মানবতাবিরোধী অপরাধে সুবহানের মৃত্যুদণ্ড

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মুহাম্মদ আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তাঁর বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের মধ্যে ছয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং একটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আজ বুধবার দুপুর ১২টার দিকে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এ রায় ঘোষণা করেন। আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে ১, ২, ৩, ৪, ৬ ও ৭ অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত ১ নম্বর অভিযোগ হলো, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া ২০ জনকে বিহারিদের সহায়তায় হত্যা; ৪ নম্বর অভিযোগ, ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামে বাড়িঘর লুটপাট ও কয়েকজনকে হত্যা এবং ৬ নম্বর অভিযোগ, সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন-চারশ মানুষকে হত্যা। এসব অপরাধে আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং ৩ নম্বর অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের রায় প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে বেলা সোয়া ১১টার দিকে ১৬৫ পৃষ্ঠার রায় পড়া শুরু করেন চেয়ারম্যান। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলাম।
আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মুনির মামলার রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রায়ে আইনগত ও তথ্যগত ভুল রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালে যাদের সাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয়েছে, ঘটনার সময় তাদের বয়স ছিল দুই বছর বা তিন বছর। আর এত কম বয়সের কেউ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলে তারা সাক্ষী হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে না।
রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করবে জানিয়ে শিশির বলেন, ‘আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, আশা করছি, উচ্চ আদালত সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তাঁকে বেকসুর খালাস দেবেন।’
তবে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সুলতান মাহমুদ সিমন। তিনি বলেন, আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে আনা নয়টি অভিযোগের ভেতর ছয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ের ক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য হয়নি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, ট্রাইব্যুনাল মামলার রায় দিয়েছেন ১৯৭১ সালের ভিত্তিতে। এ কারণে এ রায়ে বয়স বিবেচ্য হয়নি। এ ছাড়া তিনি যে জামায়াতে ইসলামীর আমির ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এ বিষয়গুলোও প্রমাণিত হয়েছে। তিনি নিজে স্বাধীনতাকামীদের গুলি করে হত্যা, তরবারি দিয়ে আঘাত করা, মুজাহিদ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে আর্মিকে পথ দেখিয়ে দেওয়া অভিযোগগুলোও প্রমাণিত হয়েছে।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আবদুস সুবহানকে আজ সকাল ৯টার দিকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সুবহানের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। সেদিন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করেন।
মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৩১ জন সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষ হাজির করে একজন সাফাই সাক্ষী।
২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধুর সেতুর পূর্ব পাশ থেকে আবদুস সুবহানকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পর ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
৩০ সেপ্টেম্বর জামিন চেয়ে আবেদন করেন জামায়াতের এই নেতা। তবে ২ অক্টোবর জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সুবহানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ২ অক্টোবর থেকে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।
শুরুতে আবদুস সুবহানের মামলা ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন থাকলেও ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এটিকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করেন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
মুহাম্মদ আবদুস সুবহানের বাড়ি পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লায়। তিনি মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে। তাঁর ভালো নাম আবুল বসর মিয়া হলেও এলাকায় তিনি ‘মাওলানা সুবহান’ নামে পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় পাবনা জেলায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন আবদুস সুবহান। তিনি পাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও কেন্দ্রীয় জামায়াতের শূরা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরে পাবনা পিস কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন।
আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া স্বাধীনতাকামী মানুষকে বিহারিদের সহায়তায় হত্যা করা, ১৩ এপ্রিল ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে লুটপাট ও পাঁচজনকে হত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া, ২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিয়ে সাহাপুর গ্রামে বাড়িঘর লুটপাট ও কয়েকজনকে হত্যা, ১২ মে সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে তিন-চারশ মানুষকে হত্যা।