‘মাসুদা ভাট্টিকে কন্যা সমতুল্য মনে করে ক্ষমা চাইতে পারতেন’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2018/10/23/photo-1540299549.jpg)
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেপ্তার হয় গতকাল সোমবার রাতে। এরপর তাঁকে সারারাত মহানগর গোয়েন্দা কার্যালয়ে (ডিবি) রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে হাজির করা হয় তাঁকে। এরপর বেলা সোয়া ১টার দিকে তাঁকে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলামের আদালতে তোলা হয়।
জামিনের শুনানিকে কেন্দ্র করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত প্রাঙ্গনের দুই পাশে কঠোর নিরাপত্তার বলয় তৈরি করে পুলিশ। শুধু আইনজীবী ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়া কাউকে সিএমএম আদালতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলামের আদালতে সিনিয়র আইনজীবী ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি। পরে অবশ্য আইনজীবীরা প্রতিবাদ জানালে গেট খুলে ঢুকতে দেওয়া হয়। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে জামিন শুনানি শুরু হয়।
বিচারক কায়সারুল ইসলাম ব্যারিস্টার মইনুলের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘সিকিউরিটির কারণে আদালতে প্রবেশ রেস্ট্রিক্ট করা হয়েছে। আর আপনাদের সিনিয়ররা তো কোর্টে আছেন।' এ সময় তিনি সবাইকে শান্ত হতে বলেন। তখন ব্যারিস্টার মইনুলকে যেন আদালতের ভেতরে কাঠগড়ায় না রাখা হয় সে বিষয়ে তাঁর আইনজীবীরা আবেদন জানালে বিচারক তাঁকে আইনজীবীদের কাতারে বসার অনুমতি দেন। এ সময় ব্যারিস্টার মইনুল হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের পক্ষে ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার, গোলাম মোস্তফা খান, মোসলেহ উদ্দিন জসীমসহ শতাধিক আইনজীবী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আব্দুল্লাহ আবু, কাজী নজিবুল্লাহ হিরু, তাপস কুমার পালসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী।
শুনানির শুরুতে সানাউল্লাহ মিয়া আদালতকে বলেন, ‘কোন মামলায় মইনুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা জানা দরকার। এ বিষয়ে অন্ধকারে আছি।’ তখন আদালত বলেন, ‘মইনুল হোসেনকে রংপুরের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ তাঁকে অন্য কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে কি না, তাও জানতে চান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তখন আদালত বলেন, ‘আর কোনো মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।’
এরপর আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার ব্যারিস্টার মইনুলের বিরুদ্ধে মামলার ধারা এবং আবেদনে কী বলা হয়েছে, তা জানতে চান । আদালত পুলিশের আবেদনটি দেখান। তখন মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতে বলেন, ‘এখানে কোনো ধারা উল্লেখ নেই। ধারা সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে কীভাবে আদেশ দেবেন?’
তখন বাদী পক্ষের আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, ‘ধারা আছে কি না, তা আমাদের জানার বিষয় না। মামলাটি রংপুরের আর অনুমান করতে পারি, সারা দেশে যে মামলাগুলো হচ্ছে সেগুলোর মতো অথবা অন্য হতে পারে।’
এরপর ব্যারিস্টার মইনুলের আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘আমার কাছে মামলার একটা কপি আছে। সেখানে মানহানি মামলায় ৫০০, ৫০৬ ও ৫০৯ ধারা উল্লেখ আছে।’ এর জবাবে বিচারক কোনো কিছুই বলেননি।
এরপর আইনজীবীরা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের পক্ষে জামিন শুনানি করেন। শুনানিতে তাঁরা বলেন, ‘ঘটনা ঢাকার, আসামিও ঢাকায় আর মিলি মায়া বেগম রংপুরে মামলা করেছেন। এখানে তাঁর কী মানহানি হয়েছে? আর একটা টকশোর ব্যাপারে ঢাকায় মামলা হয়েছে। আর মামলাটি জামিনযোগ্য ধারার, তাঁকে আদালত জামিন দিতে পারেন। আদালত তাঁকে জামিন দিয়ে একটা যুক্তিসঙ্গত সময় দিয়ে নির্দেশনা দিতে পারেন। আর অজামিনযোগ্য হলে কী হবে, আপনার ভালো জানা আছে। মামলাটি জামিনযোগ্য ধারার এবং মইনুল হোসেন বয়স্ক, অসুস্থ বিবেচনায় তাঁকে জামিন দেওয়ার প্রার্থনা করছি।’
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু শুনানিতে বলেন, ‘ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বক্তব্য সারা জাতি শুনেছে। সারা দেশের নারী জাতিকে অবমাননা করা হয়েছে। আর মামলাটি রংপুরের, তাকে সেখান থেকে জামিন নিতে হবে। আমরা জামিন দিতে পারি না। এখানে ডকুমেন্ট নেই, আপনার জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। তাঁকে রংপুরে পাঠানোর আবেদন করছি।’
বাদীপক্ষে আরেক আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, ‘তিনি (ব্যারিস্টার মইনুল) একটি ঘৃণিত কাজ করেছেন। প্রকাশ্য টেলিমিডিয়ায় একজন খ্যাতনামা সাংবাদিককে চরিত্রহীন বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মা-বোন, নারী জাতিকে, যারা পেশায় রয়েছে সবাইকে হেয় করেছেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের কথা বললেও তিনি তা করেননি। তিনি নিউ নেশন পত্রিকায় একটা খোলা চিঠি লিখলেন। সেখানে বলা হলো, আমি কেন? এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনাকে চরিত্রহীন বলা হচ্ছে। এ ছাড়া, একটা ভিডিওতে তিনি মাসুদা ভাট্টিকে পাঁচ-ছয়বার বাজে মহিলা উল্লেখ করেছেন। তিনি মাসুদা ভাট্টিকে কন্যা সমতুল্য মনে করে বলতে পারতেন, ভুল হয়েছে, তিনি ক্ষমা চাইতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি সকলকে আহত করেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন নারীসমাজকে।’
এরপর ব্যারিস্টার মইনুলের আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, ‘কাকে কী বলেছে, আমরা সবাই জানি। জামিনযোগ্য ধারায় জামিন না দিলে আমরা জামিনের আবেদন প্রত্যাহার করব। এ সময় আইনজীবীরা আদালতে হট্টগোল শুরু করেন। এরপর শুনানি কিছুক্ষন বন্ধ থাকে।’
দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে বিচারক আদালতের এজলাস থেকে নেমে যান। অতঃপর ১টা ৫৫ মিনিটে বিচারকের খাসকামরা থেকে এক পুলিশ সদস্য আদালতে এসে বলেন, ‘আসামি মইনুলের জামিন নাকচ করে, কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এ আদেশের পরে আদালতে উপস্থিত মইনুলের পক্ষের আইনজীবীরা বিভিন্ন ম্লোগান দেন এবং প্রতিবাদ জানান। এরপর মইনুলকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জে) নিয়ে যাওয়া হয়।
গতকাল রাত ১০টার দিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশনের প্রকাশক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহাবুব আলম গতকাল সোমবার রাতে জানান, সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে নিয়ে মানহানিকর উক্তির অভিযোগে রংপুরে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। এ মামলায় পুলিশ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে জেএসডির সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।
গত ১৬ অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকা, ভোলা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর ও কুড়িগ্রামে একটি করে এবং কুমিল্লায় দুটি মামলা করা হয়। এসব মামলার মধ্যে ঢাকা, জামালপুর ও কুড়িগ্রামের মামলায় হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন নিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল।