রাবির ঘাস সমৃদ্ধ করছে অর্থনীতি

বিশ্ববিদ্যালয়। কোনো জায়গায় প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একে ঘিরে গড়ে ওঠে আলাদা এক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির অংশ শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির আশপাশের সব এলাকাই হয়ে ওঠে এর অংশ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবে প্রভাবিত হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও।
স্বাভাবিকভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। চারদিকে সবুজের সমারোহ আর দিগন্তজোড়া মাঠ এখানে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। এ বিস্তৃত ক্যাম্পাস আর মাঠজুড়ে গজিয়ে ওঠা ঘাসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আশপাশ এলাকার ভিন্ন এক অর্থনীতি।
প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ক্যাম্পাসে আসতে থাকেন স্থানীয়রা। উদ্দেশ্য, গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটা। ভোরের সেই ঘাস কাটার দৃশ্য যে কারো মনকে পুলকিত করে তুলবে। সবুজের সঙ্গে মিশে গিয়ে এই প্রকৃতির মালীরা যেন ঘাস কেটে পরিপাটি রাখতে এসেছে ক্যাম্পাসকে। অথচ এ ঘাসের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে আশপাশের কয়েকটি এলাকার গবাদি পশু। এতে অভাব দূর হচ্ছে নিম্নবিত্তদের।
বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়াম, জুবেরি মাঠ, হবিবুর রহমান মাঠ, ইবলিশ চত্বর জুড়ে সন্ধান মিলে ঘাসের। এ রকম মাঠ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্রই রয়েছে ঘাসের পর্যাপ্ত মজুদ, যা দীর্ঘ সময় ঘাস কাটা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় রূপ নেয় জঙ্গলে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিনোদপুর, কাজলা, মেহেরচণ্ডী, ধরমপুর, বুদপাড়া ও খোঁজাপুর এলাকার গবাদি পশুর ঘাসের জোগান আসে ক্যাম্পাস থেকে। এসব এলাকার প্রায় অর্ধেক মানুষই লালন-পালন করে গবাদি পশু। তবে এর পরিমাণ আগে আরো বেশি ছিল বলে জানিয়েছেন ঘাস কাটতে আসা লোকজন।
যারা এই গবাদি পশু পালন করে তাদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। রিকশাওয়ালা-ভ্যানচালক কিংবা শহরে সাইকেল নিয়ে কাজ করতে আসা শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার পথে ক্যাম্পাস থেকে ঘাস কেটে নিয়ে যায় আদরের সেই ‘মহেশটির’ (গরু) জন্য। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকানি-কর্মচারী-কর্মচারী যাঁরা আছেন, তাঁরাও অফিস শেষে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে যান ঘাস। কিংবা কর্মস্থলে আসার আগে ঘাস কেটে রেখে আসেন। আবার স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিও পড়াশোনার ফাঁকে ক্যাম্পাসে আসে গরু চরাতে কিংবা ঘাস কাটতে।
বিশ্ববিদ্যালয় স্টেডিয়ামে ঘাস কাটতে আসা দাশমাড়ির পিয়ারুল ইসলাম এমনই একজন। তিনি বলেন, ‘আমরা নিম্ন শ্রেণির মানুষ। দিন এনে দিন খাই। আমাদের পক্ষে টাকা জমা রাখা সম্ভব হয় না। লুন নিয়ে আমরা দুই-একটা গরু কিনি। পরে শোধ হয়ে গেলে গরুটা আমাদের হয়ে যায়। ওই গরু থেকে ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে ভ্যান-রিকশা-জায়গা-জমি কিনি। কেউ বেটি বিয়ে দেয়। আমি আমার দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছি গরু বিক্রির টাকা জমিয়ে।’
এ কথা শোনার পর দাশমাড়ি এলাকার বাসিন্দা জামাল মিয়া বলে ওঠেন, ‘আমি আমার এক বেটিকে বিয়ে দিছি।’ জামাল মিয়া সোনালী ব্যাংকে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি করেন। বাকি সময়টা ভ্যান চালিয়ে ও গবাদি পশু লালন-পালনের কাজে ব্যয় করেন। এসব এলাকার যেসব লোক গবাদি পশু পালন করে, তাদের ৯০ ভাগই ক্যাম্পাসের ঘাস কেটে খাওয়ায় বলেও তারা জানান।
এমনও আছে কারো বাবা ক্যাম্পাসে ঘাস কেটেছেন, কখনো বা দাদাও কেটেছেন। দীর্ঘদিনের এই চর্চার ফলে এখনো তাঁরা আসেন।
স্থানীয় চৌমুহনী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইউসুফ এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ঘাস কাটতে আসেন। তাঁর বাপ-দাদারা এখানে ঘাস কেটেছেন। তাঁদের সঙ্গে তিনিও আসতেন নিয়মিত। অনেক কষ্টে লেখাপড়া করে আজ তিনি শিক্ষক। কিন্তু সেই মূলের টান ও ভালোবাসার জায়গাটা তিনি ভুলে যেতে পারেননি। তাই তো তিনি প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে চলে আসেন ক্যাম্পাসে। গবাদি পশুর জন্য খাস কেটে নিয়ে যান।
তবে শিক্ষক ইউসুফ বেশ কয়েকটি সমস্যার কথাও বলেন। বর্ষা মৌসুমে ঘাস বেশি হয়। এ সময় মাটি ভেজা থাকে। তাই ঘাস কাটার এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আর শীতকালে একবার ঘাস কাটলে তা সহজে গজাতে চায় না। তাই ওই সময় গবাদি পশুকে খড়-ভুসি কিনে খাওয়াতে হয়, যা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য একটু কষ্টের ব্যাপার বলে ইউসুফ উল্লেখ করেন।