খুলনার খান সফিউল্লাহ খোকন নামের এক ব্যক্তি সুন্দরবনের দুবলার চরে চিংড়ি ব্যবসা ও অন্যান্য মাছের ব্যবসা এবং শুঁটকি মাছ পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে অন্য এক প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীকে নিয়ে সুন্দরবনে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রশাসনের সহায়তায় আলোরকোল চরের সমস্ত মাছের ব্যবসার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেন খোকন। একপর্যায়ে খোকন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে নিজের প্রতিপত্তি ও প্রভাব সংহত করেন। সুন্দরবন উপকূলের ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, কয়রা, দাকোপ, রামপাল প্রভৃতি এলাকায় ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা খোকনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ কেউ সুন্দরবনের সাগরে মাছ আহরণে নিয়োজিত হয়েছেন।

কয়েকজন জেলে মহাজন অভিযোগ করে বলেন, দাদন ব্যবসা, বন বিভাগের রাজস্ব ফাঁকি, ছোট মাছ ব্যবসায়ীদের ভাগের টাকা মেরে দেওয়া, জলদস্যু-বনদস্যুদের সঙ্গে যোগসাজশে জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়সহ অবৈধ পথে এই ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই অর্থ পুঁজি হিসেবে খাটিয়ে দুবলার চরের মাছের ব্যবসায়ও তিনি তাঁর অবস্থান শক্তিশালী করেন।

জেলে-মহাজনরা জানান, মেজর জিয়াউদ্দিনের জীবিত অবস্থায় দুবলার চরসহ সুন্দরবনে সফিউল্লাহ খোকন কখনই প্রকাশ্যে দাপট বা দৌরাত্ম্য দেখাননি। তবে জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুর পর খান সফিউল্লাহ খোকন সেখানে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। এরই মধ্যে মেজর জিয়াউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয়-স্বজনকে দুবলার চর থেকে উৎখাত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার সন্ত্রাসীদের সেখানে নিয়োজিত করছেন। যাতে এ ক্যাডার বাহিনী সুন্দরবনে মেজর জিয়ার অবর্তমানে অবস্থান নিয়ে মাছের ব্যবসার আড়ালে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্রভাণ্ডার হিসেবে সুন্দরবনের গহিন অরণ্য ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে দুর্গম চরাঞ্চলটি অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন দুবলার চরের জেলে ও শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।

কে এই খোকন

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, খান সফিউল্লাহ খোকন পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধী খান এ সবুরের আস্থাভাজন লোক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং আগে-পরে খোকনের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। একসময়কার খুলনার বহুল আলোচিত রাজনীতিবিদ নিহত আবুল কাশেম, পরে তাঁর ভাতিজা সন্ত্রাসী লিটু ও এরশাদ শিকদারের সঙ্গে খোকনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই ঘনিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে খুলনাসহ সুন্দরবনে ব্যাপক আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে খুলনার ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় মো. চান মিয়া ও ৪ নম্বর ঘাটের চিংড়ি ব্যবসায়ী নুরুল হকের (চিংড়ি নুরু) মাছের ডিপোর মালিকানা জোর করে লিখে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত খোকন খুলনার ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, চালনা, কয়রা, বটিয়াঘাটার হাজার হাজার বিঘা চিংড়িঘের দখল করেন এবং কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন। ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নানা অভিযোগে যৌথ বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিলেন খোকন।

এসব ব্যাপারে খান সফিউল্লাহ খোকনের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, দুবলার চরে মাছের ব্যবসার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নানা প্রতিপক্ষ রয়েছে। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ সবই ব্যবসায়িক চক্রান্ত। তাঁকে হেয়প্রতিপন্ন করতে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। তিনি কোনো ধরনের বেআইনি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলেন না এবং এখনো নেই।

অশান্ত হতে পারে দুবলার চর

একাধিক মৎস্যজীবী জানান, খান সফিউল্লাহ খোকন চক্রের হাতে দুবলার চরের শুঁটকি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মোংলার মাছ ব্যবসায়ী শাজাহান খান, আবুল বাশার, আলম শেখ ও রামপালের মাছ ব্যবসায়ী দীপক সরকার, অচিন্ত মণ্ডল, জালাল উদ্দিন, চুন্নু মিয়াসহ অনেক ব্যবসায়ী আশঙ্কা করেছেন যে মেজর জিয়াউদ্দিনের মৃত্যুর পর দুবলার চরের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা এবারের মৌসুমে মৎস্যজীবীরা যাতে সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারেন তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসনের কঠোর নজরদারির দাবি জানান।

এ প্রসঙ্গে প্রয়াত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিনের ছোট ভাই ও দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের নেতা মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন জানান, আসন্ন শুঁটকি মৌসুমে সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন জেলেরা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের একটি মহল অপতৎপরতা চালাচ্ছে। দুবলার চরাঞ্চলে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা কিংবা অপশক্তির আগ্রাসন জেলেরা মেনে নেবেন না।

এ ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এবারের শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোনো ধরনের অরাজকতা অথবা সংঘাত সৃষ্টি না হয় সে জন্য বন বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সজাগ দৃষ্টি রাখছে।’

কোস্টগার্ড পশ্চিম (মোংলা) জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, শুঁটকি মৌসুমে যাতে কোনো সংঘাত ছাড়াই মৎস্যজীবীরা সুষ্ঠুভাবে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়া করতে পারেন, সে জন্য কোস্টগার্ড সদস্যরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। সেখানে কোনো অবস্থাতেই অপশক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।